“ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে” শিক্ষাজীবনে এই ভাবসম্প্রসারণ কে কে শিখেছেন? অনেকেই হাত তুললেন তো! আসলেই কুঁড়ির মতো একটি শিশুকে ফুটিয়ে তোলা, বড়ো করা, জাগিয়ে তোলা কতই না দুরূহ কাজ!
যান্ত্রিক জীবনের ডিজিটাল বাবা-মা এ কাজ কতটুকু সঠিকভাবে করতে পারছেন? আদৌ পারছেন তো! চলুন তাহলে একটু তলিয়ে দেখি উপায়গুলো:
- প্রথমত কখনোই শিশুকে দমিয়ে দেবেন না। তাকে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করুন এবং যথাযথ সঠিক উত্তরটা জানান। প্রয়োজনে তার কাছ থেকে সময় নিয়ে সঠিক উত্তরটা জেনে বলুন।
- অনেক অনেক ঝাঁ চকচকে খেলনা কিনে না দিয়ে সাধারণ কিছু দিয়ে তৈরি করে দিন তার খেলাঘর, কিংবা হতে পারে বৃষ্টির দিনে হাতে বানানো কাগজের নৌকা বা অন্য কোনো ওরিগ্যামি, হতে পারে আইসক্রিমের ফেলে দেয়া কাঠিগুলো দিয়ে বানানো একটা কাঠামো অথবা সেই ছোট্টবেলার ম্যাচবাক্সের টেলিফোন। দেখবেন শিশুটি উৎসাহিত হয়ে তার আরো অনেক প্রতিভা মেলে ধরছে।
- শিশুর প্রতিভাকে মূল্যায়ন করুন। তার নিত্যনতুন আইডিয়াকে উৎসাহিত করুন। তাকে বলুন চলো করি।
- কখনোই তাকে ছোটো করবেন না, পারতপক্ষে লজ্জা দেবেন না, এটি তুমি কী করেছ? না বলে বরং বলুন, এভাবে তো হলো না, চলো অন্যভাবে বা অন্যকিছু দিয়ে চেষ্টা করি। পজিটিভ বা গঠনমূলক শব্দচয়ন করতে চেষ্টা করুন শিশু আত্মবিশ্বাসী হবে।
- শিশুর গল্প করা, ছবি আঁকা, গল্প-কবিতা লেখাকে উৎসাহিত করুন। সম্ভব হলে তার জন্য একটা ডিসপ্লে বোর্ড তৈরি করে সেগুলোকে ডিসপ্লে করুন। অন্ততপক্ষে ফ্রিজে ম্যাগনেট দিয়ে ঝুলিয়ে দিন তার লেখা সরল পদ্যখানা। আপনার অফিসের টেবিলে বা মানিব্যাগে তার বানানো একটি সাধারণ শিল্পকর্ম বা হাতে আঁকা ছবিটি শোভা পাক না, মনোবল দারুণভাবে বেড়ে যাবে তার।
- কখনোই শিশুর কাছে পারফেকশন (perfection) আশা করা উচিত নয়। বরং বলুন, “Practice makes a person perfect“ কল্পনাশক্তির বিকাশের জন্য বারংবার চেষ্টা করাকে উৎসাহিত করুন, সে যেন হতোদ্যম না হয়।
- শিশুদের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দিন। ঘরটাকে এলোমেলো করুক, তবুও শিখুক, নতুন কিছু করুক।
- একটু বড়ো শিশুদের নিয়ে বিপরীত শব্দ, সমার্থক শব্দ, শব্দ-জব্দ (scrabble) বা ক দিয়ে পাঁচটি ফলের নাম, ফুলের নাম বলা এমন কিছু করতে পারেন।
- কল্পনাশক্তি অনেকটা মাংসপেশির মতোÑব্যায়াম করলেই তা স্ফীত হবে। ধাঁধা, পাজল মেলানো দারুণ বুদ্ধির ব্যায়াম হয়ে উঠতে পারে তার কাছে।
- কোয়ালিটি টাইম কথাটা আজকাল প্রায়ই শুনি আমরা। ভাবতে বসি এটা না জানি কী! কিছুই না, শুধু শিশুর সঙ্গে আপনিও শিশু হয়ে যান। তার সঙ্গে বসে আঁকুন, ছড়া বলুন বা বোর্ড গেইমস খেলুন কিছু সময়। শিশুর জন্য আপনার অর্থ নয়, সময় ব্যয় করুন।
- শিশুকে হাস্যরসে উদ্দীপ্ত করুন। একসঙ্গে হেসে লটোপুটি খান। তার সঙ্গে কৌতুক চর্চা করুন। এসবই শিশুমনের নানা চাপ কমিয়ে দেবে।
- মাঝে মাঝে শিশুর কাছে ছোটোখাটো সমস্যার সমাধান বা পরামর্শ চাইতে পারেন। বলো তো আজ কী রান্না করা যায়? অথবা তোমার ঘরের দেয়ালটাকে কীভাবে সাজানো যায়? এতে আপনার শিশুটি যোগ্য ডিসিশন মেকার হয়ে উঠবে, হয়ে উঠবে দারুণ আইডিয়াবাজ!
