সেরে ওঠার পরও কাটছে না করোনা আক্রান্তদের মানসিক ট্রমা

করোনায় সেরে ওঠা

ভারতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়ছে; সেই সঙ্গে আরও একটি বড় সঙ্কট মাথাচাড়া দিচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যার এই দেশে। কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে মানসিক ‘ট্রমার’ এই চিত্র উঠে এসেছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

দীর্ঘদিন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে কাটিয়ে ফেরার পর থেকেই হেলুসিনেশনে ভুগছেন ৪২ বছর বয়সী রাজেশ তিওয়ারি। জুন মাসের গোড়ার দিকে তার করোনাভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়ে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। পাঁচ দিন পরে তাকে ভেন্টিলেটরও দিতে হয়।

তিন সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পর করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠেন তিওয়ারি। তবে কিছু দিনের মধ্যেই বুঝতে পারেন, তিনি আসলে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি।

বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিওয়ারি বলেন, “চিকিৎসা নিয়েছিলাম বলে আমি এখন ভালো আছি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ খুব কঠিন গেছে।”

রাজেশ তিওয়ারির ঘরে ফেরায় পরিবারে আনন্দের কমতি ছিল না। যদিও শিগগিরই তারা বুঝতে পারেন, সব কিছু ঠিক আগের মতো নেই।

একদিন টিভির সামনে চিৎকার করে ওঠেন তিওয়ারি; সেটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন। তার টিভি দেখা বন্ধ করা ছাড়া পরিবারের উপায় ছিল না। বাসায় সবার ল্যাপটপ চালানোও বন্ধ করতে হল।

আসলে আইসিইউতে থাকার সময় মনিটরে টানা ‘বিপ’ ‘বিপ’ শব্দ আর সেই সঙ্গে সংখ্যার ওঠানামা দেখার সেই ছবি মন থেকে মুছে ফেলতে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তিওয়ারিকে।

একই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে অমিত শর্মা ও তার পরিবারকে। ৪৯ বছর বয়সী শর্মাকে আইসিইউতে কাটাতে হয়েছিল ১৮ দিন। ওই সময় তিনি প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু দেখেছেন। তরুণ ও বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ; তার চারপাশের কোভিড-১৯ রোগীরা মারা যাচ্ছিলেন একে একে।

“একদিন আমার পাশের দুজন রোগী মারা গেল; তাদের মৃতদেহ কয়েক ঘণ্টা ওখানেই ছিল। আমি সেসব দৃশ্য মাথা থেকে সরাতে পারি না। আমার কেবই ভয় হয়, কোভিড আমাকে মেরে ফেলবে।”

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গেছেন অমিত শর্মা। ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা তিনি ভুলতে পারছেন না। পরিবারের কারও সঙ্গে যখনই কথা বলেন, কোভিড ওয়ার্ডে একের পর এক মৃত্যু দেখার কথা ঘুরে ফিরে আসে।

মুম্বাইয়ের পিডি হিন্দুজা হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বসন্ত মুন্ড্রা বিবিসিকে বলেছেন, করোনাভাইরাস থেকে সেরা ওঠা অনেক রোগীই এ রকম মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে যারা ভেন্টিলেশনে ছিলেন, অথবা যাদের অনেক দিন আইসিইউতে থাকতে হয়েছিল।

“একজন রোগীকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হয়, ততক্ষণে তার মস্তিষ্ক এমনিতেই অনেকটা অবসন্ন হয়ে যায়। এরপর কোভিড ওয়ার্ডের ভয়াবহতা তার চেতনাকে গ্রাস করে ফেলে।”

অন্য রোগের সঙ্গে কোভিড-১৯ এর বড় পার্থক্য হল, এ রোগে আক্রান্তরা হাসপাতালে ভর্তি হলে পরিবার-স্বজনদের সাথে দেখা করার সুযোগ থাকে না। এমনকি যে চিকিৎসক ও নার্স সেবা দিচ্ছেন, তারা সব সময় ‍সুরক্ষা পোশাক পরে থাকেন বলে তাদের চেহারা দেখারও সুযোগ মেলে না রোগীর।

এই পরিস্থিতি চিকিৎসকের উপর রোগীর আস্থা তৈরিতে সমস্যা করছে এবং তা রোগীর সেরে ওঠায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন দক্ষিণ ভারতের এরনাকুলাম মেডিকেল কলেজের গুরুতর সেবা বিভাগের প্রধান ডা. এ ফাথাহুদিন।

করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা রোগীর কাছে এক নিঃসঙ্গ যাত্রার মতো মনে হতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, যে সব রোগী সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে ফেরেন তাদের পরে মানসিক সমস্যায় ভোগার ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এসব উপসর্গের মধ্যে বিষণ্নতা, অস্থিরতা, ভয়ানক স্মৃতিগুলো বার বার ফিরে আসা ও হেলুসিনেশন দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন ডা. মুন্ড্রা।

তবে এখনও করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মানসিক সমস্যাগুলো যথেষ্ট মনোযোগ পাচ্ছে না বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকরা। সরকারি ভাষ্য ও গণমাধ্যমে এ বিষয়ে খুবই সামান্য উঠে আসছে। তাতে অবাক হননি বলে জানিয়েছেন খ্যাতিমান মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সৌমিত্র পাথারে।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “এই মহামারীর সময় আপনি যা দেখছেন তা মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় ভারতের খুব সামান্য বিনিয়োগেরই ফল।

“ভারতে মানসিক সমস্যায় ভোগা রোগীর চিকিৎসার জন্য সুযোগ-সুবিধা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দুটোরই ঘাটতি রয়েছে। ছোট শহরগুলো, যেখানে লোকজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো ধরতেই পারেন না, সে সব জায়গায় পরিস্থিতি আরও খারাপ।”

ডা. পাথারে বলেন, “ভারতের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার অবকাঠামো বেশিরভাগই শহরকেন্দ্রিক; যাতে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষঞ্জের কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই বা থাকলেও তা খুব সীমিত। মহামারীর মধ্যে এই বৈষম্য স্পষ্ট হচ্ছে।

“সরকার যদি শিগগিরই এই সমস্যা চিহ্নিত এবং তার সমাধানে পদক্ষেপ নিতে না পারে তাহলে ভারতকে ‘মানসিক স্বাস্থ্য মহামারীর’ মুখে পড়তে হবে।”

তার মতে, একটা ভালো শুরু হতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার উপসর্গগুলোর বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। এবং এর পরের ধাপে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ বাড়াতে হবে, বিশেষ করে ছোট শহরগুলোতে।

“আমি জানি এটা রাতারাতি ঘটবে না; কিন্তু আমাদের কোথাও থেকে শুরু করতে হবে,” বলেন এই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

দিল্লির ফোরটিস হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান কামনা ছিবের বলেন, এই মহামারীর সময়ে মানসিক সমস্যার চিকিৎসা নিতে আসা লোকের সংখ্যা বেশ বেড়েছে।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের লকডাউন, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং সব সময় সতর্ক থাকার তাগাদা মানুষকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে ‍তুলছে এবং আরও বেশি মানুষ উদ্বেগ ও বিষণ্নতা নিয়ে কথা বলতে হাসপাতালে আসছেন।

“প্রতিটি দিনই সমস্যা বেড়েছে,” বলেন ডা. কামনা ছিবের।

চিকিৎসকরা এখন কোভিড-১৯ পরবর্তী চিকিৎসা সেবায় মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিচ্ছেন।

ড. ফাথাহুদিন বলেন, এ বিষয়ে প্রতিটি হাসপাতালের কিছু করা দরকার।

“নতুবা আমরা কোভিড-১৯ থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারলেও তাদের বিষণ্নতা ও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে ফেলতে পারি।”

সূত্র: বিবিসি।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন

Previous articleকনভার্সন ডিজঅর্ডার: হঠাৎ কথা বন্ধ হয়ে যায় যে রোগে…!!
Next articleওষুধ বাদ দিলে খুব খারাপ লাগে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here