আমাদের সমাজে কেউ আছেন যারা সুস্থতা ও অসুস্থতার (মানসিকভাবে) মাঝামাঝি অবস্থানে চলাচল করেন। কথাবার্তা আচার ব্যবহারে আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হলেও বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা রয়েছে| যার কারণে তাদের নিয়ে মনে প্রশ্ন জেগে উঠে, এরা কি আসলে ইচ্ছা করেই এই অস্বাভাবিক আচরণগুলো করে নাকি এরা এক ধরনের মানসিক রোগী?
সুস্থতা ও অসুস্থতার সুক্ষ্ণ একটি সীমা রেখা রয়েছে। অধিকাংশ মানুষই এই সীমা রেখাটির আশেপাশেই থাকেন, যারা সামান্য পা ফসকে সীমার অপর পাশে অর্থাৎ অসুস্থতার দিকে চলাচল করেন আজ তাদের কথা, তাদের গল্প নিয়ে সময় কাটানো যাক।
আমাদের মেয়েটি কৈশোরে পা দেয়ার পর থেকে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। নিজের মতো থাকতে চাওয়া, চারপাশে দূর্ভেদ্য দেয়াল তুলে দেয়া, প্রচণ্ড রেগে যাওয়া, শুধু বন্ধুদের সাথে বেশি সময় কাটানো ও সখ্যতা, সারাক্ষণ গান শোনা, টিভি দেখা, মোবাইলে দীর্ঘক্ষণ এমনকি অনেক রাত জেগে কথা বলা, ছেলে বন্ধুদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, নিজেকে বয়সের তুলনায় অনেক বড় এবং পরিপক্ক মনে করা ইত্যাদি। বিষয়গুলো দিন দিন বেড়েই চলছে। এসব দেখে আমরা নিজেদের সান্তনা দেই, ‘বয়সের দোষ’ ‘কৈশোরকালীন চাহিদা’ ইত্যাদি নাম দিয়ে। কিন্তু এগুলোর পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় চোখে পড়ে যেগুলো বাবা-মা হিসেবে বাঁধা না দিয়েও পারা যায় না। যেমন, এই বয়সে কোন ছেলের প্রেমে পড়ে যাওয়া, যার অসংখ্য খারাপ দিক বা দোষ জেনেও সেগুলোর প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা। থাকে কেবল দূরন্ত প্রেম। নিজের আর্থ-সামাজিক পদমর্যাদা কোনো কিছুই এই প্রেমে পাত্তা পায় না। এমনকি সেই ছেলে তাকে ধোঁকা দিচ্ছে এটুকু বোঝার মতো অনেক প্রমাণ থাকলেও অবুঝ মন কেবল ভালোবাসায় দেখতে পায়।
এক্ষেত্রে বাব-মা যতোই তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন ততই তারা হয়ে যায় তার শত্রুপক্ষ। মেয়েটির কৈশোর পর্যন্ত বাবা-মা যে অঢেল নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়েছে সেগুলো একেবারেই মূল্যহীন হয়ে যায়। কিছু কিছু মেয়ে খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে যা বাবা-মা’র জন্য অত্যন্ত ভীতিকর। যেমন, বাসা ছেড়ে চলে যাবে এমন ভয় দেখানো, বাবা-মা’র কোনো কথাই বিশ্বাস না করা, তাদের ভয় ও চাপ দিয়ে নিজের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাজ করানো, আত্মহত্যার হুমকি দেয়া, বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়া, আত্মহননের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া (হাত পা কাটা, প্রচুর পরিমাণে অষুধ খাওয়া), একটার পর একটা প্রেমে জড়িয়ে পড়া। যদিও প্রতিবারই বাবা-মা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে, তারপরও সে বাবা-মা’র বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা। এরা প্রচুর মিথ্যে কথা বলে এবং অভিনয় করে, অস্থিরতায় ভোগে, খাওয়া বা ঘুমের পরিমাণ খুবই কম, অনেক দামী জিনিস (পোশাক, প্রসাধনী) কিনে কিন্তু অবহেলায় ফেলে রাখে।
উপরে উল্লেখিত মানসিকতার মেয়েরা মানসিকভাবে সুস্থতার সীমা রেখায় পড়ে না। এরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেকে বেশ মেধাবী ছাত্রীও হয়ে থাকে। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এরা সমস্যা তৈরি করতে অত্যন্ত পটু। অনেক কাণ্ড ঘটানোর পরও এদের মাঝে অপরাধবোধ খুব একটা থাকে না বরং মনে মনে ব্যাপারগুলো বেশ উপভোগ করে থাকে।
যাই হোক, এ ধরনের কন্যা সন্তানদের পিতা-মাতারা হতভাগ্যের মতো দিশেহারা হয়ে পড়েন। কী করবেন আর কী করবেন না তাও বুঝে উঠতে পারেন না। কেবল মেয়ের পেছনে পেছনে ছুটে বেড়ানো ছাড়া এদের আর কোনো রাস্তা থাকে না। সারাক্ষণ এই বাবা মায়েরা খুঁজে ফেরেন কিছু প্রশ্নের উত্তর- কেন তাদের মেয়েটি এমন হলো? নিজেদের কোনো ভুল বা অপরাধের শাস্তি স্রষ্টা তাদের দিচ্ছেন? কী করলে তাদের মেয়ে ঘরে ফিরবে? তাদের বিশ্বাস করবে ভালোবাসবে? মেয়েটির ভবিষ্যৎ কী? কোথায় এই সমস্যার শেষ?
লেখার শুরুতে যে সীমারেখার কথা বলা হয়েছে এরা সেই সীমারেখার ঠিক উপরে পা রেখে চলাচল করা জনগোষ্ঠী যাদের সুস্থ বলা যায় না আবার অসুস্থও বলতেও চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন। এদের সমস্যামূলত তাদের ব্যক্তিত্বের গঠন প্রক্রিয়ার জটিলতায় নিহিত। অর্থাৎ মানুষটির চিন্তন প্রক্রিয়া এবং চারিত্রিক গঠন প্রক্রিয়ায় বেশ অসামঞ্জস্য রয়েছে। এর কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের বেশ কিছু দিকে নজর দিতে হবে। বংশগতি বা জেনেটিক কারণ, বাবা-মায়ের সাথে ছোটবেলা থেকেই সম্পর্কের ঘাটতি, অতীত জীবনে বিভিন্ন প্রকার নির্যাতনের শিকার ইত্যাদি। যদিও বিশেষ কোনো কারণ এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। তবে সমস্যা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই হয় তা নয়, ছেলেদেরও হয়। এ ধরনের সন্তান যাদের ঘরে রয়েছে তাদের প্রতি এতটুকু বলার আছে, কারণ যাই হোক না কেন সন্তানটিকে ঠিক করা অথবা সুস্থ করা আপনাদের একার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। সম্ভব হলে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। লুকানোর চেষ্টা করবেন না, কেননা আশেপাশের সবাই কিছুটা হলেও বুঝে যায় যে আপনার সন্তানটি নিজের বা পরিবারের মান সম্মানের বিষয়টি তোয়াক্কা করে না।
আপনার ছোট্ট যে সন্তানটি অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে জড়িয়ে ধরতো আপনাকে সে আজ নিজেই অন্ধকারে পা বাড়িয়ে দিয়েছে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও। সে সুস্থতা ও অসুস্থতার অতি সূক্ষ্ণ সীমারেখার উপর দিয়ে হাঁটছে। তাকে শক্ত করে ধরে নিয়ে আসুন হাজার তারার আকাশের নিচে, যেখানে শুধু আলো আর আলো।
তামিমা তানজিন
কনসাল্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট
প্রত্যয় মেডিকেল ক্লিনিক
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।
ki korle er shomadahan pawa jai ta na likhle ei bal pore ki hobe!