হেরা গুহার ধ্যান শিক্ষা: কোয়ারেন্টাইন হতে পারে আত্মশুদ্ধির পাথেয়

হেরা গুহার ধ্যান
হেরা গুহার ধ্যান

নির্জনবাস, জনবিচ্ছিন্ন থাকা, একাকী ধ্যানমগ্ন থাকা, নির্জনে একাকী প্রার্থনা করা, ইয়োগা, মেডিটেশন, মক্কার হেরা গুহায় হযরত মুহাম্মাদ স. এর নিরিবিলি অবস্থান, রমজানের ইতেকাফ ইত্যাদি পরিভাষা ও তথ্যমালার কার্যকর প্রতিনিধিত্ব করছে বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত ‘কোয়ারেন্টাইন’। বিশ্বের শত কোটি মানুষের জন্য কোয়ারেন্টাইন অবস্থা সুযোগ এনেছে নিজের অন্তরাত্মাকে উপলব্ধি করার।
আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে পারে। মানুষের মধ্যে যে হীনমন্যতা থাকে তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার সর্বোত্কৃষ্ট পথ হলো আত্মশুদ্ধি। পবিত্র কুরআনে সূরা ফাতিরের ১৮ নম্বর আয়াতে বান্দাকে আত্মশুদ্ধির তাগিদ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘কেউ যখন আত্মশুদ্ধি করে; সে তো তা করে তার নিজের জন্যই।’
আত্মশুদ্ধিকে বলা হয় মানব চরিত্রকে সংশোধনের এবং শুদ্ধ পথে নিয়ে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায়। ইবাদত বা প্রার্থনার মূল লক্ষ্য হলো আত্মশুদ্ধ হওয়া। মানুষের মাঝে যেসব খারাপ অভ্যাস রয়েছে, যেসব হীনমন্যতা রয়েছে তা ত্যাগ করা। পবিত্র কুরআনে সূরা আশ-শামসের ৯ ও ১০ নম্বর আয়াতে আত্মশুদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে বলা হয়েছে, ‘সে সফলকাম হবে যে নিজেকে শুদ্ধ করবে এবং সে ব্যর্থ হবে যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে’।
হেরা গুহায় ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ স. একাকী ইবাদত ও  ধ্যানমগ্ন থেকে আত্মশুদ্ধির ব্যবহারিক দিক সুস্পষ্ট করেছেন। জনমানুষ থেকে পৃথক হয়ে তথা কোয়ারেন্টাইনে থেকে নির্জন ধ্যানমগ্নতা মানুষের চিন্তার জগৎ, শারিরকি ও মানসিক শান্তির পথ সৃষ্টি করে।
Quarantine অর্থ সঙ্গরোধ। সীমিত সময়ের জন্য সঙ্গরোধ হয়ে ইবাদতে মগ্ন হওয়া ইসলামে গ্রহনযোগ্য; যদিও স্থায়ী বৈরাগ্যবাদ নিন্দনীয়। কোয়ারেন্টাইনে থেকে ইবাদাতের আরেকটি উদাহরণ হলো রমজানের ইতেকাফ। ইতেকাফ অর্থ অবস্থান করা,স্থির থাকা, কোনো স্থানে আটকে পড়া বা আবদ্ধ হয়ে থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় রমজান মাসের শেষ দশক জাগতিক কাজকর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইবাদতের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা ও স্থির থাকাকে ইতিকাফ বলে।
বর্তমান সময়ে ঐশ্বরিক গ্রন্থ অধ্যয়ন, প্রার্থনা ও ধ্যানমগ্নতা হতে পারে আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ উপায়। মানব জীবনে তার সুন্দর ব্যবহার উপযোগী সময় চলছে এখন বিশ্বব্যাপী।
হেরা গুহায় নবীর (স.) ধ্যামগ্নতা ও আত্মশুদ্ধি
১৪০০ বছর পূর্বে নবুয়াত লাভের আগে হেরা গুহায় ইবাদাতের জন্য  কোয়ারেন্টাইনে যেতেন নবী হযরত মুহাম্মাদ স.। এবং হেরা গুহাতেই সর্বপ্রথম ওহী অবতীর্ণ শুরু হয়।
নবীর বয়স যখন চল্লিশের কাছাকাছি তখন তিনি প্রার্থনার জন্য নিঃসঙ্গতা বেছে নেন এবং ধ্যান শুরু করেন। মূলত মানুষের নোংরা জীবনযাপন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অরাজকতা আর নৈতিক অধঃপতন তাকে মর্মাহত করে এবং তিনি সর্বদাই এর সমাধান খোঁজায় তৎপর থাকার ফলেই এই ধ্যানে অংশ নেন। তিনি ব্যবসা উপলক্ষে বিভিন্ন দেশে গিয়েছিলেন এবং কোন সমাজেই মুক্তি ও আদর্শ নেতৃত্বের কোন নির্দেশনা লাভ করতে সক্ষম হননি। এসব নিয়ে চিন্তার পাশাপাশি বিশ্বস্র্রষ্টার স্বরুপ নিয়ে চিন্তাও তার নিঃসঙ্গ জীবনের ভাবনার খোরাক হয়ে দেখা দেয়। পরম চিন্তার পরিবেশ তৈরির সুবিধার্থে তিনি মক্কা থেকে ২ মাইল দূরে অবস্থিত হেরা গুহার অভ্যন্তরে ধ্যান করা শুরু করেন।
সেখানেই অীবতীর্ণ শুরু হয় মানব মুক্তির মহা সনদ আল কুরআন। যে কিতাবের বিষয়বস্তু মানুষ এবং মানুষকে পরিশুদ্ধ করার বিধান ও দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে (নবী স.) প্রেরণ করা হয়।

