হাইপোম্যানিক, ম্যানিক এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডার

0
36

ডা. মো. আব্দুল মতিন
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মানসিক রোগ বিভাগ
রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

বাইপোলার ডিসঅর্ডার আবেগের অনিয়ন্ত্রিত উঠানামা জনিত একটি রোগ যার একপ্রান্তে থাকে ম্যানিয়া এবং অপর প্রান্তে থাকে ডিপ্রেশন। মুড বা আবেগ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্যক্তির এনার্জি, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা ও আচরণে যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে তা হলো বাইপোলার ম্যানিক এপিসোড, আবার মুড বা আবেগ অতিমাত্রায় কমে যাওয়ার ফলে তার এনার্জি, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা ও আচরণে যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে তা হলো বাইপোলার ডিপ্রেসিভ এপিসোড।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের প্রকারভেদ

উপসর্গের ধরন, তীব্রতা, উপসর্গের উপস্থিতির সময়কাল এবং ভালো হয়ে যাওয়ার পর কত ঘন ঘন রিলাপ্স হয় তার উপর ভিত্তি করে এটাকে কয়েকভাবে ভাগ করা হয়েছে, যেমন-

  • মেজর ডিপ্রেসিভ এপিসোড
  • ম্যানিক এপিসোড
  • হাইপোম্যানিক এপিসোড
  • মিক্সড এপিসোড
  • র‍্যাপিড সাইক্লিং

আবার উপসর্গের তীব্রতা দৈনন্দিন কাজকর্মের উপর তার প্রভাব অনুযায়ী এগুলোকে মৃদু, মাঝারি ও তীব্র উপভাগে বিভক্ত করা হয়। তাছাড়া বাইপোলার ডিসঅর্ডারের বিভিন্ন এপিসোড সাইকোটিক ফিচারসহ বা সাইকোটিক ফিচার বাদে বা কখনও ক্যাটাটোনিক উপসর্গ নিয়েও আসতে পারে। বাচ্চা প্রসবের পরেও বাইপোলার ডিসঅর্ডার হতে পারে (পোস্টপারটাম অনসেট)।

রোগীর জীবন দশায় যদি কখনও ম্যানিক এপিসোড না হয় অথচ বার বার ডিপ্রেশন বা হাইপোম্যানিক এপিসোড নিয়ে প্রেজেন্ট করে তাহলে তাকে বাইপোলার ২ ডিসঅর্ডার বলে আবার যদি তার লাইফটাইমে কখনও একবার ম্যানিক এপিসোড হয়ে থাকে তবে সেটাকে বাইপোলার ১ ডিসঅর্ডার বলে। আর যদি ডিপ্রেশন বা হাইপোম্যানিক এপিসোড দীর্ঘমেয়াদী ভাবে ২ বছরের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে ও কখনও ম্যানিক এপিসোড না হয় এবং কমপক্ষে ২ মাসের বেশি সময় ধরে  ডিপ্রেশন বা হাইপোম্যানিক উপসর্গ অনুপস্থিত না থাকে তবে তাকে সাইক্লোথাইমিক ডিসঅর্ডার বলে। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতির কিছু পার্থক্যের জন্য এসব বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকাটা আবশ্যক।

এপিসোড বিন্যাস কেমন হয়

সাধারণ মানুষের মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের হার প্রায় ০.৪% এবং ১৭-২১ বছর বয়স্কদের মধ্যে এই রোগ বেশি হয়। সাধারণত ৬০-৭০% ক্ষেত্রে বাইপোলার ডিসঅর্ডার ডিপ্রেসিভ এপিসোড দিয়ে শুরু হয় এবং পরবর্তীতে ম্যানিক বা হাইপোম্যানিক এপিসোড হয়ে থাকে। বাইপোলার ১ ডিসঅর্ডার ও সাইক্লোথাইমিক ডিসঅর্ডারের হার ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে সমান হয়ে থাকে। বাইপোলার ২ ডিসঅর্ডারের হার মেয়েদের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি। ম্যানিক এপিসোড ছেলেদের বেশি হয় এবং ডিপ্রেসিভ ও র‍্যাপিড সাইক্লিং মেয়েদের বেশি হয়।

ম্যানিয়ার উপসর্গ

ডিএসএম-৫ অনুসারে নির্ধারিত উপসর্গের মধ্যে কমপক্ষে ৪ টি বা তারও বেশি উপসর্গ ৭ দিন বা তার বেশি সময় ধরে উপস্থিত থাকে ও সেই সাথে মুড অতিমাত্রায় বেশি ও খিটখিটে থাকে এবং উক্ত সমস্যার কারণে ব্যক্তি তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে অসমর্থ হলে তা ম্যানিক এপিসোড । উল্লেখ্য উপরোক্ত সমস্যার কারণে যদি রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে সময়কাল ৭ দিন বিবেচ্য হবে না, ৭ দিনের কম হলেও চলবে। উপসর্গসমূহ-

  • অতিমাত্রায় কথা বলা
  • নিজের শক্তি-সামর্থ্য, বুদ্ধিমত্তা ও মেধা নিয়ে আত্ববিশ্বাস বাস্তবের তুলনায় অধিক হওয়া
  • ঘুমের প্রয়োজন অনুভব না করা
  • সারাক্ষন অস্থির বা চঞ্চল থাকা
  • মাথায় বেশি বেশি চিন্তা আসা এবং দ্রুত টপিক পরিবর্তন করা
  • বেশি সময় মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, সামান্যতেই মনোযোগ অন্যদিকে স্থানান্তরিত হওয়া
  • তার চিন্তার সাথে সামজস্যপূর্ণ কাজকর্ম অনেক গুন বেড়ে যাওয়া
  • কোন কাজ শুরুর পর অসমাপ্ত রেখেই অন্য কাজে যাওয়া ও ফলশ্রুতুতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া

হাইপো ম্যানিয়ার উপসর্গ

ম্যানিয়ার মতো হাইপোম্যানিয়াতেও একই রকম উপসর্গ থাকে তবে সমস্যাগুলোর তীব্রতা অনেক কম থাকে। হাইপোম্যনিয়া নিয়ে রোগী টুকটাক কাজকর্ম করতে পারে, হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না, কখনও সাইকোটিক উপস্থিত থাকে না এবং উপসর্গের মেয়াদ কমপক্ষে ৪ দিন হতে হবে।

বাইপোলার ডিপ্রেশনের উপসর্গ

বাইপোলার ডিপ্রেশনে ইউনিপোলার বা মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের মতোই সবসময় মন খারাপ, কিছু ভালো না লাগা, ঘুমের সমস্যা, খাবারে অনীহা, সামান্যতেই ক্লান্তিবোধ, সারাক্ষন চুপচাপ শুয়ে থাকা, নিজেকে অর্থহীন মনে হওয়া, আত্ববিশ্বাস কমে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে থাকা, চিন্তা করার সামর্থ্য কমে যাওয়া ও কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা, সিদ্ধান্তহীনতা, অপরাধবোধে ভোগা ও আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসা ইত্যাদি সবকিছু সমস্যা থাকতে পারে। তবে যদি ডিপ্রেসিভ এপিসোডের আগে বা পরে কখনও ম্যানিক বা হাইপোম্যানিক এপিসোড হয় তাহলে সেটা হবে বাইপোলার ডিপ্রেশন আর যদি পুনরায় পুনরায় ডিপ্রেসিভ এপিসোডের ইতিহাস থাকে এবং কখনও ম্যানিক বা হাইপোম্যানিক এপিসোডের ইতিহাস না থাকে তাহলে তা ইউনিপোলার ডিপ্রেশন। তবে পূর্বে কখনও ম্যানিক বা হাইপোম্যানিক এপিসোডের ইতিহাস না থাকলে প্রথম এপিসোড ডিপ্রেশন নিয়ে আসলে এটা ইউনিপোলার না বাইপোলার তা বুঝতে কিছুটা সমস্যা হয়। তাই রোগের ইতিহাস, এপিসোডের স্থায়িত্বকাল, উপসর্গের উপস্থিতি ধীরে ধীরে না দ্রুত, আগের এপিসোড কি ছিল, কোন লাইফ স্ট্রেসের কারণে কিনা, আগের চিকিৎসার ইতিহাস বিস্তারিত ভাবে জানতে হবে।

মিক্সড এপিসোড ও র‍্যাপিড সাইক্লিং

৩০-৪০% ক্ষেত্রে বাইপোলার রোগী মিশ্র উপসর্গ নিয়ে আসতে পারে যার কিছু ম্যানিয়া আর কিছু ডিপ্রেশনের উপসর্গ একই সাথে থাকে এবং ৫-১৫% বাইপোলার ডিসঅর্ডারের রোগীর র‍্যাপিড সাইক্লিং হতে পারে। যদি ১ বছর সময়ের মধ্যে ৪ টি বা তার বেশি এপিসোড হয় তাহলে সেটাকে র‍্যাপিড সাইক্লিং বলে। এপিসোড গুলো ম্যানিক, হাইপোম্যানিক, ডিপ্রেসিভ এর যেকোনো টি হতে পারে। তবে দুটি এপিসোডের মাঝে কমপক্ষে ২ মাস স্বাভাবিক অবস্থা থাকতে হবে অথবা এক প্রকার এপিসোড থেকে অন্য প্রকারে রুপান্তরিত হতে হবে।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কারণ

অনেকেই এসব রোগকে জিন ভুতের আছর বা পাপের ফল বলে ভুল করে থাকেন। আসলে তা সঠিক নয়। এই রোগের অনেক কারনের মধ্যে জেনেটিক লিংক একটি অন্যতম কারণ। যাদের বাইপোলার ডিসঅর্ডার আছে তাদের নিকট আত্মীয়দের মাঝে এই রোগের হার প্রায় দ্বিগুণ। নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের জন্যও এই রোগ হতে থাকে। মস্তিস্কে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমান বেড়ে গেলে ম্যানিয়া ও সাইকোসিস হয় এবং সেরোটোনিন ও নরএপিনেফ্রিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমান কমে গেলে ডিপ্রেশন হয়। আবার অতিরিক্ত মানসিক স্ট্রেস থেকেও এটা হতে পারে যেমন আর্থিক কষ্ট, পারিবারিক সাপোর্ট না থাকা, বুলিং এর শিকার হওয়া, শারীরিক ও সেক্সুয়াল হয়রানির শিকার হওয়া, লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়া, ব্যবসায়িক লোকসান হওয়া ইত্যাদি। মস্তিষ্কের কিছু অংশে যেমন লিম্বিক সিস্টেম, এমিগডালা, ও বাজ্যাল গাংলিয়ার কার্যকারিতার অসামজস্যতা, হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-আড্রেনাল গ্রন্থির ফিডব্যাক সিস্টেম অকেজো হওয়া ইত্যাদি নানাবিধ কারণও বাইপোলার ডিসঅর্ডারের জন্য দায়ী।

চিকিৎসার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জসমূহ

অনেক সময় বাইপোলার রোগীদের এই রোগের সাথে এঞ্জাইটি ডিসঅর্ডার, শুচিবায়, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার,    শারীরিক রোগ ও মাদকের গ্রহণের সমস্যা থাকে যা তার রোগ নিরাময়কে বাধাগ্রস্ত করে। আবার রোগ সম্পর্কে রোগীর অন্তদৃষ্টি না থাকায় তারা মনে করে তাদের কোন সমস্যা নেই, ফলে ওষুধ সেবন করতে চায় না। তাছাড়া ইম্পালসিভ বিহেভিয়ারের কারণে কখনও নিজের বা অন্যের ক্ষতি করতে পারে বা আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে অথবা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, ফলে চিকিৎসা প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। তাই রোগের সঠিক ইতিহাস জানাটা খুবই জরুরী। কোন স্ট্রেস আছে কিনা, অন্য কোন শারীরিক ও মানসিক রোগের উপস্থিতি কিনা, রোগীর চাপ সামলানোর কৌশল ও সামর্থ্য, পারিবারিক সাপোর্ট, পরিবারের সদস্যদের রোগের ইতিহাস ভালো করে জানতে হবে।

রোগের চিকিৎসা

প্রায় ৯০% রোগীর রোগ সেরে যাওয়ার পর কিছু দিন বাদে পুনরায় রোগটি হওয়ার হতে পারে। একটি এপিসোড সাধারণত ৩-৬ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে রোগ যত দীর্ঘমেয়াদী হয় তত এপিসোডের মেয়াদকাল বাড়তে থাকে এবং দুই এপিসোডের মধ্যকার সময় কমতে থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রেও এই রোগ হতে থাকে। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ১৫% বাইপোলার ১ রোগী চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়, ৪৫% সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার পরও বার বার রিলাপ্স হয়, ৩০% রোগী আংশিক ভালো হয় এবং ১০% রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসা দিয়েও ভালো ফল পাওয়া যায় না। এই রোগের চিকিৎসায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ-

১। রোগী ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে রোগের ধরন, তীব্রতা, চিকিৎসা পদ্ধতি, আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতে হবে।

২। রোগী ও তার পরিবারের লোকজনকে আশ্বস্ত করতে হবে। নিয়মিত ওষুধ সেবনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পরেও অনেক দিন যাবৎ ওষুধ সেবন করতে হয়। তাই পরিবারের সদস্যদের ও রোগীকে বলতে হবে যেন চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত ওষুধ সেবন বন্ধ না করে।

৩। অনেকে ভ্রান্ত ধারনার কারণে কবিরাজি, তাবিজ, কবজ, পানিপড়া ইত্যাদি অপচিকিৎসার শরণাপন্ন হয়, ফলে রোগ আরোগ্য হওয়ার পরিবর্তে আরও জটিল হয়ে যায়। তাই রোগীরা যাতে অপচিকিৎসার পিছনে না ছুটে চিকিৎসকের নিকট হতে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা গ্রহণ করে সে ব্যাপারে তাদেরকে সচেতন করতে হবে।

৪। এই রোগের চিকিৎসায় মুড স্টেবিলাইজার জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। সাইকোটিক উপসর্গ থাকলে এন্টিসাইকোটিক ওষুধও সাথে দেওয়া হয়। ঘুমের সমস্যার জন্য সেডেটিভ জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে।

৫। বিভিন্ন প্রকার এপিসোডের জন্য চিকিৎসায় কিছুটা ভিন্নতা আছে। আবার নানা প্রকার শারীরিক সমস্যা, গর্ভাবস্থা, শিশুদের ক্ষেত্রে ওষুধ নির্বাচন, ডোজের বেশ পার্থক্য আছে। তাই নির্ধারিত চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক ওষুধ সেবন ও নির্দেশিত পরামর্শ মেনে চলার মাধ্যমে এই রোগ হতে ভালো থাকা যায় বা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

 

 

 

Previous articleসামাজিক ভীতি বা সোশ্যাল ফোবিয়া
Next articleনবীন সাইকিয়াট্রিস্টদের সংবর্ধনা দিল বিএসএমএমইউয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here