‘সোনার চামচ’ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া বলতে যা বোঝায়, আবিরের জন্ম ঠিক তেমনটাই। বিত্তবান বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, ঐশ্বর্যের অভাব ছিলনা কখনোই। কিন্তু অভাব ছিল বাবা-মার সময়ের। ব্যস্ত ব্যবসায়ী পিতা তাঁর সম্পদের পাহাড় আরো উঁচু করার চেষ্টায় সদা সচেষ্ট। সকাল থেকে রাত অবধি তাঁর কাজ আর কাজ। ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। সকালের নাস্তা কখনও সখনো বাড়িতে করা হলেও বাকি বেলার খাবার তাঁর অফিস বা ব্যবসায়িক কোনো মিটিং-কনফারেন্সেই করা হয়। ব্যবসায়ের অন্যতম সক্রিয় অংশিদার তাঁর স্ত্রীও। জন্মের পর থেকেই আবিরের খাওয়ানো-পড়ানো, বেড়ে উঠার তদাররিক ভার মোটা বেতনে নিয়োগ করা পেশাদার কেয়ারটেকারের হাতে। নিজেদের সময়ের অভাবটাকে বাবা-মা প্রাচুর্য্যের প্রাবল্যে ঢেকে রাখতে চাইতেন সব সময়। তাই চাহিদা থাকুক আর না থাকুক, চাওয়ার আগেই অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করা সম্ভব এমন সব কিছুই পাওয়া হয়ে যেতো তার। ব্যবসায়ে সময় দিতে গিয়ে দ্বিতীয় সন্তান আর নেননি আবিরের বাবা-মা। একমাত্র সন্তান বলে আবিরও বেড়ে উঠেছে অবাধ স্বাধীনতায়। আর এই অবারিত স্বাধীনতাই এক সময় আবিরকে নিয়ে দাঁড় করায় চরম ধ্বংসের মুখোমুখি।
আবিরের হাত খরচের জন্য নেয়া টাকার পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকে। অ্যাকাউন্টেন্ট আর কেয়ারটেকার কথাটি বাবা-মার কানে তোলার চেষ্টা করেন, বাবা-মা সাফ জানিয়ে দেয় তাদের সকল আয় রোজগার তো ছেলের জন্যই- তাদের আয় তো ছেলেই খরচ করবে। কলেজ পড়ুয়া ছেলে বাড়ি ফেরার সময় পেছাতে পেছাতে মাঝ রাত পার হয়, বন্ধু বান্ধবের সাথে সন্ধ্যা বা রাতে পার্টি হয় ঘনঘন। বাবা-মা বলেন, এই বয়সেই তো জীবনটা উপভোগ করবে, করুক না। বাবা-মা এই ভেবে খুশি থাকেন যে, ছেলে বন্ধু বান্ধব নিয়ে ব্যস্ত আছে, ভালোই আছে! অন্ততঃ বাবা-মায়ের কাজের সময়ে তো আর ভাগ বসাচ্ছে না। ছেলের পেছনে ব্যয় করার জন্য তাঁদের কাজের সময় তো আর সংকুচিত হচ্ছে না। ছেলের পেছনে ব্যয় করার জন্য অঢেল সম্পদ তাঁদের রয়েছে, কিন্তু সময় নেই এতটুকুও।
তথাপি কিছুটা মনোযোগ দিতে হয় তাঁদের তখনই- যখন স্থানীয় থানার ওসি ফোন করে তাঁদের জনান তাঁদের ছেলে এখন হাজতে। নেশা করে এলোপাতাড়ি গাড়ি চালিয়ে দুই পথচারীকে চাপা দেয়ায় জনতা পিটুনি দিয়ে তাকে বন্ধু সহ সোপর্দ করেছে থানায়। টাকার জোরে সে যাত্রার ফাঁড়া কাটান বাবা। নেশা করেছে শুনে কিছুটা চিন্তিত হলেও ছেলে যখন তাঁদের আশ্বস্ত করে বলে সে নেশা করেনি, কেবল নতুন গাড়ি চালানো শিখতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে, বাবা-মা ব্যাপারটি তুচ্ছজ্ঞান করে উপেক্ষা করে যান। তবে, ছেলেকে নিজেদের মান-সম্মানের কথা মনে করিয়ে সাবধানে চলাফেরার উপদেশটা দিয়ে দেন।
ছেলের প্রতি আবারো মনোযোগ দিতে হয়, যখন দ্বিতীয়বার থানা থেকে ফোন আসে। এবার নেশার উপকরণ আর তিন বন্ধু সহ ধরা পড়েছে তারা। তবে ছেলে নেশা করছে এ ব্যাপারটি তখনও বিশ্বাস হয় না তাঁদের। ছেলের তো টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই- সে কেন নেশা করবে! তবুও পুলিশ আর প্রভাবশালী বন্ধুদের পরামর্শে অনেকটা নিমরাজি হয়েই বাবা-মা তাকে নিয়ে যান একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। পরীক্ষায় আবিরের দেহে মাদকের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। এবার সে মাদক নেয়ার কথা স্বীকার করে বাবা-মার কাছে। বলে, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এই প্রথমবারের মতো ভুলে মাদক নিয়ে ফেলেছিল সে। প্রতিজ্ঞা করে আর কখনও মাদক নেবে না। ডাক্তার বুঝতে পারেন কথাটি মিথ্যা, অনেকদিন ধরেই নেশায় আসক্ত আবির। কিন্তু আবিরের বাবা-মাকে তা বোঝাতে ব্যর্থ হন তিনি। তারা ছেলের উপর আস্থা রাখেন এবং ছেলের বন্ধুদের উপর দায় চাপান। ‘একবার’-এর ঐ ভুলকে ভুলে যেতে চান আবিরের বাবা-মা। ছেলে ইচ্ছে করলেই নেশা থেকে দূরে থাকতে পারবে এই বিশ্বাসে বিশেষজ্ঞের দেয়া চিকিৎসা পরামর্শ উপেক্ষা করে যান। ছেলেকে একটি অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান।
কিছুদিন পর আবির পড়ালেখা ছেড়ে অধিকাংশ সময় ঘরের এক কোণে কাটাতে শুরু করে। পার্টি, আড্ডায়ও যায় না আর। কয়েকদিন পর পর বাইরে যায় অথবা কেউ তার সাথে দেখা করতে আসে। বাকীটা সময় একা ঘরের চার দেয়ালে নিজেকে বন্দী করে রাখে সে। খাওয়া-ঘুম কমে যায়। স্বাস্থ্যের লক্ষণীয় অবনতি হতে থাকে। ঘরের কারো সাথেও তেমন কথা বলে না সে। কর্মচারীরা কেউ কিছু বলতে গেলে তাদের দিকে তেড়ে আসে, গায়ে হাত তোলে। বাবার নির্দেশে অ্যাকাউন্টেন্ট টাকা দেয়া বন্ধ করলে ঘরের দামী জিনিষপত্র নিয়ে বিক্রি করা শুরু করে সে। কর্মচারীদের কাছ থেকে এসব শুনে বাবা-মা তার সাথে কথা বলতে গেলেও সে দরজা বন্ধ করে রাখে। বাধ্য হয়েই দরজা ভাঙ্গার উদ্যোগ নিতে হয় তাদের। এ পর্যায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আবির আক্রমণ করে বসে বাবা-মাকেই।
অবশেষে বাধ্য হয়ে টনক নড়ে তাঁদের। যেদিন স্বেচ্ছায় বাইরে যায়, আবিরের পিছু নিয়ে দেখা যায় সে যাচ্ছে মাদক সংগ্রহের জন্য। নেশার উপকরণ নিয়ে এসে কদিন সে তাতেই বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে। এতদিনে বাবা-মা বিশ্বাস করতে বাধ্য হন, তাঁদের ছেলে মাদকাসক্ত। আবারও সেই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করেন তাঁরা। কিন্তু আবিরকে সঙ্গে নেয়া সম্ভব হয় না। নেয়া দূরের কথা, আবিরের সাথে এখন কথাই বলতে পারে না কেউ। একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সহযোগিতায় জোর করে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে ভর্তি করানো হয় সেখানে। চিকিৎসকরা জানান, অনেকদিন ধরে মাদকে আসক্ত থাকার ফলে আবিরের মানসিক ভারসাম্যহীনতাও দেখা দিয়েছে। ব্যাপারটি এখন শুধু মাদকাসক্তিতেই সীমাবদ্ধ নেই, মস্তিষ্কের রাসায়নিকের দীর্ঘ পরিবর্তনে জটিল হয়েছে তা।
আবিরের বাবা-মায়ের মতোই অনেক অভিবাবক সন্তানকে প্রাচুর্যে ঢেকে দেন, কিন্তু পারিবারিক বন্ধন বলতে যা বোঝায় তা গড়ে উঠে না। সন্তানের ব্যাপারে তাঁরা যেমন খোঁজ খবর রাখেন না। নিজেদের ব্যস্ততার কারণে সন্তানের সাথে বন্ধু সুলভ সম্পর্কও গড়ে ওঠে না। এরই সুযোগে নিষিদ্ধ জগতে পা বাড়ায় সন্তান। বাবা-মায়ের সাথে দূরত্ব আরো বাড়ে। অনেকে আবার সন্তানের মাদকাসক্তির ব্যাপারটি জানতে পারলেও তাতে গুরুত্ব দেন না বা বিশ্বাস করেন না। ফলে মাদকাসক্তি প্রাথমিক পর্যায় পেরিয়ে জটিল আকার ধারণ করে। তখন চিকিৎসা করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
মাদকাসক্তি রোধে বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। নিজেদের ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানের জন্য আলাদা সময় দিতে হবে। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ খোলামেলা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা বাবা-মার কাছে সব কথাই নিঃসংকোচে বলতে পারে। তাহলে সন্তান ভুল পথে পা বাড়ানোর সময়টাতেই বাবা-মা তা জানতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবেন। আর সন্তানের মাদকাসক্তির ব্যাপারটি জানতে পারলে প্রাথমিক অবস্থাতেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। দীর্ঘ মেয়াদী মাদকাসক্তি শারীরিক-মানসিক নানা জটিলতা তৈরি করে। তখন চিকিৎসায় তেমন সুফল পাওয়া না-ও যেতে পারে।
বাকিটা কবে লিখবেন ??