কোয়ারেন্টাইন: যে ধারণার প্রবর্তন করেন রাসুল (স.)

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে কোয়ারেন্টাইন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এটি যেকোনো উপায়ে মানতেই হবে।
কিন্তু এই কোয়ারেন্টাইনের কথা সর্বপ্রথম যিনি বলেছিলেন তিনি হলেন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞ আলেমরা বিষয়টি হাদিসের প্রমাণসহ উল্লেখ করেছেন এবং বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন বিষয়টির স্বীকৃতি দেওয়া এক মার্কিন গবেষক।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা ও সংবাদভিত্তিক ম্যাগাজিন নিউজউইকের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়। প্রতিবেদনটি লিখেন মার্কিন গবেষক ড. ক্রেইগ কন্সিডাইন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অবস্থিত রাইস ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক। এছাড়া তিনি একজন আন্তর্জাতিক বক্তা।
মার্কিন গবেষক ড. ক্রেইগ কন্সিডাইন তার রিপোর্টে লিখেন, আপনারা কি জানেন মহামারির সময়ে সর্বপ্রথম কে এই সবচেয়ে ভালো কোয়ারেন্টাইনের উদ্ভাবন করেছেন?
আজ থেকে প্রায় ১৪শ বছর আগে ইসলাম ধর্মের নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.) পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোয়ারেন্টাইনের ধারণা দেন। যদিও তার সময়ে সংক্রামণ রোগের মতো কোনো বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। তারপরেও তিনি এসব রোগব্যাধিতে তার অনুসারীদের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা ছিল কভিড-১৯ এর মতো প্রাণঘাতী রোগ মোকাবেলায় দুর্দান্ত পরামর্শ। তার সেই পরামর্শ মানলেই করোনার মতো যেকোনো মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
এর উদাহরণ হিসেবে মার্কিন গবেষক মোহাম্মাদ (সা.)-এর একটি হাদীস উল্লেখ করেন। তিনি লিখেন- ‘মোহাম্মাদ বলেছেন, যখন তুমি কোনো ভূখণ্ডে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার খবর শুনতে পাও তখন সেখানে প্রবেশ করো না। পক্ষান্তরে প্লেগ যদি তোমার অবস্থানস্থল পর্যন্ত পৌঁছে যায় তাহলে ওই জায়গা ত্যাগ কোরো না।’
তিনি আরও বলেছেন, যারা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছে তাদের সুস্থ মানুষ থেকে দূরে থাকতে হবে।’
এভাবে বিভিন্ন সময়ে মানব জাতিকে সংক্রামণ থেকে রক্ষা করতে মোহাম্মাদ (সা.) রোগব্যাধিতে আক্রান্ত লোকদের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও উদ্বুদ্ধ করতেন।

সিরিয়ার প্লেগ এবং হযরত আবু উবায়দা (রা.) এর কোয়ারেন্টাইন

রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিরিয়াতে প্লেগ দেখা দিল। যে শহরে প্লেগ দেখা দিয়েছিল সেখানে আবু উবায়দা তখন কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন।
এবং তিনি প্রথম কোয়ারেন্টাইন পালনকারী সাহাবী এবং তার সাথে যে সৈন্যদল ছিল কেউই ওখান থেকে বেরিয়ে আসে নাই।

কোয়ারেন্টাইন হতে পারে চমৎকার উপলব্ধির পথ

যে কাজের নির্দেশ রসুলুল্লাহ (স) দিয়েছেন সেটা পালন করা, অনুসরণ করা কতটা পুণ্যের, কতটা সওয়াবের, কতটা উপকারি!অতএব কেউ যখন কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন, তিনি আল্লাহর রসুলের একটা নির্দেশ পালন করার সুযোগ পাচ্ছেন, সৌভাগ্যবান হচ্ছেন- এই আনন্দিতচিত্তে কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন।
এবং এই কোয়ারেন্টাইন ব্যক্তির জীবনে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হতে পারে। সেটা হোম-কোয়ারেন্টাইন হোক অথবা ক্যাম্প-কোয়ারেন্টাইন হোক বা হসপিটাল-কোয়ারেন্টাইন হোক।
যে কেউ এই সময়টা নিজের মতো করে, নিজের আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্যে, নিজের মনের পরিশুদ্ধির জন্যে, মননের পরিশুদ্ধির জন্যে, সৃজনশীলতার পরিশুদ্ধির জন্যে এবং ব্রেনটাকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানোর জন্যে এই সময়টা ব্যয় করতে পারেন।
ইয়োগা, মেডিটেশন, কোয়ারেন্টাইন ও ধর্ম
সুস্থ দেহ-মনের জন্যে কত কিছুই না করি আমরা। পেশিবহুল দেহের জন্যে ব্যায়াম করি। স্টেমিনা বৃদ্ধির জন্যে দৌড়-সাঁতার ইত্যাদি নিয়মিত করেন অনেকে। ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম, নাচের ক্লাস ইত্যাদি নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। অনেকের জীবনে প্রতিদিনের অন্যতম জরুরি কাজের একটি ‘ইয়োগা’।
মেডিটেশন হচ্ছে মনের ব্যায়াম। নীরবে বসে সুনির্দিষ্ট অনুশীলন বাড়ায় মনোযোগ, সচেতনতা ও সৃজনশীলতা। মনের জট যায় খুলে। সৃষ্টি হয় আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। হতাশা ও নেতিবাচকতা দূর হয়। মেডিটেশন হলো সচেতনভাবে দেহ মন এবং মস্তিষ্ককে শিথিল করার আধুনিক বৈজ্ঞানিক এবং সহজ প্রক্রিয়া।
মেডিটেশন বিশ্বাসীরা মনে করেন, মনোদৈহিক ৭৫ ভাগ রোগের কারণই টেনশন। তাই মেডিটেশন করলে অনায়াসেই শতকরা ৭৫ ভাগ মনোদৈহিক রোগ যেমন মাইগ্রেন, সাইনুসাইটিস, ঘাড়ে-পিঠে-কোমরে বা শরীরের যেকোনো স্থানে দীর্ঘদিনের ব্যথা, হজমের সমস্যা, আইবিএস, এসিডিটি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, অনিদ্রা প্রভৃতি রোগগুলো থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।
সফলতা, রোগ প্রতিরোধ, মানসিক ও শারীরিক উন্নতির জন্য যেমন মেডিটেশন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই বিশ্বাসীদের কাছে মেডিটেশন সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়া ও তার থেকে কিছু আদায় করারও মাধ্যম। মুসলিম সাধক, সুফী, দরবেশ ওলী আওলিয়ারা পর্যন্ত মেডিটেশন করেছেন।
মুসলিমদের মেডিটেশন পদ্ধতি রাসুল (সা.) ১৪০০ বছর আগে হেরা গুহায় করে দেখিয়ে গেছেন। তিনি একাগ্রতার সঙ্গে আল্লাহ পাকের ধ্যানে মগ্ন থাকতেন।
কবরে শুয়ে কোয়ারেন্টাইনের উদ্দেশ্য
অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে একেকজন একেক পন্থা অবলম্বন করেন। কেউ বেড়াতে যান, কেউ ইয়োগা করেন আর কেউবা শরণাপন্ন হন চিকিৎসকের। তবে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে অভিনব পরামর্শ দিয়েছিল নেদারল্যান্ডসের র‍্যাডবউড বিশ্ববিদ্যালয়। মানসিক চাপ কমাতে শিক্ষার্থীদেরকে “গ্রেভ থেরাপি” বা কবরে শুয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছে তারা।
কবরের মতো বড় গর্তে শুয়ে থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি পেজ রয়েছে। সেখানে এই পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। কর্তৃপক্ষ জায়গায়টিকে “পিউরিফিকেশন গ্রেভ” বা “শুদ্ধিকরণ” কবর হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
আত্মশুদ্ধিই শেষ কথা
করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্বে এই সময়ে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে ধ্যানমগ্ন হওয়া ও সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য চাওয়া। আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ সময় চলছে।
যারা সনাতন ধর্মাবলম্বী রয়েছেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রয়েছেন, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী রয়েছেন- তারা তাদের একাগ্র নিমগ্ন প্রার্থনায় ডুবে গিয়ে একটা নতুন মাত্রা নিয়ে আসতে পারেন।
সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ আর আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে অর্জন হতে পারে সফল কোয়ারেন্টাইন।
লেখক: আমিনুল ইসলাম শান্ত

Previous articleহেমাটোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান করোনায় মারা গেলেন
Next articleপ্রকৃতি যেভাবে মন ভালো করতে ভূমিকা রাখে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here