- ছুটির দিনে সবাই বসে গল্প বলার গোলটেবিল বৈঠক করতে পারেন। একটি বানানো গল্পের প্লট দিয়ে শুরু করুন, বাকিটা শিশুকে তার মতো করে শেষ করতে দিন। সবাই মিলে করুন, আমোদেরও ব্যাপার হবে সেটা। অথবা এরকম বলতে পারেন- চলো কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পের শেষটা বদলে দিয়ে আমরা নতুন গল্প বানাই।
- কখনোই সমবয়সীদের সঙ্গে তুলনা করবেন না। বরং সফল কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে পরিচিত করে দিয়ে তার রোল মডেল তৈরিতে সাহায্য করতে পারেন। সেদিন এক সদ্য কিশোরীকে বলতে শুনলাম, আমি দেবী শেঠীর মতো কার্ডিওলজিস্ট হবো। বড়ো ভাবতে দিন, তবেই না বড়ো হবে!
- বই পড়ে শোনান, বই পড়তে উৎসাহিত করুন। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের নিয়মিত পড়া ধীশক্তিকে শাণিত করে। শিশুকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে পছন্দের বই কিনে দিন। সে যেন বেড়ে ওঠে তার মনপছন্দের জগতে।
- কিনে দিতে পারেন একটা বাইনোকুলার বা অতসী কাচ। দেখুন বাকি কাজ সে নিজেই করে ফেলবে। অন্যান্য বিজ্ঞানভিত্তিক গঠনমূলক কাজ বা প্রজেক্ট ওয়ার্কে উৎসাহ দিন।
- প্রকৃতি শিশুর শেখার দারুণ ক্যানভাস। প্রকৃতির কাছাকাছি তাকে নিয়ে যান ও বেড়ে উঠতে দিন। যেমন শিশুটির হাত ধরে হাঁটতে বেরিয়ে পড়–ন, কিছু দূর গিয়ে জিজ্ঞেস করুন- বলো তো তুমি চারপাশে কী কী দেখতে পাচ্ছো? তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার স্ফূরণ হবে।
- আর শখের চর্চা তো করতেই হবে। বাগান করা, পোষা পশুপাখির যত্ন নেয়া তাকে দায়িত্বশীল করবে। আর আনন্দও যোগাবে। অন্যান্য আউটডোর কার্যক্রম যেমন, হাঁটা বা দৌঁড়ানো, সাতার কাটা, হালকা ব্যায়াম করা বা রিংয়ে ঝোলা আর প্রাত্যহিক মাঠের খেলাধূলা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে টনিকের মতো কাজ করবে।
- কল্পনাশক্তির পালে হাওয়া দিতে হলে শিশুর স্ক্রিন টাইম অর্থাৎ টিভি, মোবাইল, ল্যাপটপের সময় সীমিত করুন। ডিভাইসে খেলতে না দিয়ে হাটে-মাঠে খেলতে দিন।
- আর দুটি ব্যাপারে আলোকপাত না করলেই নয় তা হলো- শিশুর পর্যাপ্ত ঘুম ও সুষম খাদ্য; যা শিশুর শরীর ও মস্তিষ্ককে পুষ্ট করবে আর বিকশিত হতে দেবে তার অবারিত সম্ভাবনা।
- শিশু অনুকরণপ্রিয় তাই অবশ্যই তার সামনে সু-অভ্যাসগুলোর চর্চা করুন, লাভবান হবেন দুজনই।
অমিত সৃজনশীলতার আধার একটি শিশু। শিশুমনে আছে হাজারো প্রশ্ন, কৌতূহল, অনুসন্ধিৎসা। শিশুমনের কল্পনাশক্তি অপরিসীম। সে আপনমনেই মেঘের মাঝে কল্পনা করে নেয় ঘোড়া, ঘর, রাজপ্রাসাদ। যা হয়ত পরিণত বয়সের আমরা চেষ্টা করেও পারি না।
কিন্তু তার কল্পনাশক্তির স্ফূরণে তো সাহায্য করতে পারি, পারি ভবিষ্যতের জন্য তাকে পরিশ্রমী ও যোগ্য করে তুলতে। পাঠককে অনুরোধ- চলুন, আজ থেকেই চেষ্টা শুরু করি।
ডা. জেসমিন আখতার
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে