মাদক নিয়ন্ত্রণ অথবা মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আপাত দৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও কাজটা আসলে অত্যন্ত কঠিন এবং দুরূহ। সমস্ত পৃথিবী আজ মাদকের জালে আবদ্ধ। এশিয়া থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা হয়ে ওশেনিয়া, সর্বত্রই মাদকের করাল থাবা।
এক সময় আমরা হিরোইন নিয়ে মহাবিপদে থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় আমাদের দেশে মাদকের ধরন পাল্টেছে, মহামারি আকারে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে। এমনকী আমেরিকাও এখন নিজ দেশে অফিয়াম নেশার আতঙ্কে, জরুরি অবস্থায়। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে মাদক নিয়ন্ত্রণে বিমান থেকে ফেলে দেওয়া বা গুলি করে মেরে ফেলার যে নীতি বা অপনীতি গ্রহণ করেছেন তা যে সঠিক নয় তা সময়ই বলে দিচ্ছে। আমাদের দেশেও দেখা যায় রাজনৈতিক বক্তৃতায়- ‘মাদক সরবরাহকারী যদি একশ হাত মাটির নিচে থাকে সেখান থেকেও ধরে আনা হবে‘। এসব রাজনৈতিক বক্তৃতা বা অপরিকল্পিত ব্যবস্থা মাদক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা না রেখে বরং সংঘাতের সৃষ্টি করে।
বিশ্বের কোথাও আছে কিনা জানি না, আমাদের দেশে দেখা যায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য বিষয়ে পরামর্শ না দিয়ে শুধু মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবারকে ডেকে নিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে এই সমস্ত স্বঘোষিত ব্যবস্থায় পরিবারের লাভ হচ্ছে, নাকি মাদকাসক্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি মাদক নিতে উৎসাহিত হচ্ছে তা ভেবে দেখা উচিৎ।
আমাদের জানতে হবে মাদক শুরুর জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থাৎ শতকরা ৬১ ভাগ ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির ডিএনএ পলিমরফিজম (DNA polymorphism), মাইক্রো স্যাটেলাইট মার্কার (Micro Satellite markers) অথবা সিঙ্গেল নিউক্লিওটাইড পলিমরফিজম (single nucleotide polymorphism) দায়ী এবং মাত্র ২৮ ভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশ পারিপার্শিকতা দায়ী (Agrawal et al, 2005)। তাই মাদক বা মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের আগে মাদকাসক্তির জন্য দায়ী কোন ধরনের উপকরণগুলো আসলেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য তা ভেবে দেখতে হবে।
মাদকের সরবরাহ একমাত্র একটি দেশের নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব। মাদকাসক্তি কমাতে হলে মাদকের সরবরাহ অবশ্যই কমাতে হবে। কারণ মাদকাসক্তি একটি পুনঃপুনঃ আসক্তি হওয়ার মত রোগ।
প্রতিদিন নতুন নতুন মাদকাসক্ত তৈরি হচ্ছে এবং অপরিকল্পিত চিকিৎসার কারণে চিকিৎসা নিয়েও একটা বিরাট অংশ পুনরায় আসক্তিতে জড়াচ্ছে। এই সমস্যাকে একটা জাতীয় সমস্যা মনে করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে ব্যক্তি, পরিবার এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
আমাদের দেশে প্রতিটি পরিবারে সন্তানেরা যেভাবে দীর্ঘ বছর পারিবারিক সান্নিধ্যে থেকে বেড়ে উঠে তা কাজে লাগিয়ে প্রত্যেকটা পরিবার মাদকাসক্তি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে এবং সন্তান লালন পালনে অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। সন্তান পুরোপুরি মাদকাসক্ত হওয়ার আগেই অভিভাবকের উচিৎ একজন মনোবিজ্ঞানী, মনোচিকিৎসক অথবা মাদক বিষয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া । আমাদের দেশে এই সেবাগুলো এখন অত্যন্ত কম খরচে হাতের কাছেই পাওয়া যায়। একবার মাদকাসক্ত হলে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা ছাড়া পুনঃআসক্তি রোধ করা অত্যন্ত কঠিন। তাই মাদকাসক্ত হওয়ার আগেই অর্থাৎ শুরুর আগে, শুরুতেই অথবা যে অবস্থায় মনে হয় মাদক নিচ্ছে সেখানেই আটকাতে হবে।
বলা হয়ে থাকে ধূমপান, মদপান দিয়েই মাদকের শুরু হয়, এরপর গাঁজা এবং পরবর্তীতে অত্যন্ত আসক্তিকর মাদকে জড়িয়ে পড়ে এবং মাদকাসক্ত হতে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তাই পরিবার সচেতন হলে মাদকাসক্ত হওয়ার অনেক আগেই এটাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে পিতা-মাতার মনিটরিং, মাদকমুক্ত পরিবেশ, সন্তানের সাথে গুণগত সম্পর্ক এবং মাদকের প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
‘জিন’ মাদকের শুরুতেই যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শুধু তাই নয়, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মাদকাসক্তি চালিয়ে যেতে একমাত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করে। VATSPUD (Virginia Adult Twin Study of Psychiatric and Substance Use Disorders) ও বিশ্বের এ জাতীয় বড় গবেষণা থেকে আমরা জানি মাদকাসক্তি হওয়ার জন্য শতকরা ৬০-৭৫ ভাগ ‘জিন’ই দায়ী, যেহেতু ‘জিন’ ছাড়াও আরো কিছু ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ মাদকাসক্তিতে ভূমিকা রাখে সুতরাং আমরা ইচ্ছা করলেই এই মুহূর্তে মাদকাসক্তির জন্য ঝুকিপূর্ণ সব কিছু পরিবর্তন করতে পারব না। তাই খোলা আকাশে পরামর্শ না দিয়ে আমাদেরকে সঠিক সংবাদটি সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে।
পারিবারিক মনিটরিং ছাড়াও ধর্মীয় পরিবেশে সন্তানকে বড় করে মাদকাসক্তি তৈরিতে অপ্রতিরোধ্য ‘জিনের’ ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব (Koopmans, Slutske, Vanbaal, & Boomsma, 1999. Dick et al, 2007)।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে