মানসিক চাপে যেসব শারীরিক পরিবর্তন ঘটে

মানসিক চাপে যেসব শারীরিক পরিবর্তন ঘটে
মানসিক চাপে যেসব শারীরিক পরিবর্তন ঘটে

আমাদের জীবনে খুব পরিচিত একটি শব্দ হচ্ছে ‘চাপ’। প্রায়ই আমরা অন্যদেরকে বলতে শুনি বা নিজেও বলি যে, খুব চাপে আছি। পড়াশোনার চাপ, কাজের চাপ, আর্থিক চাপ, পরিবারের চাপ, অফিসে বসের চাপ-এই চাপের আর শেষ নেই। যখন আমরা বলি ‘চাপে আছি’ তার মানে আমরা এই মুর্হূতে কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করছি যা আমাদের ভেতরে অস্বস্তি তৈরি করেছে। এই প্রতিবন্ধকতা হতে পারে বাহ্যিক এবং মনস্তাত্ত্বিক।
মানসিক যেকোনো চাপই তেমনি একেকটি প্রতিবন্ধকতা। চাপ হতে পারে ইতিবাচক, যেমন-সামনে আপনার প্রমোশন আছে তাই আপনি অফিসে একটু বেশি সময় দিচ্ছেন কিংবা নির্ভুলভাবে কাজ করার চেষ্টা করছেন যেন কোনো ভুল না হয়ে যায় যা আপনার প্রমোশন আটকে ফেলতে পারে, আবার আপনার ভালো রেজাল্ট করতে হবে তাই এখন একটু বেশি সময় পড়তে হচ্ছে বা সময় বেশি দিতে হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে ইতিবাচক চাপ। আবার চাপ হতে পারে নেতিবাচক।
যখন কোনো ব্যক্তি দিনের পর দিন কোনো না কোনো চাপ মোকাবেলা করে যাচ্ছে কিন্তু এ থেকে নিস্তার পাচ্ছে না তখন একে বলা হয় নেতিবাচক চাপ যা বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী। মানব শরীর বা মনকে কখনো না কখনো কোনো না কোনো চাপ মোকাবেলা করতে হয়। কখনো এই চাপ স্বল্প সময়ে চলে গেলেও কখনো আবার সহজে ছেড়ে যেতে চায় না। উত্তেজকের ধরন, মাত্রা এবং সময় অনুসারে চাপ শরীরে নানাবিধ পরিবর্তন ঘটায়-এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
চাপ শারীরিক অনেক পরিবর্তন এবং রোগের কারণ ছাড়াও রোগ বৃদ্ধিতে কাজ করে। অল্প সময়ের চাপ শরীরের জন্য ভালো। কারণ এটা আপনাকে সমস্যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। আপনার শরীর চাপের মধ্যে পড়লে কিছু হরমোন নিঃসরণ করে যাকে বলে স্ট্রেস হরমোন যা আপনার হৃৎপিন্ডের গতি বাড়ায়, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বাড়িয়ে মাংসপেশিকে তৈরি রাখে প্রতিক্রিয়া সামলাতে। তবে যখন ক্রমাগত এই হরমোন নিঃসরণ হতে থাকে তখন আপনার শরীর এর সঙ্গে আর নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না যা শরীরে নতুন নতুন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যেকোনো চাপে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস থেকে করটিকোট্রফিন রিলিজিং ফ্যাক্টর ((CRF) নিঃসরণ হয় যা পিটুইটারি গ্রন্থির ওপর কাজ করে এড্রিনোকরটিকোট্রপিন (ACTH) রিলিজ করে, যা আবার এড্রেনাল গ্রন্থির ওপর কাজ করে মিনারেলকরটিকয়েড ও গ্লুকোকরটিকয়েড হরমোন বা এড্রেনালিন ও করটিসল নামক স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে যা শারীরিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের চাপ মোকাবেলায় সাহায্য করে।
পূর্বে ধারণা করা হতো হরমোনের জন্য মস্তিষ্কে কোনো রিসেপ্টর থাকে না তাই হরমোন শুধু ‍মস্তিষ্কের বাইরে কাজ করে। কিন্তু নানা গবেষণায় দেখা গেছে, হরমোন মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে কাজ করে আমাদের আচরণ, বিচার-বুিদ্ধ ও বোঝার ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তার করে। মস্তিষ্কের হিপ্পোকম্পাস নামক স্থানে মিনারেলকরটিকয়েড ও গ্লুকোকরটিকয়েড এই উভয় হরমোনের জন্য রিসেপ্টর থাকলেও মস্তিষ্কের অন্যান্য স্থানে শুধু গ্লুকোকরটিকয়েড হরমোনের জন্য রিসেপ্টর রয়েছে।
যেহেতু স্ট্রেস হরমোন মস্তিষ্কের এসব স্থানে কাজ করে তাই চাপ যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তবে হিপ্পোকম্পাসের কার্যকারিতা ও গঠনগত পরিবর্তনও একসময় দেখা দেয়। শুধু তাই নয়, নিউরনের সংখ্যাও কমতে থাকে ফলে মস্তিষ্ক একসময় শুকিয়ে যায় ও এর ওজনও কমে যায়। মলূত স্মরণশক্তির জন্য এই হিপ্পোকম্পাস দায়ী। হিপ্পোকম্পাস হচ্ছে মস্তিষ্কের একটা অংশ যা ক্ষণস্থায়ী হতে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে তথ্য সমন্বয় সাধন করে।
উচ্চমাত্রার গ্লুকোকরটিকয়েড দীর্ঘসময় ধরে কাজ করলে হিপ্পোকম্পাস শুকিয়ে যায়। ফলে স্মরণশক্তি কমে যায়। চাপজনিত রোগ পিটিএসডি (PTSD) তে তাই হিপ্পোকম্পাসের ভলিউম কম পাওয়া যায় এবং রোগীদের স্মরণশক্তিতে সমস্যা দেখা যায়। এড্রেনালিন ও করটিসল নামক স্ট্রেস হরমোন আপনার হৃৎপিন্ডের গতি বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় স্থানে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। যখন চাপ কমে যায় তখন হরমোনগুলো আবার আগের স্থানে ফেরত যায়।
স্ট্রেস হরমোন রক্তনালীকে সংকুিচত করে এবং অনেক বেশি অক্সিজেনযক্তু রক্ত মাংসপেশিতে পাঠায়। কিন্তু এটা দীর্ঘমেয়াদি হলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে যা পরবর্তীতে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। একইসঙ্গে এই হরমোনগুলো আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বাড়িয়ে শরীরে অক্সিজেনের উপস্থিতি বাড়ায় এবং অক্সিজেনযুক্ত রক্ত শরীরের প্রয়োজনীয় স্থানে পাঠায়। তাই যাদের অ্যাজমা বা হাঁপানি আছে তাদের সমস্যা তখন অনেক গুণ বেড়ে যায়। তাছাড়া চাপজনিত হরমোনের আধিক্য শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎপিন্ডের গতি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পেটের সমস্যাও করে যেমন : গলা জ্বলা, বকু জ্বলা বাড়ায়। তাছাড়া বমি বমি লাগা অথবা পেটের ব্যথাও হতে পারে।
স্ট্রেস পেটের আলসারের জন্য দায়ী না হলেও এটা পেটের আলসারকে সহজে শুকাতে দেয় না কারণ স্ট্রেস রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। চাপের কারণে যকৃৎ অতিরিক্ত গ্লুকোজ তৈরি করে শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগান দেয়। এই চাপ যদি দীর্ঘমেয়াদে থাকে তাহলে শরীরে গ্লুকোজের মাত্রাও সবসময় বেশি থাকে যা ডায়াবেটিসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
করটিসলের প্রভাবে শরীরের কেন্দ্রে ফ্যাট জমা হয় তাছাড়া এটা আমাদের ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয়। চাপে মাংসপেশি শক্ত হয়ে আমাদেরকে যেকোনো আঘাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করে। তবে এই চাপ কমে গেলে মাংসপেশি আবার আগের মতো শিথিল হয়ে আসে। কিন্তু দীর্ঘ চাপে তা আর শিথিল হতে পারে না। যার কারণে মাথা ব্যথা, কোমর ব্যথা কিংবা ঘাড় ব্যথা হতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি চাপে যৌন আগ্রহ কমতে থাকে। স্বল্পমেয়াদি চাপে পুরুষ হরমোন টেস্টোসটেরনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় কিন্তু র্দীঘমেয়াদি চাপে তা কমতে থাকে। ফলে স্পার্ম উৎপাদন কমে যায় এবং যৌন অক্ষমতা দেখা দেয়। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকে সমস্যা দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, চাপের কারণে ৯ ভাগ মহিলাদের মাসিক বন্ধ হয়ে যায় আবার ৩৩ ভাগের মাসিক অনিয়মিত হয়। তাছাড়া অধিক চাপে গ্রোথ হরমোন, প্রোলাকটিন এবং থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণেও পরিবর্তন ঘটে। যা গ্রেভস ডিজিজ, জন্মনিয়ন্ত্রণকারী অঙ্গের কার্যকারিতা কমানো এবং ওজন বৃদ্ধির কারণ হয়।
স্বল্পমেয়াদি চাপ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ায় এবং সাময়িক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি চাপ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে যার কারণে আমাদের ভাইরাল ইনফেকশন ছাড়াও অন্যান্য ইনফেকশন খুব সহজেই হতে পারে। তাছাড়া যেকোনো ক্ষত শুকাতেও দেরি হতে পারে। ৪৩ ভাগ পরিণত মানুষের ক্ষেত্রে চাপের কারণে শরীরে খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে দেখা গেছে। ৫০ ভাগের বেশি মানুষের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক সমস্যাও দেখা দেয় সময়মতো চাপজনিত সমস্যা সমাধান না করার জন্য। চাপ যেহেতু শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা যেমন মাথাব্যথা, পাকস্থলীর সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, বুকে ব্যথা কিংবা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
অনেকে তাই সিগারেট, মদ কিংবা অন্যকোনো নেশার মাধ্যমে এই চাপ থেকে পরিত্রাণ খোঁজেন এবং আসক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু এটা এক সময় চাপ কমানো তো দূেরর কথা উল্টো চাপকে ধরে রাখে বা চাপকে বাড়াতে থাকে। তাই চাপ মুক্ত হতে গিয়ে কোনো অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতি বেছে না নিয়ে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে এবং সময়মতো চিকিৎসা নিলে এর থেকে বেরিয়ে আসা অনেকটাই সহজ হবে।
সূত্র: লেখাটি মনে খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা বা অন্য যেকোন ধরনের দায়  সর্ম্পূণই লেখকের।

Previous articleমানসিক রোগীর ডায়েরি
Next articleকরোনাভাইরাস: কোথায় কোথায় সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি?
সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সিরাজগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here