মেরিলিন মনেরো:
ছোট থেকে বড়ো হতে মানুষ কতটুকু বদলায়? কেন বদলায়? নিজেকে মানুষ কতটাই বা বদলাতে পারে? বদলে বদলে বদলে বদলে একজন মানুষ যেখানে গিয়ে দাঁড়ায়, নিজেকে প্রকাশ করে সেই অবস্থানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? সেটাই কি তার ব্যক্তিত্ব, রূপ, অবস্থান? সেই অবস্থানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি সবসময় সরলরেখার মতো বিচার করা যায়? উত্তর সহজ নয়। কোনো কোনো চরিত্র সেই সরল ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বেও থেকে যায়।
এই লেখায় এমনই একটি চরিত্রের কথা বলা হচ্ছে। যার জীবন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঠিক সরলরেখার মতো সোজাসাপ্টা নয়। আরো যেন বেশি কিছু। সকল সুন্দরীর সৌন্দর্য যার কাছে এসে ফিকে হয়ে যায়, গেছে; হাজারো আবেদনময়ীর আবেদন যার কাছে এসেই দিক হারিয়ে ফেলে। তাঁর হৃদয়কাড়া হাসি, আকর্ষণীয় দৈহিক গঠন ও শারীরিক ভঙ্গিমা আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
তিনি একাধারে অভিনেত্রী, কণ্ঠশিল্পী, কমেডিয়ান এবং মডেল হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর আবেদনময়ী পরিচয়ই আজও তাঁকে পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যে নামটি শুনলে সবার চোখের সামনে সেই হাস্যোজ্জ্বল এবং দু-হাতে স্কার্ট সামলানোর চিরচেনা ছবিটি ভেসে ওঠে। যে ছবিটি আজও মানুষের কাছে তীব্রভাবে আকর্ষণীয়। অনেকেই আবার একমাত্র এই ছবিটির মাধ্যমেই তাঁকে চেনেন।
যিনি আজ অব্দি বিশ্বসেরা আবেদনময়ী নারী হিসেবে বিবেচিত হন। যার জন্ম থেকে মৃত্যু পুরোটাই রহস্যময়তার খামে বন্দি। আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আজকের পর্বটি সেই আমেরিকান নারীকে নিয়েই, তিনি আর কেউ নন-মেরিলিন মনেরো (Marilyn Monroe)।
দুনিয়া কাঁপানো এই আবেদনময়ী নারী ১৯২৬ সালের লস এঞ্জেলসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা গ্লাডিস পেয়ারল বাকের একজন ফিল্ম কাটার ছিলেন। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, মায়ের একাধিক পুরুষের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে মনেরোর পিতা কে তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। একটি শিশু জন্মের পর যেখানে পিতার বুকের পরশে হেসে ওঠে অথবা কেঁদে ওঠে অথবা আজীবন পিতার নামটি বুকে লালন করে রাখে, মনেরো সেখানে জানতেনই না তার পিতা কে! আজ অবধি কৌতূহল ও রহস্যাবৃত নারী হিসেবে আমরা যে মনেরোকে জানি সেই মনেরো নিজেই কি আজীবন এই প্রশ্নের পেছনে ছুটেছিলেন? তার উত্তর হয়ত বা আমরা কখনোই খুঁজে পাব না।
শৈশব দিয়ে শুরু করলে বলতে হয়, শৈশব একদম সুখের ছিল না মনেরোর। দারিদ্র্য ছিলো তাঁর মায়ের নিত্য সঙ্গী। যার ফলে মায়ের কোলে শৈশব কাটানোর ভাগ্যটাও হয়নি মনেরোর। ভরণ-পোষণে অক্ষম হওয়ায় তাঁর মা জন্মের পরই তাঁকে অন্য একটি পরিবারের তত্ত্বাবধানে দিয়ে দেন। নয় বছর বয়সে তিনি অনাথ আশ্রমে চলে যান। বলে রাখা ভালো, সারা বিশ্ব তাঁকে মেরিলিন মনেরো হিসেবে চিনলেও এটা কিন্তু তাঁর প্রকৃত নাম ছিল না। নর্মা জেয়ান ছিল তাঁর প্রকৃত নাম। মাত্র ১৬ বছর বয়সে নর্মা জেয়ান বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ২১ বছর বয়সী প্রতিবেশী জেমস ডৌঘেটির (James Dougherty) সঙ্গে। বেশিদিন স্থায়ী হয়নি সে বিয়ে। মাত্র চার বছরেই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
