মানবকুলের ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, বিশ্বে বসবাসকারী বেশির ভাগ মানুষই সমসাময়িককালে অন্যান্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশ শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জীবনযাপন করছেন।
কিন্তু তারপরও আশেপাশের অনেক মানুষকে প্রায়শই রাগান্বিত হতে দেখা যায়। আর এই রাগ কোন কোন সময় রোগে পরিণত হয়।
মানুষের সহনশীলতা যেন ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে, আর অনেক বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে রাগের বহিঃপ্রকাশ। ঘরে-বাইরে, সামাজিক মাধ্যমে, রাজনীতির মাঠে প্রতিদিন মানুষকে যেভাবে রাগ প্রকাশ করতে দেখা যায়, তাতে মনে হয় পৃথিবীর মানুষ আসলে ক্রোধের সাগরে ডুবে আছে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ পৃথিবীতে কেন এত ক্রোধ, এত রাগ!
রাগ মূলত একটি স্বাভাবিক আবেগ যা কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষের মানসিক অবস্থার একটি বহিঃপ্রকাশ। অতিরিক্ত ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা, কাজের চাপ, ক্ষুধা, ঘুমের অভাব ইত্যাদি স্বাভাবিক নিত্য নৈমিত্তিক কারণে মানুষের রাগ হতেই পারে।
অনেকেই রেগে গেলে খুব চিৎকার চেচামেচি করেন, আশপাশের ভাঁঙার মতো কিছু পেলে ভাঙেন বা ছুড়ে মারেনÑএমনকি খাওয়া-দাওয়া কিংবা কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দেন। তবে রাগারাগি করার পরে অনেকেই আবার বুঝতেও পারেন যে, এটা উচিত হয়নি এবং এর জন্য অনুশোচনাও করেন।
কিন্তু অনেকের রাগের প্রকাশ মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। অতিরিক্ত রাগের পেছনে লুকিয়ে থাকে কোনো না কোনো দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ কিংবা মানসিক রোগ।
নিম্নলিখিত কিছু কারণ ও ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের জন্যে মানুষের মধ্যে অল্পতেই অতিরিক্ত রেগে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। যেমন-
জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বঞ্চিত হওয়া, শৈশবে বিরূপ বা আগ্রাসী পরিবেশে বেড়ে ওঠা, শিশুকাল থেকে সহিংস আচরণ প্রত্যক্ষণ করা, পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার অভাব, স্নেহ ও ভালোবাসার অভাব, দীর্ঘমেয়াদি উত্ত্যক্তকরণ, দীর্ঘমেয়াদি নির্যাতন।
প্রিয়জনের সঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক, অতিরিক্ত কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব, অতিরক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপ, বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হওয়া, অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব, খুতখুঁতে স্বভাব, হীনম্মন্যতাবোধ, সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা, ব্যর্থতা মেনে না নেওয়ার মনোভাব ইত্যাদি।
আবার কিছু দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগের ফলেও অতিরিক্ত রাগ হতে পারে যেমন: দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা (Chronic pain), উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension), ডায়াবেটিস (Diabetes), হাঁপানি (Asthma), হৃৎপিণ্ডের রোগ (Heart disease), পারকিনসনিজম (Parkinson’s disease), স্ট্রোক (Stroke), মৃগীরোগ (Epilepsy), লিভারজনিত রোগ (Liver disease), কিডনি রোগ (Kidney disease) ইত্যাদি।
আবার মস্তিষ্কে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের তারতম্য ও বিভিন্ন মানসিক রোগের উপসর্গ হিসেবেও অতিরিক্ত রাগের প্রকাশ হয়ে থাকে। যেমন: মাদকাসক্তি (Addictive disorder), ব্যক্তিত্বজনিত রোগ (Personality disorder), বিষণ্ণতা (Depressive disorder), উদ্বিগ্নতা (Anxiety disorder), শুচিবাইগ্রস্ততা (Obsessive compulsive disorder), ইমপাল্স কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার (Impulse control disorder), কনডাক্ট ডিজঅর্ডার (Conduct disorder), বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা (Intellectual disability), বাইপোলার ডিজঅর্ডার (Bipolar disorder), সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia), ডিমেনশিয়া (Dementia) ইত্যাদি।
কাজেই রাগের মাত্রা আদৌ স্বাভাবিকের গণ্ডিতে আছে নাকি স্বাভাবিকতার দেয়াল অতিক্রম করে অস্বাভাবিকতার ঘরে ঢুকে রোগের আকার ধারণ করেছে, তা নির্ধারণ করা খুব জরুরি।
নিম্নে বর্ণিত কিছু বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে আমরা সহজেই বুঝতে পারব যে, রাগ আসলে রোগে পরিণত হয়েছে বা হচ্ছে কিনা:
বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া প্রায়ই রাগ করা, রাগের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া, অল্পতেই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা, নিজেকে আঘাত করা, আশেপাশের মানুষজনকে আঘাত করা, হুমকি দেয়া, জিনিসপত্র ভাঙচুর করা, রাগ বা সহিংস আচরণের পরবর্তীতে হতাশ হয়ে পড়া ও স্থায়ী নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হওয়া।
অতিরিক্ত রাগের প্রভাবে শারীরিক প্রতিক্রিয়া যেমন- হৃৎপিণ্ডের গতি বৃদ্ধি পাওয়া, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, বুকে চাপ অনুভব করা, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
সর্বোপরি রাগ যদি একজন মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাগত ও সামাজিক জীবনকে ব্যাহত করে, তাহলে বুঝে নিতে হবে যে, তা আর মোটেই স্বাভাবিক আবেগের পর্যায়ে নেই, রোগে পরিণত হয়েছে। দেরি না করে তখন রোগ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করা আবশ্যক।
অধ্যাপক ডা. সুস্মিতা রায়
মানসিক রোগ বিভাগ, জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ, সিলেট