আপনার কাছে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা কী? আপনার জীবনে কি এমন কেউ আছে যার সাথে আপনি সমস্ত সুখ দুঃখ ভাগ করতে পারেন? আপনি কি যে কোনও পরিস্থিতিতে তাঁকে সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করতে পারেন? আপনি কি কখনও তার থেকে কিছু গোপন করেন?
এগুলো শুধু গভীর প্রশ্নই নয় – বরং মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী – এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে সুস্থ এবং দীর্ঘজীবনের চাবিকাঠি।
বিহেভিওরাল মেডিসিন এই কথা আজকে স্বীকার করলেও, আজ থেকে বহুযুগ আগে অ্যারিস্টটেল তাঁর নৈতিক চরিত্র এবং আচরণ নিয়ে গবেষণায় এর উল্লেখ করেছেন (নিকোম্যাকিয়ান নীতি)। এই অত্যন্ত প্রভাবশালী গবেষণায় অ্যারিস্টটেল বন্ধুত্বর তিনটি ভিতের কথা উল্লেখ করেন: লাভ, তৃপ্তি, এবং নীতি। যখন অর্থ ও ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তার ভিত হয় লোভ। ব্যাবসায়িক সম্পর্ককে এর মধ্যে ধরা যেতে পারে। তৃপ্তির উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বে সাধারণত একসাথে খেলা দেখা বা ঘুরতে যাওয়া হয়। তবে অ্যারিস্টটেলের মতে সবার সেরা হল নীতি নির্ভর বন্ধুত্ব। কারণ এতে আবেগ ও করুণা থাকে। স্বভাবতই মনুষ্যজীবনে এর প্রভাব অপরিসীম।
মধ্যযুগে মসেস মাইমনডিসও অ্যারিস্টটেলের চিন্তাধারাকেই সমর্থন করেছেন। গাইড ফর দ্য পারপ্লেক্সড ‘এ মাইমনডিস জোর দিয়ে বলেছেন, “এটা জানা কথা যে বন্ধু আমাদের গোটা জীবনের জন্যে দরকার। সুস্থ এবং সফল হলে আমাদের বন্ধু সঙ্গ ভাল লাগে। কিন্তু দুঃসময়ে আমাদের বন্ধু প্রয়োজন হয়। আর বার্ধক্যে তাঁদের সহায়তা লাগে।”
মাইমনডিসকে চিকিৎসক মানা হলেও তাঁর সময়ে এই সংক্রান্ত কোনও চিকিৎসা উপলব্ধ ছিল না। উনবিংশ শতাব্দীতে প্রথম বার সিগ্ম্যান ফ্রয়েড ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা শুরু করেন। আশ্চর্যের ঘটনা হল যে, ফ্রয়েড নিজে একজন তুখড় লেখক হওয়া সত্ত্বেও, তিনি বন্ধুত্ব নিয়ে কখনও সেরকম ভাবে আলোচনা করেননি। এমনকি নিজের নিউরোসিস সংক্রান্ত গবেষণায় ‘ও তিনি বন্ধুত্বে শৈশবের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেননি।
অথচ, ফ্রয়েডের সহকর্মী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এই বিষয়ে অনেক কিছু বলে গেছেন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে অস্ট্রীয় সেনায় চিকিৎসক হিসেবে কাজ করা কালীন, অ্যাডলার মানুষের উপর আক্রোশের করাল আগ্রাসন লক্ষ্য করেন। সেই সময়েই তাঁর মধ্যে সামাজিক ভাবাবেগ নিয়ে প্রভাবশালী চিন্তার জন্ম হয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ছোট থেকে যত্নের ও ভালবাসার ক্ষমতা আছে। কিন্তু শৈশবে পরিবারের সদস্য বা শিক্ষকদের দ্বারা তা লালিত না হলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
শৈশব ও কৈশোরে সামাজিক প্রভাব নিয়ে তাঁর এই রচনার জন্য অ্যাডলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান। ব্যক্তিত্ব নির্ণয় শেখাতে গিয়ে তিনি শৈশবে বন্ধুত্বের অপরিসীম গুরুত্বের উল্লেখ করেছেন। এই সমস্ত দাবী অ্যাডলার নিজের চিকিৎসা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে করেছিলেন। তিনি আরও বলেন যে শৈশবে বন্ধু না থাকলে, পরে অল্প বয়সেই মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। এবং সামাজিক মেলামেশা শেখাতে পেশাদার প্রশিক্ষকের প্রয়োজন হয়। এক দিক থেকে দেখলে, ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে গবেষণা সেই অ্যাডলারের আমল থেকেই শুরু হয়েছে।
বন্ধুত্ব ও বিহেভিওরাল মেডিসিন