পরবর্তী বিয়ে এবং বিচ্ছেদগুলো আরো আশ্চর্যজনক। ১৯৪৬ সালে নর্মার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে জেমসের সঙ্গে। ততদিনে নর্মা ছোটখাটো মডেলিং শুরু করেছেন। আজকের আবেদনময়ী খুব সহজেই সাফল্যের সিড়ি খুঁজে পাননি। মাত্র পাঁচ ডলারের বিনিময়ে প্রথম মডেলিং শুরু করেন তিনি এবং ছোটখাটো কাজ করতে থাকেন। এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে ক্যারিয়ার শুরু হয় তাঁর। ১৯৪৬ সালে তিনি তার মাতৃপ্রদত্ত নাম নর্ম জেয়ান বদলে নিজের নাম মেরিলিন মনেরো ব্যবহার করা শুরু করেন। ১৯৪৭ সাল। নিজের সৌন্দর্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার দরজায় পা ছোঁয়ান তিনি।
অর্থাৎ The Shocking Miss Pilgrim সিনেমাতে ছোট একটি চরিত্রের মাধ্যমে প্রথম চলচ্চিত্রে পা রাখেন তিনি। তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্রও খুব একটা ভালো ছিল না। এই সিনেমাতে মাত্র দু-তিনটি দৃশ্যে রাখা হয় তাঁকে। পরবর্তীতে ভাগ্যদেবতা যেন একটু সদয় হলেন তাঁর প্রতি। কারণ পরবর্তী সিনেমা Dangerous Years-এ মোটামুটি মানের একটি চরিত্র পেয়ে যান মনেরো।
১৯৪৯ সালে Playboy ম্যাগাজিনে নগ্ন শরীরে মডেল হওয়ার মাধ্যমেই যেন যৌন আবেদনময়ী নারী হিসেবে মেরিলিন মনেরো এর পদচারণা শুরু। এর পরের বছরটা যেন সৌভাগ্যের চাবিকাঠি ছিল মনেরোর জন্য-The Asphalt Jungle এবং Ges All About Eve চলচ্চিত্র দুটির মাধ্যমে দর্শক পেয়ে যায় তাদের কাঙ্খিত আবেদনময়ীকে। ইতিপূর্বে অন্য কোনো অভিনেত্রীর মাঝে যা পায়নি তাঁরা তাই নিয়ে হাজির হন মেরিলিন মনেরো।
১৯৫১ সালে মনেরো অভিনয় করেন Love Nest সিনেমাতে। দর্শকরা লুফে নিতে শুরু করে তাঁকে। কারণ হিসেবে বলা যায়, মনেরোর মাঝে দুটি দিক ছিল যার একটি হচ্ছে তাঁর অতি আবেদনময়ীতা এবং অন্যটি হলো তাঁর শিশুসুলভ দিক। মনেরো একে একে অভিনয় করেন Don’t Bother to Knock, Monkey Business, Gentlemen Prefer Blondes সিনেমাতে।
Monkey Business ছবিতে মনেরোকে প্রথমবারের মতো বাদামি চুলের প্লাটিনাম ব্লন্ডে দেখা যায় যা পরবর্তীতে তাঁকে ট্রেডমার্কে পরিণত করেছিল। এরপর How to Marry a Millionaire, The Seven Year Itch চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মনেরো তাঁর আরেক প্রতিভার জানান দেন-কমেডি অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন তিনি শুধু আবেদনকে সম্বল করেই পথ চলেন না; একজন অভিনেত্রীর যা যা গুণ থাকা দরকার তার সবই তিনি ধারণ করেন। The Seven Year Itch সিনেমারই দৃশ্য সেই স্কার্ট পরিহিত বিখ্যাত ছবিটি, আমরা মনেরো বলতেই যে ছবিটিকে আজ চিনে থাকি। মনেরা মোট তিনবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
মনেরোর সম্বন্ধে যে কথাগুলো না বললেই নয় তা হলো-তিনি প্রচুর বই পড়তেন। তাঁর ৪০০ বই সমৃদ্ধ লাইব্রেরি যেন সেটাই বলে। তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনী গ্রন্থ। প্রেসিডেন্ট কেনেডির সঙ্গে তাঁর প্রেমের গুঞ্জন ছিল। মনেরো ছিলেন আজীবন স্বাধীনচেতা একজন নারী। ১৯৬২ সালে নিজের শোবার ঘরে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় মনেরোর মৃতদেহ আবিষ্কার করা হয়। এ সময় তাঁর হাতে ফোনসেটটি ধরা ছিল।
