বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বহু বছর ধরে মানসিক রোগের অপচিকিৎসা বিরাজমান ছিল। এখনো ঝাঁড়, ফুক, কবিরাজি, পানি পড়া, তাবিজ দেওয়ার প্রবণতা অনেক। অনেক অভিভাবক এখনো মানসিক রোগগুলোর জন্য মনোরোগ চিকিৎসকের চিকিৎসাকে ঠিক বলে মনে করেন না। এই ভয়াবহ বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে সমাধান লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন্নাহার।
বাংলাদেশের মানুষ একসময় মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য নানা ধরণের অপচিকিৎসার আশ্রয় নিতো। এখনও পীর, ফকির, ওঝা, কবিরাজদের চিকিৎসক হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা আছে। কেন?
বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে মানসিক রোগ সম্পর্কে ধারণা ও সচেতনতা অনেক কম। মানসিক রোগের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা সম্পর্কেও সঠিক জ্ঞান ও তথ্যের অভাব রয়েছে। তাছাড়া মানসিক রোগজনিত অস্বাভাবিক আচরণকে জ্বীনে ধরা, আছর করা বা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে । এসকল বিভিন্ন কারণে অজ্ঞতাবশত বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে পীর, ফকির, ওঝা, কবিরাজদের কাছে যায়।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের গ্রাম ও মফস্বল শহরে দক্ষ মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর যথেষ্ঠ অপ্রতুলতা রয়েছে। কিন্তু পীর, ফকির, ওঝা, কবিরাজরা তাদের আশেপাশে থেকেই নানারকম অপচিকৎসার প্রচার-প্রচারণা করে। এতে সরল মানুষেরা বিভ্রান্ত হয়ে চিকিৎসা পাওয়ার আশায় তাদের কাছে যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পীর, ফকির, ওঝা, কবিরাজদের কাছে চিকিৎসাব্যয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাসপাতালের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা খরচের চেয়ে অনেক বেশী।
মানসিক রোগের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা সম্পর্কে অজ্ঞতা, সচেতনতার অভাব, মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর অপ্রতুলতা বিভিন্ন ফ্যাক্টর এক্ষেত্রে কাজ করে বলে আমি মনে করি।
রাজধানী ঢাকাতেও মানুষকে এ ধরণের চিকিৎসা নিতে দেখা যাচ্ছে। তবে মানুষজনের মধ্যে সচেতনতা বাড়ার সাথে সাথে অপচিকিৎসার প্রকোপ কিছুটা হলেও কমেছে।কিন্তু এই হার কম কেন? করণীয়?
দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় রাজধানী ঢাকায় মানসিক রোগী ও তার অভিভাবকরা অনেক বেশী তথ্য পেয়ে থাকে বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও হাসপাতালের মাধ্যমে। ঢাকায় অনেকগুলো সরকারী ও বেসরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে যেখানে নিয়মিত মানসিক রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। এসকল কারণে সচেতন রোগী ও অভিভাবকদের অনেকেই মনোচিকিৎসকের কাছে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নিতে আগ্রহী।
তারপরেও দেখা যায় অনেকেই অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নিয়ে অপচিকিৎসার কবলে পড়ছে। এক্ষেত্রে বড় অন্তরায় রোগ সম্পর্কিত স্টিগমা। অনেক অভিভাবকরাই তাদের পরিবারের মানসিক রোগী সদস্যকে সামনে আনতে চাননা; তাদের রোগ লুকিয়ে রেখে গোপনে পীর, ফকির, ওঝা, কবিরাজদের কাছে যান। অনেকসময় আত্মীয়-স্বজনের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়।
আরো একটা বড় সমস্যা হচ্ছে ঔষধ সম্পর্কে রোগী ও অভিভাবকদের ভ্রান্ত ধারণা। তারা মনে করেন যে, মানসিক রোগের চিকিৎসায় যেসকল ঔষধ ব্যবহার করা হয় সেগুলোর পার্শপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশী। যদিও ডাক্তারের কাছে যায় তথাপি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে না গিয়ে স্টিগমার কারণে অন্য ডাক্তারের কাছে যেতেই বেশী স্বস্তিবোধ করে।
মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সঠিক তথ্য তুলে ধরে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সেইসাথে বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ফোকাস গ্রুপ আলোচনা স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটিতে করা প্রয়োজন। তৃণমূল পর্যায়ে এসব তথ্য পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করাও জরুরী। এছাড়াও কম খরচে কোথায় বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সে তথ্যও জনগণকে জানানো দরকার। এবিষয়ে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি জনগণ, সমাজকর্মী ও অন্যান্য শ্রেণী-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা একান্তভাবে প্রয়োজন।
ডাক্তারের দ্বারস্থ হলেই মানসিক রোগের সমাধান হবে, সেটিও মনে করছেন না অনেক অভিভাবক। সাইকিয়াট্রাস্ট হিসেবে এই বিষয়েও আপনার বক্তব্য?
ডাক্তারের দ্বারস্থ হলেই যে মানসিক রোগের সমাধান হবে এটি শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এটা ঠিক যে, বেশীরভাগ লঘু মানসিক রোগ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে ডাক্তারের ওষুধ ও মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাসেবায় ভালো হয়ে যায়। গুরুতর মানসিক রোগের কিছু রোগী ভালো হয়ে যায়; অন্যরা বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে থেকে রোগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক অথবা প্রায় স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে। অভিভাবকদের সাথে বসে রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে যথাযথ সাইকোএডুকেশন দেয়া প্রয়োজন। সেইসাথে সচেতনতা বৃদ্ধি করে মানসিক রোগ সম্পর্কে স্টিগমা দূর করা ও ঔষধ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করা একান্ত জরুরী।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে