এক.
অবশেষে মুন্নীদের (ছদ্মনাম) জীবনের সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষনটি চলে এলো। আজ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। সেই ছোট বেলা থেকে আজোব্দি মুন্নী তার মা, বাবা, ভাই, বোন,শিক্ষক সহ সবাই যেনো ক্ষন টির অপেক্ষায় ছিলো। তাদের সবার আজন্ম লালিত স্বপ্ন মুন্নী ডাক্তার হয়ে মানব সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করবে।
ক্লাস ওয়ান থেকে এইচ এস সি পর্যন্ত প্রতি ক্লাসেই মুন্নী হয় প্রথম না হয় দ্বিতীয়। শিক্ষক, আত্মীয় স্বজন সবাই তাই আদর করে বলতো, “আমাদের মুন্নী বড় হয়ে ডাক্তার হবে। সে আমাদের স্কুলের গ্রামের সবার মুখ উজ্জ্বল করবে”। কথা গুলো মুন্নীর হৃদয়ে গেঁথে যায় সেই ছোটবেলায় থেকে। এক সময় সেও স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হওয়ার। আর তাই সব সময় পড়াশোনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতো। চোখে মুখে স্বপ্ন লেগে থাকতো সাদা এপ্রোন পরে বসে আছে সে।। ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রে মুন্নীকে দিয়েই দরিদ্র মা-বাবা দুহাত জোড় করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন প্রার্থনায়। টানা দেড় ঘন্টা চুপচাপ ওভাবেই তারা পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে সজল নয়নে ছিলেন। বিড় বিড় করে বললেন “হে প্রভু তোমার নামে আমাদের মেয়েকে মানব সেবায় সমর্পণ করলাম। তুমি কবুল করো..”।
পরীক্ষার হল থেকে হাসুখুশি মনেই বের হলো মুন্নী। তার আত্মবিশ্বাস, এবার সে চান্স পাবে। সে মেডিকেল কোচিং করেছিলো। সেখানে মডেল টেস্ট গুলোতে সে বরাবর ফার্স্ট হতো। সে হিসাবে এবারের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নগুলো তার কাছে তেমন কঠিন মনে হয়নি। কোচিং এর পরিচালক স্যার কাছে এসে বললেন, শুনেছি প্রশ্ন সহজ হয়েছে। অনেক গুলো রিপিট ও হয়েছে। মুন্নী তুমি আমাদের ফার্স্ট গার্ল। সো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে মেডিকেলে চান্স পাবে, হয়তো ঢাকা মেডিকেলে ও চান্স পেয়ে যেতে পারে। পরীক্ষা শেষে মুন্নী তার কয়েকজন বান্ধবী, কোচিং এর স্যার, স্কুলের একজন শিক্ষক সহ সবাই মিলে একটা রেস্ট্ররেন্টে দুপুরের খাবার খেলেন। মুন্নীর বাবা দারুন খুশী আদরের মামনীর ভর্তি পরীক্ষা ভালো হয়েছে। একজন আদর্শ চিকিৎসকের বাবা হতে যাচ্ছেন তিনি, বার বার এটা ভেবে তিনি পুলকিত হচ্ছেন।
দুই.
রেস্ট্রুরেন্ট থেকে বের হয়ে ফেরার পথে তারা কিছু একটা কানাঘুষা শুনলেন। রাতে নাকি মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। পরিচিত অনেকে লাখ লাখ টাকা দিয়ে ফটোকপির দোকান থেকে সেগুলো কিনেছেন। মুন্নীরা কেউ এটা গায়ে মাখলেন না। মুন্নীর টিচার বলেই বসলেন, প্রশ্ন যদিও ফাঁস হয়, তবুও আমাদের মুন্নী মেডিকেলে চান্স পাবেই। ওর জন্যে আমাদের আজীবন আর্শীবাদ। আমাদের এতোদিনের আর্শীবাদ প্রভু কখনই ফিরিয়ে দেবেন না। এতোটা নির্দয় তিনি নন।
ফল প্রকাশের আগের দিন গুলো খুব দুশ্চিন্তায় কাটলো মুন্নীর বাবার। পত্রিকা, টেলিভিশন সব খানে প্রশ্ন পত্র ফাঁস নিয়ে সংবাদ আর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি তর্ক চলছিলো। মুন্নীর বাবা হাটের একটা দোকানে বসে রোজ সেগুলোতে চোখ রাখতেন। তার মনে অজানা শংকা ভর করতে লাগলো। তবুও তিনি আত্মবিশ্বাসী। মুন্নী মেডিকেলে চান্স পাবে। কারণ মুন্নীকে তিনি বিধাতার হাতে সঁপে দিয়েছেন সেই ছেলে বেলা থেকে। পরের ৭ /৮ টা দিন যেনো ৭/৮ বছর লাগলো তার কাছে। প্রশ্ন ফাঁস, আন্দোলন এসব কিছু তিন বাড়ি ফিরে মুন্নীকে আর বলতেন না। মেয়েটি ভয় পাবে।
ফল প্রকাশের দিন সাত সকালে মেডিকেল কলেজে গিয়ে হাজির যেখানে সে কেন্দ্রে মুন্নীর ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে। তার কোচিং শিক্ষকরাও সেখানে। আরো অনেক অভিভাবক এসছেন। অবশেষে বিকেলে রেজাল্ট প্রকাশিত হলো।
তিন.
বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়। বাবার অপেক্ষায় অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়ে মুন্নী। বাবার পায়ের শব্দে মুন্নীর ঘুম ভাঙে। বাবার হাতে চমৎকার একটা পুতুল সেটা। এ রকম পুতুল সেটের প্রতি মুন্নীর আজীবন আগ্রহ । অনেক দামী বলে দরিদ্র বাবার কাছে মুখ ফুটে বলেনি সে। না চাইতেই আজ বাবার হাতে পুতুল দেখে মুন্নী বুঝলো নিশ্চিত তার সুসংবাদ আর সেটার জন্যেই পুরষ্কার নিয়ে এসছেন বাবা। খুশিতে ‘বাবা’ বলে চিৎকার দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ‘বাবা আমি জানতাম তুমি আজ আমার জন্যে এ পুতুল সেটটিই কিনবেই’। বাবা ও মেয়ে জড়াজড়ি করে অভাবেই কাঁদলেন কিছুক্ষণ।
মুন্নী কাঁদছে সে সবার স্বপ্ন পুরণ করতে পেরেছে আর বাবা কাঁদছেন তাদের আজীবন লালিত স্বপ্ন আজ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। “মা’রে আর কাঁদিস না। শোন, তুই মানব সেবা করবি আজীবন সেই আশা নিয়েই পড়াশোনা করেছিস। তুই মানব সেবাই করবি। কেবল ডাক্তারী করেই কি মানব সেবা হয়? আরো কত কিছু পেশা আছে যা দিয়ে ঢের মানব সেবা করা যায়”। মুন্নী থমকে যায় বাবার কথায়। বাবার চোখের দিকে তাকায়। তার চোখ দুটো লাল। চোখের জলে শার্টটা ভেজা। “কি বললে বাবা?” ধরা গলায় তিনি বললেন, “মা তোর মেডিকেলে হয়নি। প্রশ্নপত্র নাকি ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে ঢাকায় আন্দোলন হচ্ছে। আবার নাকি পরীক্ষা হবে। থাক মা ওসব। বাদ দে। আর দরকার নেই তোর ডাক্তার হবার। তুই ভার্সিটিতে ভর্তি হবি। জজ ব্যারিস্টার হয়ে মানব সেবা করবি…”।
সেদিন থেকে বাবা মেয়ের আর কোন কথা হয় না। হয়না স্বপ্ন বিনিময়। পরের কয়েকটা দিন মুন্নী তার মা, বাবা, ভাই, বোন কেউই আর ঘর থেকে খুব একটা বের হতেন না। সবার চোখ থাকতো ভেজা। মুন্নী ভার্সিটিতে পরীক্ষা দেয়। ভালো একটা সাবজেক্টে চান্স পায়। কিন্তু কি কারণে আর ভর্তি হয়নি। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ঐ বছরই তার বাবা মারা যান। মুন্নীরও বিয়ে হয়ে যায়।
প্রতিবছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা আসে আর যায়। এ, ও চান্স পায়। মুন্নীর কানে সেসব খবর আসে। মুন্নী ড্রয়ার থেকে সাদা এপ্রোন পরা কয়েকটা ছোট পুতুল বের করে বুকে চেপে ধরে চুপচাপ কাঁদে। এই প্রিয় পুতুল সেট গুলো তার বাবার দেয়া যেদিন তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। বিয়ের পর থেকে ওগুলো তার কাছেই, ড্রয়ারে। কয়েকটা এপ্রোন বানিয়ে পুতুল গুলোকে সে পরিয়ে রেখেছে । ধবধবে সাদা সে এপ্রোন গুলো। এপ্রোন পরিহিত মেয়ে ডাক্তার দেখলে সে আনমনা হয়ে যায়। চোখে জল আসে। বিড় বিড় করে বিধাতাকে বলে, “হে বিধাতা, যারা আমার, আমার বাবা মায়ের স্বপ্ন’কে ভেঙ্গেছে তাদের বিচার তুমি করো, ইহকালে না হয় পরকালে”।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন