অতিচঞ্চল/অমনোযোগী শিশু নিয়ে অনেক মা-বাবা উদ্বিগ্ন থাকেন। অনেক সময় শিশু এতো চঞ্চল/অমনোযোগী থাকেন যে, তাকে ম্যানেজ করতে গিয়ে মা-বাবা হিমশিম খেয়ে যান। হতাশ হয়ে পড়েন।
ADHD শিশুর একটি বিকাশগত সমস্যা। কখনও কখনও তা শিশুকাল থেকে শুরু করে বয়স্ক কাল পর্যন্ত চলতে পারে। ADHD এর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ২-১১% শিশু এই সমস্যায় ভুগে। অভিভাবকের সচেতনতা, নির্ণয়ের সঠিকতা এবং অন্যান্য কারণে ADHD এর হার অনেক বেশী বলে পরিলক্ষিত হয়। ২০০৩ থেকে ২০১৭ সালে ADHD এর হার শতকরা ৭ থেকে ১১তে উন্নীত হয়েছে। ছেলেদের মধ্যে ADHD এর হার অনেক মেয়েদের চেয়ে নয় গুণ বেশী।
ADHD এর কারণ সঠিক ভাবে এবং নির্দিষ্ট করে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে সম্ভাব্য কারণগুলো হলো-
ক. বংশগতি- বংশ পরম্পরার এই সমস্যা চলে আসতে পারে।
খ. মস্তিষ্কের কিছু কিছু অংশে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত হওয়া।
গ. ব্রেইনে কেমিক্যালের ব্যতয়/অসংগতি
ঘ. অন্যান্য কারণ-
- সীসা বা অন্যান্য বিষ এর ভ্রুণের উপর প্রভাব
- অকালপক্ক জন্মানো শিশু
- জন্মের সময় বা জন্মের পূর্বে ব্রেইনের আঘাত জনিত কোন সমস্যা
- ভ্রুণ/শিশুর ব্রেইনের পরিপক্কতায় ব্যাঘাত ঘটে
- খাবারে রঙ বা প্রিজারভেটিভ দেওয়া
- অতিরিক্ত চিনি
- আবেগগত বিয়োগ বেদনা
- শিশুর আবেগের ব্যাঘাত
কি করে বুঝবেন আপনার শিশু ADHD তে ভুগছে?
মূলত ADHDর তিনটি লক্ষণ সুস্পষ্ট
- অমনোযোগীতা
- অতিচঞ্চল
- আবেগতাড়িত
অমনোযোগীতা এর লক্ষণ সমূহ-
- স্কুলে অসাবধান/উদাসীনভাবে ভূল করে বা সঠিক মনোযোগ দিতে পারেনা
- খেলা, পড়া-শুনা, অন্য কিছুতে মনোযোগ বা আগ্রহ ধরে রাখতে পারেনা। বললেও শুনেনা বা সাড়া দেয়না।
- সরাসরি তাকে উদ্দেশ্য করে ডাকলে নির্দেশ পালন করে না বা কাজ সম্পন্ন করে না।
- কাজ সংগঠন করায় সমস্যা করে
- যে সমস্ত কাজে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন তা এড়িয়ে চলে
- স্কুলে বা অন্য জায়গায় প্রায়শ জিনিস হারিয়ে ফেলে (বই, খাতা, পেন্সিল, রঙ বাক্স ইত্যাদি)
- সামান্য শব্দ বা সামান্য কিছুতেই মনোযোগে ব্যাঘাৎ ঘটে
- প্রতিদিনের কাজে উদাসীন বা অমনোযোগী।
অতিচঞ্চল ও আবেগতাড়িত এর লক্ষণসমূহ-
- সিটে বসতে অস্বস্তি, হাত পায়ে উশখুশ করা/ছটফটানি
- ক্লাসরুমে সিটে বসে না
- দৌড়ে বেড়ায়, চষে বেড়ায়
- চুপচাপ বসে বিশ্রাম নিতে পারে না
- চলার উপরে থাকে
- অনেক সময় বেশী কথা বলে
- ক্লাসে প্রশ্ন শোনার আগেই দাঁড়িয়ে পড়ে
- নিজের পালা আসার পূর্বেই তা করতে চায়
- লাইনে দাঁড়ানোর ধৈর্য থাকে না
- অন্যদের কথায় নাক গলায়
- অন্যের কথার মাঝ খানে ঢুকে পড়ে ইত্যাদি।
পিতা-মাতার করণীয়
পিতা-মাতার পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব যা দিয়ে ADHD এর সমস্যায় সাহায্য করতে পারেন।
- সঠিক খাবার খাওয়ানো
- ব্যায়াম করানো
- সুন্দর ঘুম
- মানসিক চাপ কমানো
- সামনা-সামনি সহযোগিতা দেওয়া
- রুটিন করে শিশুকে চালানো
- প্রয়োজনীয় কাজে মনোনিবেশের চেষ্টা করানো
- আপনার চাওয়া শিশুকে বুঝিয়ে বলা
- বন্ধুত্ব তৈরীতে সাহায্য করা
পিতা-মাতা হওয়া পৃথিবীর একটি কঠিন কাজ। আর অতিচঞ্চল শিশুর পিতা-মাতা হওয়া কঠিনতর ও চ্যালেঞ্জিং। ADHD শিশুর অস্বাভাবিক, অপ্রয়োজনীয়, অনাকাংখিত আচরণ কমাতে বা পরিবর্তনে আপনিও গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব পালন করতে পারেন। একটি কথা মনে রাখবেন- যে শিশু অপ্রয়োজনীয় ও খারাপ কিছু শিখতে বা লিখতে পারে, সেই শিশু অবশ্যই ভাল ও প্রয়োজনীয় কাজটিও শিখতে পারবে।
আচরণ পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় কিছু টিপস-
- সকল ভাল কাজকে প্রশংসিত বা পুরস্কার দিতে পারেন। এই পুরষ্কার হতে পারে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, আদর করে দেওয়া, চুমু দেওয়া, বুকে-কোলে তুলে নেওয়া, হতে পারে একটি খেলনা, একটি লজেন্স পুরষ্কার ইত্যাদি। হতে পারে তাকে নিয়ে খেলা করা, একটি গল্প শুনানো (টাকা পয়সা ইত্যাদি না দেওয়াই ভাল)।
- পুরষ্কার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়াই ভাল। মনে রাখবেন ভাল কাজে প্রশংসা করলে, উৎসাহিত করলে পরবর্তীতে ভাল কাজে শিশুর আগ্রহ বাড়বে।
- শিশুর অপ্রয়োজনীয় বা অঘ্রহণযোগ্য কাজে মনোযোগ দেবেন না, ভ্রুক্ষেপ করবেন না। এ ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করবেন না, তাতে করে সে নিরুৎসাহিত হবে।
- শিশুকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেবেন, তবে নির্দেশনায় হতে হবে স্পষ্ট, প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক।
- অপ্রাসঙ্গিক, দিক নির্দেশনা দেওয়া ঠিক নয়, তাতে ভালোর চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশী থাকে।
- বিপজ্জনক এবং বারবার নিষেধ সত্ত্বেও না শুনলে টাইম আউট এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
টাইম আউট
টাইম আউট বলতে গেলে এক প্রকারের শাস্তি। কিন্তু এতে কখনো শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়না।
টাইম আউটের বৈশিষ্ট্য-
- শিশুকে বাসার এক কোণে কোনো রুমে (যেখানে খেলনা থাকবে না, পানি-পাখা থাকবে না, টিভি রেডিও থাকবে না) বসিয়ে রাখতে হবে। তার পূর্বে তাকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন তার জন্য এই শাস্তি।
- এই সময়ে কেউ তার সাথে কথা বলবেন না।
- শিশুকে জেরা করবেন না।
- সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মাফ করে দেবেন না।
- তার পীড়াপীড়ি, চিৎকার ও চেঁচামেচি এড়িয়ে যাবেন।
- তাকে বুঝিয়ে বলবেন যেন সময়ের পূর্বে স্থান ত্যাগ না করে।
শারীরিক কোন শাস্তি মোতেই কাম্য নয়, গ্রহণ যোগ্য নয় এবং তা কখনো করবেন না।
শারীরিক শাস্তি-
- শিশুকে বিদ্রোহী করে তোলে
- পিতা-মাতার প্রতি বীতশ্রুদ্ধ করে
- শিশু পিতা- মাতার উপর শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে
- যে কোন শাস্তি ভূলটি বুঝায় কিন্তু সমাধানের বা ভাল হওয়ার পথটি দেখায় না।
লিখেছেন- অধ্যাপক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আজিজুল ইসলাম
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে
