কারণ যেটাই হোক, বাংলাদেশে এখনও স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের প্রচলন রয়েছে। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে স্ত্রীর মনে কি কষ্ট হতে পারে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তা বোঝার চেষ্টা হয় কী? আত্নীয়-স্বজন, সমাজ এবং স্বামী নিজেও কী এই কষ্টগুলোর মূল্যায়ণ করতে পারেন? স্ত্রীর অন্তরাত্মার কান্না ধ্বনি কী শুনতে পাই? সবাই খুব সহজ ভাষায় বলে বসি “মেনে নাও”। মেনে নেওয়া শব্দটি যেমন সহজ তেমনি এর ফলাফলও হয়তো ভালো (সবক্ষেত্রে নয়)। কিন্তু মেনে নেওয়ার কাজটি কতটা কঠিন তা যার উপর বর্তায় সে-ই বলতে পারে।
কেন একজন স্ত্রী, স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারেনা? তার সবচাইতে সহজ সূত্রটি হচ্ছে, নারী সবকিছু পারে, কেবল পারেনা স্বামীকে কারো সাথে অংশীদার করতে। নারী দূর্গার মতো। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, এত শক্তির অধিকারিণী এই একটা কাজ কেন পারেনা? তার উত্তর, আমার ধারণা প্রতিটি নারীই বলতে পারবে। কেউ বলবে স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, কেউ বলবে একান্ত মানুষটিকে হারিয়ে ফেলা, কেউ বলবে অধিকার নষ্ট হওয়া, আবার কেউ বলবে সামাজিক মর্যাদা হারানোর বিষয়টি। কেউ বা সন্তানদের সামনে পিতার মূল্যায়ন নষ্ট হবার কথা বলবেন। এক কথায় বলা যায়, সবগুলো বিষয়ই সঠিক; এবং এগুলো সম্মিলিত ভাবেই ঘটে একজন স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের ফলে।
দ্বিতীয় বিয়ে করার পেছনে স্বামীদের সর্বাধিক যে কারণটি বিদ্যমান তা হচ্ছে, স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য কোন নারীর প্রতি আসক্তি। এছাড়াও পালাক্রমে পরবর্তী কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রথম স্ত্রীর ঘরে সন্তান না হওয়া (সমস্যা স্ত্রীর বা নিজের যারই হোক), স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়া, পরিবার প্রথম স্ত্রীকে মেনে না নেয়া, স্ত্রী সমশ্রেণির না হওয়া, চাকরি বা কাজের খাতিরে স্ত্রী থেকে দূরবর্তী স্থানে বসবাস করা। অনেক ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীকে উচিৎ শিক্ষা কিংবা শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যেও স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে!
স্বামীরা প্রথম দিকে দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও বেশিদিন তা পেরে উঠে না। যারা বিত্তশালী তারা দুই স্ত্রীকে দুই সংসার দেন এবং দুই সংসারকেই যথেষ্ট পরিমান টাকা ঢেলে চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। নিম্ন শ্রেণিতে বসবাস করা স্বামী দুই স্ত্রীকে একই ঘরে রেখে দেন এবং এই বিষয়টিকে কোন লজ্জার, অসম্মানের কিংবা অসুবিধার মানতে রাজী নন। দিনের পর দিন দুই সতীনের মধ্যে ঝগড়া, মারামারি চলতে থাকলেও তাতে স্বামী ব্যক্তিটির কিছু আসে যায় না। তার দুজনকেই চাই।
প্রথম স্ত্রীকে ‘সর্বক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্থান, পদমর্যাদা বা অধিকার বজায় থাকবে’ এ ধরনের কথা বা প্রতিজ্ঞা দেয়া থাকলেও পরবর্তীতে স্বামী তা রক্ষা করে না বা করতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে দ্বিতীয় স্ত্রী সবক্ষেত্রে সামনের সারিতে এসে দাঁড়াতে শুরু করে।
আমাদের সমাজে স্বামীহীন থাকা অত্যন্ত দুরূহ। নিজের কোন সমস্যা হোক বা না হোক সমাজের মানুষ কোন নারীকে একা থাকতে দেখলেই উৎসুক হয়ে উঠে। যে কারণে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলা সত্ত্বেও প্রথম স্ত্রীর পরিবার সব মেনে নিয়ে সংসার করতে বলেন তাদের মেয়েকে। ভয়াবহ কষ্ট হয়, অসহ্য যন্ত্রণা হয়, বুক ফেটে কান্না আসে, নিজেকে বড় সামান্য অনুভব হয়, আত্মহত্যাও করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বেঁচে থাকতে হয় নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে। আত্মনির্ভরশীল নারী হয়তো একাই নিজের জীবনকে গুছিয়ে নেন এবং স্বামীর সাথে দেয়াল তুলে দেন, তালাক না নিলেও বিচ্ছেদ বা বিচ্ছিন্ন জীবনধারণ বেছে নেন। কেননা তারই চেনাজানা ভালোবাসার মানুষটি আরেকটি নারীর সাথে বসবাস করছে, আবার তার সাথে থাকতেও ঘরে আসছে। প্রচণ্ড ঘৃণা ও রাগে মন ফুঁসে উঠে। বিচ্ছিন্ন থাকলে অন্তত এই ঘৃণ্য জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়, নিজেকে আত্মগ্লানী থেকে বাঁচানো যায়। আর যে সকল নারী আত্মনির্ভরশীল নয়, দুর্বল মানসিকতার অধিকারী অথবা দরিদ্র বা আর্থিক দিক থেকে অপারগ তাদের স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে ও দ্বিতীয় স্ত্রীকে মেনে নিয়ে একই সাথে বসবাস করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকেনা। বেশিরভাগ পুরুষই এক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর মনের অবস্থা বোঝার বিষয়টি ভীষণভাবে অবজ্ঞা করে থাকেন। আবার নিজের দ্বিতীয় বিয়েকে “নবীর সুন্নত পালন” নামে জায়েজ করে নেবার ধৃষ্টতাও করেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পুরুষেরা কী কখনো তার প্রথম স্ত্রীর জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে একটি বার ভেবে দেখেছে তার কেমন লাগে? কী করতে ইচ্ছা করে? প্রথম স্ত্রীর আত্মগ্লানীতে ভরা জীবনের নীল কষ্টগুলোকে এই স্বামীরা কখনো কী অনুভব করতে পারে?
যদি প্রশ্ন করা হয় এই প্রথম স্ত্রী এমতাবস্থায় কি করবেন? ছোট করে বলি, অবশ্যই কাউন্সেলিংয়ে আসবেন, মনকে হালকা করবেন এবং যে যার পরিস্থিতি অনুযায়ী বুদ্ধিমত্তার সাথে চলার কায়দা জেনে নিন।
তামিমা তানজিন
কনসাল্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট
প্রত্যয় মেডিকেল ক্লিনিক
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।