১৯৭০ ‘এ বিহেভিওরাল মেডিসিন আবিষ্কারের পর, সামাজিক সহায়তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। আর এই ক্ষেত্রে সূত্রপাত থেকেই, মনোবিজ্ঞানীরা মানসিক সহায়তার থেকে বাস্তব চিত্রকে আলাদা করেছেন। বাস্তব চিত্র যেমন টাকা, রান্না, খাদ্য অথবা ঘর গোছানো। আর মানসিক সহায়তা বলতে এখানে সহানুভূতি এবং পরামর্শ বোঝানো হয়েছে। পাশাপাশি একটি বিষয়ের উপর গবেষণা বেড়েই চলেছে: ভরসাযোগ্য সম্পর্ক। ব্রিগহ্যাম-ইয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাঃ জুলিয়ান হল্ট-লানস্ট্যাড এবং তাঁর সহকর্মীদের মতে, “কিছু সম্পর্ককে বাকিদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পিছনে সঙ্গত কারণ আছে। সেই সম্পর্কের ঘনিষ্টতাই আমাদের একে অপরকে বুঝতে সাহায্য করে।”
গত ৩০ বছরে এই বিষয়ে প্রচুর গবেষণায় একজন ভরসাযোগ্য বন্ধুর উপস্থিতির সাথে একজন ব্যক্তির মানসিক সুস্থতার সম্পর্ক নিয়ে লেখা হয়েছে। এই গবেষণার পরিধি বিশাল। ফলে ফলাফলও অগুনতি: আমেরিকান কিশোরদের মাদকাশক্তি থেকে শুরু করে মেক্সিকান যুবকদের স্বাস্থবিধি অবধি। দেখা গেছে, ভরসাযোগ্য বন্ধু না থাকলে সহজেই ছেলে-মেয়েরা উল্টো-পাল্টা জিনিসে আকৃষ্ট হয়। গবেষনায় এও দেখা গেছে যে জীবনে এক ভরসাযোগ্য সঙ্গী থাকলে ব্যক্তির বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা যেমন হৃদরোগ, হাঁপানি ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তাঁদের মধ্যে হতাশার চেয়ে বেশী দৃঢ় মানসিকতা দেখা যায়। ব্রিটেনে ওবেসিটি ও ফাংশনাল হেলথ নিয়ে একটি পরীক্ষায়, ডাঃ পল সার্টিস এবং তাঁর সহকর্মীরা দাবী করেছেন যে জীবনে ভরসাযোগ্য একজন সঙ্গীর উপস্থিতি একজন মহিলার আয়ু পাঁচ বছর এবং একজন পুরুষের আয়ু চার বছর অবধি বাড়াতে পারে।
কিন্তু এই রকম কেন হয়? এর সঠিক উত্তর আমাদের আজও অজানা। অনেকেই মনে করেন যে এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। প্রত্যক্ষ প্রভাবে, একজন ঘনিষ্ট বন্ধুর উপস্থিতি আমাদের সহানুভূতি ও পরামর্শর সুযোগ করে দেয়। ফলে আমরা দৈনন্দিন জীবনে নিশ্চিন্তে যে কোনও বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি। পরোক্ষ প্রভাবে, কাউকে মনের সমস্ত কষ্ট খুলে বলতে পারার জন্যে দুশ্চিন্তা, ধূমপান, অতিরিক্ত আহার, মাদক সেবন, এবং বিভিন্ন অস্বাস্থকর জীবনযাত্রা থেকে দূরে থাকা যায়। বর্তমানে এই গতিময় বিশ্বে দুশ্চিন্তার শেষ নেই, ফলে একজন বিশ্বাসযোগ্য বন্ধুর উপস্থিতি খুবই প্রয়োজনীয়।
বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখার ছ’টি মন্ত্র:
১. মন খুলে কথা বলুন। আপনার ভাবাবেগ সঠিক ভাবে প্রকাশ না পেলে কারও পক্ষেই আপনাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। “ক’দিন ধরে মনটা খারাপ” বলার চেয়ে “চাকরিটা নিয়ে হতাশায় ভুগছি”, বলা অনেক ভাল।
২. আত্মতুষ্টিতে ভুগবেন না। সুন্দর বক্তা হওয়ার আগে একজন শান্ত শ্রোতা হতে শিখুন। আপানার বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির জীবনে কি চলছে তা সম্পর্কেও খোঁজ রাখুন।
৩. সেই ব্যক্তি যেন ক্লান্ত না হয়ে পড়েন। সমস্ত দুশ্চিন্তা তাঁর মাথায় চাপিয়ে দেবেন না। তাতে কোনও লাভ হয় না।
৪. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। কারণ আপনার বন্ধু আপনার চিকিৎসক নন। নিজের সুবিধা অনুযায়ী তাঁকে ধন্যবাদ জানানোর পন্থা বেছে নিন।
৫. বিশ্বাসযোগ্য সাথীর সাথে নিয়মিত কথা বলুন। নিজের ভুল থেকে কিছু শিখছেন কি না তা তাঁর থেকে জেনে নিন। তাঁর পরামর্শগুলি মেনে চলার চেষ্টা করুন।
৬. যে কোনও সম্পর্কেরই একটা ভারসাম্য প্রয়োজন। কাজেই সুখদুঃখের কথা জানানোয় একটি মাত্রা বজায় রাখুন। খুশি চিরকাল দুখসাগরের উপরে ভাসে। তাই আপনার ভরসাযোগ্য সঙ্গীর সাথে আনন্দ ও মজার মুহুর্ত কাটানোর চেষ্টা করুন।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে
https://youtu.be/WEgGpIiV6V8