আজ অবধি তাঁর মৃত্যু রহস্যঢাকাই রয়ে গেছে। কী কী ঘটেছিল, মনেরোর এই নাটকীয় ক্রমপরিবর্তিত জীবনে? পিতৃপরিচয়হীনতা থেকে নিজে নিজে নির্মাণ করা মাহাপরাক্রমশালী স্বকীয় আত্মপরিচয়, দারিদ্র্য আর আত্মপরিচয়হীন ইতিহাসকে পেছনে ফেলে ক্রমেই অর্থবিত্ত-বৈভব আর রূপে পরিপূর্ণতা পাওয়া, সর্বজনকাঙিক্ষত মেরিলিন মনেরোতে রূপান্তরিত হওয়ার পেছনের কাহিনি কী? আজ এখানে দাঁড়িয়ে তার পূর্ণ ব্যাখ্যা করা কঠিন।
বিজ্ঞানের কিছু বিষয় যদি মনে করতে চাই তাহলে কিছুটা ব্যাখ্যা হয়ত করা সম্ভব। ধরুন, কেউ যখন তার নিজের অবস্থানে খারাপ থাকে, তখন তার মন খারাপ হয়। অন্যদের চেয়ে তার চিন্তার গতি কমে আসে। অসহায়ত্ব তাকে জাপটে ধরে। ধীরে ধীরে তার সম্ভাবনা বা ক্ষমতাটুকুও সে কাজে লাগাতে পারে না। স্বাভাবিক মন খারাপ ক্রমেই বিষণ্ণতা রোগে পরিণত হয় বা হতে পারে। মানসিকভাবে দুর্বল হতে থাকে তার সকল সম্ভাবনা।
আবার উল্টোটাও হয়, হতে পারে। বাঘের সামনে জীবন বাঁচাতে মানুষ তার সর্বশক্তি দিয়েই চেষ্টা করে। তার কাছে জীবনের মূল্য তখন অনেক বেশি। সবসময় সেসব হিসেব করে করা সম্ভব হয় এমন নয়। অজান্তেই জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে সে সমস্ত শক্তি নিয়ে ছুটে চলে। দুর্বলতা মানুষকে শক্তিও দিতে পারে, দেয়। সবাই হাল ছাড়ে না। দুর্বল মুহূর্তে মানুষ তার টিকে থাকার চেষ্টা আরো বাড়িয়েও দিতে পারে।
অনেক সময় যার অবস্থান যত খারাপ ঘুরে দাঁড়ানোর দিকে তার মনোযোগ তত বেশি হতে পারে। যে জানে আমি পরীক্ষায় খুব ভালো না করলেও পাশ করব, পড়াশুনায় তার মনোযোগ অত বেশি নাও হতে পারে। আবার যে জানে আমি খুব খারাপ অবস্থানে আছি, বেশি চেষ্টা না করলে ফেল করব সে হয়ত পড়াশুনা বাড়িয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ ফেল করা মানুষটি অন্য সাধারণ ছাত্র থেকে বেশি চেষ্টা করবে, তাতেই তার ফলাফল অনেক ভালো হয়ে যেতে পারে।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, অবশ্যই তার ভেতরের যোগ্যতা এবং সম্ভাবনা থাকতে হবে। নিজের জীবনের সমস্ত সম্ভাবনাকে মনেরো সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়েছেন। তিনি অল আউট খেলেছেন। মানুষ পৃথিবীতে আসে নিজস্ব একটি সম্ভাবনার সংগ্রহ নিয়ে, সেসব কাজে লাগাতে হয়। নিশ্চিতভাবে মনেরো সেসব কাজে লাগিয়েছেন। তাই নর্মা জেয়ান থেকে তিনি পরিণত হন জগদ্বিখ্যাত মেরিলিন মনেরোতে।
পৃথিবীর কাছে আজও তিনি রহস্যাবৃতা নারী হলেও, আজও এই গ্রহবাসী পুরুষরা অনিন্দ্যসুন্দর রূপ এবং অভিনয়গুণের কারণে তাঁকে মনে রেখেছে। নারীরা তাঁকে মনে রেখেছে তাঁর আকর্ষণীয় দৈহিক সৌন্দর্যের কারণে। পৃথিবী তাঁকে মনে রাখার একমাত্র কারণ যৌনতা ও আবেদনময়ীতা-স্বয়ং মনেরোও এটি উপভোগ করতেন না। তিনি সবার কাছে যৌনতার রানী হিসেবে থাকতে চাননি, থাকতে চেয়েছেন অভিনয়ের গুণে গুণান্বিতা একজন অভিনেত্রী হিসেবে।
তাঁর জীবদ্দশায় এই যৌনতার রানীর ছায়াটা শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছেন, মনোযোগী হয়েছেন আবেদনময়ী না হয়ে অভিনেত্রী হিসেবে পর্দায় নিজেকে মেলে ধরতে। তিনি তা কতটুকু পেরেছেন সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা নাই হোক, অন্তত এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আবেদনময়ী আর অভিনেত্রীর এই বিরাট ধাঁধাটা, মনেরো শেষ পর্যন্ত সমাধান করে যেতে পারেননি। চিরদুঃখী এই আবেদনময়ীর আক্ষেপ কিংবা ধাঁধার সমাধানের ভার তাই শেষপর্যন্ত তাঁর অগণিত ভক্তের কাছেই সমর্পিত !
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত।