মাঙ্কিপক্স। করোনা মহামারির পর নতুন করে আতঙ্ক তৈরী করছে মাঙ্কিপক্স। আফ্রিকার বাইরেই এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৮টি দেশে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও এখনো কোনো মাঙ্কিপক্স রোগী শনাক্ত হয়নি। তবে দেশব্যাপী যেন কোনোভাবেই এ রোগটি ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য নেয়া হয়েছে বাড়িতি সতর্কতা। বিমানবন্দরগুলোতে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
তবে সতর্কতার পাশাপাশি আতঙ্কিত না হতে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কেন আতঙ্কিত হবো না এবং আক্রান্ত হয়ে গেলে কী করণীয়? সতর্কতার স্বার্থেই সেসব বিষয়ে আমাদের জানা থাকা দরকার। চলুন জেনে নেয়া যাক।
মাঙ্কিপক্স কী?
মাঙ্কিপক্স একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এ রোগে সাধারণত শরীরে ফুসকুরি জাতীয় সমস্যা হয়। যা দেখতে অনেকটা গুটি বসন্ত বা চিকেনপক্স‘র মতো। ১৯৫৮ সালে বানরের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে এর নাম হয় ‘মাঙ্কিপক্স’। মানব শরীরে এটি প্রথম ধরা পড়ে ১৯৭০–এর দিকে কঙ্গোতে।
কখন বুঝবেন মাঙ্কিপক্স হয়েছে?
মাঙ্কিপক্সের লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করে সহজেই এ রোগটি নির্ণয় করা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে প্রাথমিক উপসর্গের মধ্যে রয়েছে:-
• জ্বর,
• মাথাব্যথা
• পিঠ ও গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা
• কাপুনি ও ক্লান্তি
• দেহের বিভিন্ন লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠে
• মুখে ছোট ছোট ক্ষতচিহ্ন (যা ধীরে ধীরে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে)
• ফাটা বা অমসৃণ খসখসে ত্বক
কীভাবে ছড়ায়?
মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটি বায়ুবাহিত এবং প্রায় চার দিন পর্যন্ত বাতাসে টিকে থাকতে পারে। এর অর্থ এই সময়কালে এটি সংক্রামকও হতে পারে। মাঙ্কিপক্স সংক্রমিত কারো ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে সেটা অন্যের দেহে ছড়াতে পারে। ফাটা বা কাটা চামড়া, চোখ, নাক বা মুখ দিয়ে মানুষের দেহে ঢুকতে পারে মাঙ্কিপক্স।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মাঙ্কিপক্স রোগ মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। যাদের লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে এটি হচ্ছে।
ডব্লিউএইচওর সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডেভিড হেম্যান জানিয়েছেন, এটি যৌন সংক্রমণের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। এটা যৌনবাহিত রোগের মতোই সংক্রমিত হচ্ছে, যা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। যৌন ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে মাঙ্কিপক্স ছড়াচ্ছে। আর আক্রান্তদের বেশিরভাগেরই যৌনাঙ্গ এবং তার আশপাশের জায়গায় গুটি হয়েছে।
এছাড়াও শ্বাসতন্ত্র অথবা চোখ, নাক ও মুখ, সংক্রমিত প্রাণীর কামড়, আক্রান্ত প্রাণী অথবা মানুষের রক্ত, শরীরের তরল বা পশম স্পর্শ করা, সংক্রমিত প্রাণীর মাংস সঠিকভাবে রান্না ছাড়া খাওয়া হলে, ফুসকুড়ি রয়েছে এমন কারও ব্যবহৃত পোশাক, বিছানা অথবা গামছা স্পর্শ করা, মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কারও ত্বকের ফোসকা অথবা খোসপাঁচড়া স্পর্শ করা অথবা সংক্রমিত ব্যক্তির কাশি ও হাঁচির খুব কাছাকাছি যাওয়ার মাধ্যমে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে।
কারা বেশি আক্রান্ত হয়?
প্রথম কথা হলো যে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্ষে এলে কিংবা পোশাক ব্যবহার করলে যে কারোর এ রোগ হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্বে যারাই আক্রান্ত হয়েছে দেখা গেছে সবাই সমকামী বা উভকামী এবং যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেই পরস্পর আক্রান্ত হয়েছে।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এ পর্যন্ত ১৬টি দেশে অন্তত ১৬১ জন মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছে। এদরে মধ্যে প্রায় সবাই পুরুষ এবং সমকামী। রোগটির উৎস বা আবাসস্থল আফ্রিকা হলেও বর্তমানে এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর জানান, সমকামিতা হয়তো একটি কারণ হতে পারে তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়। বাংলাদেশে যেহেতু সমকামিতার বিষয়টি কম। সেই নিরিখে এটা ঠিক, এখানে এর ঝুঁকি কম। তবে, বাংলাদেশে সার্বিকভাবেই এ ভাইরাস নিয়ে ঝুঁকি কম।
যেহেতু বিশ্বের সব যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় উন্মুক্ত, সবাই সব জায়গায় যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষও আফ্রিকা বেড়াতে যাচ্ছে, তাই যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো সময় এটা চলে আসতে পারে। তবে, একটা কথা মনে রাখতে হবে, এ ভাইরাস সহজে ছড়ায় না। আক্রান্ত কারও সরাসরি সংস্পর্শে না এলে ভাইরাসটি ছড়ানো মুশকিল।
আক্রান্ত হলে করণীয় কী?
প্রথম করণীয় হলো চিকিৎসকের পরামর্শ। তবে এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এর কোনো টিকা বা প্রতিষেধক নেই। তবে গুটিবসন্তের টিকা গ্রহণ করা যেতে পারে। গুটিবসন্তের টিকা মাঙ্কিপক্স সারাতে বেশ কার্যকর ভুমিকা পালন করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে শতকরা ৮৫ ভাগ কার্যকর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ কে লুৎফুল কবির বলেন, মাঙ্কিপক্সের উল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে বা শরীরে ফুসকুড়ি–জাতীয় কিছু হলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে আইসোলেশনে রাখা উচিত।
যেহেতু ‘মাঙ্কিপক্স’ মূলত গুটিবসন্ত বা চিকেনপক্স গোত্রের রোগ, তাই বেশির ভাগ রোগীই সুষম খাবারদাবার গ্রহণসহ পরিমিত বিশ্রাম নিলে চিকিৎসা ছাড়াই দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
অর্থাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আইসোলেশনে থেকে গুটি বসন্তের টিকা নেয়া যেতে পারে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটুকু?
আইসোলেশনে থেকে সুষম খাবার ,পরিস্কার-পরিচ্ছন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এরোগটি সেরে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্সের একটি রূপ এতই ভয়ংকর, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১০ শতাংশ মারাও যেতে পারেন। অন্য রুপটি আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১ শতাংশের মৃত্যুঝুঁকি তৈরী করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের কঙ্গো প্রজাতি ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি নামক দুই প্রজাতির সন্ধান মিলেছে। এই দুইয়ের মধ্যে কঙ্গো প্রজাতির চেয়ে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতির তীব্রতা তুলনামূলক কম। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে কঙ্গো প্রজাতিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশের বেশি। তবে বাচ্চাদের মৃত্যুর আশঙ্কা আরও বেশি।
অন্যদিকে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার ১ শতাংশের মতো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠিক কোন প্রজাতির মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের দ্বারা রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তা সঠিকভাবে এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। তবে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সংস্থা।
যেহেতু ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার কোনো উপায় নেই। সেহেতু অন্যান্য ভাইরাসের মোকাবিলার মতো উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে এর প্রকোপ কমানো যাবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে যান। সুতরাং ভয় বা আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা অবলম্বন করলে এর থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব।
যেসব দেশে শনাক্ত হয়েছে
মঙ্গলবার (২৪ মে) গ্লোবাল ডট হেলথের বরাতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, আফ্রিকার বাইরে প্রথম মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় যুক্তরাজ্যে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৫৬ জনের এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া স্পেনে ৪১ জন, পর্তুগালে ৩৭ জন, কানাডায় ৫ জন, ইতালিতে ৪ জন, বেলজিয়াম ও জার্মানিতে ৩ জন করে, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রে ২ জন করে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর বাইরে অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইসরায়েল, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ডে ১ জন করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে বিবিসি জানিয়েছে গত মঙ্গলবার আরব আমিরাতেও ১ জন শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভেনিয়াতেও রোগটি শনাক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্স
গত সোমবার (২৩ মে) বিকেলে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন ডা. আসিফ ওয়াহিদ এর নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে মাঙ্কিপক্স রোগী পাওয়া গেছে বলে একটি স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। এরপর থেকে ডা. আসিফ ওয়াহিদ সূত্রে মাঙ্কিপক্স শনাক্তের কবর ছড়িয়ে পড়ে।
তবে খবরটি সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, এখানে কোনো মাঙ্কিপক্সের রোগী পাওয়া যায়নি। এ ধরনের গুজবে কান দেবেন না।
পরে অবশ্য ডা. আসিফ ওয়াহিদ জানিয়েছেন স্টাটাস দেওয়া ওই আইডি তার নয়। অর্থাৎ এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্স রোগী শনাক্ত হয়নি।
তবে বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলছেন। বিশেষ করে বিমানবন্দর, স্থলবন্দর এবং যতগুলো বহিআগম বন্দর আছে সবখানে সতর্কতার সাথে নজর রাখতে হবে। সক্রংমণ এড়াতে দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পেলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তারপর কাউকে অনমতি দিতে হবে। এবং শনাক্ত কাউকে পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে আইসোলেশনে পাঠাতে হবে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, জাগো নিউজ, বাংলা ট্রিবিউন
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে
/এসএস