মন ও ত্বকের পারস্পরিক যোগাযোগ

0
51
মন ও ত্বকের
মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মানসিক চাপের প্রভাবের কথা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই প্রভাব শুধুমাত্র আমাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপরেই পড়ে না, সেই সঙ্গে আমাদের ত্বকের উপরেও পড়ে। অর্থাৎ মন ও ত্বকের রয়েছে পারস্পরিক যোগাযোগ।

মন ও ত্বকের এই পারস্পরিক যোগাযোগ এর বিষয়ে বোঝার জন্য সম্প্রতি ইন্ডিয়ান টাইমসে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ ডার্মাটোলজির আর্ন্তজাতিক গবেষক ডাক্তার অনঘ কুমারের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। মনের খবর পাঠকদের জন্য সেটি তুলে ধরা হল:

মস্তিষ্ক ও ত্বকের মধ্যে ঠিক কীরকম যোগাযোগ রয়েছে?
মস্তিষ্ক এবং ত্বকের মধ্যে একপ্রকার শক্তিশালী বাহ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের  গর্ভাবস্থায় যখন ভ্রূণের বিকাশ ঘটে তখন প্রথম এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সাধারণত একই পর্যায়ের কোষের থেকে আমাদের মস্তিষ্ক এবং ত্বক গঠিত হয়। একে বলা হয় এক্টোডার্ম লেয়ার বা আস্তরণ, যার ফলে প্রাথমিকভাবে মস্তিষ্ক ও ত্বকের মধ্যে  একপ্রকার মানসিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

আমাদের মানসিক অনুভূতির প্রতিফলন কি ত্বকের উপরে পড়ে?
যখন আমরা বিব্রত হই তখন আমাদের চোখেমুখে হতচকিত ভাব ফুটে ওঠে। এটাই তো আমাদের একপ্রকার মনের অনুভূতি, যা ত্বকের উপর প্রতিফলিত হওয়ার লক্ষণ জানান দেয়। ঠিক একইভাবে মানসিক চাপের প্রভাবে মন ও ত্বকের নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলুন যে আমাদের ত্বকের উপরে মানসিক চাপের প্রভাব কেমন হয়?
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে লাগাতার মানসিক চাপের ফলে মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে। ফলে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আমাদের ত্বকের  কার্যকারীতার উপরেও তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। আবার ত্বকের রোগ প্রতিরোধক কোষ মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এই ধরনের রিসেপটর এবং রাসায়নিক পদার্থের আদান-প্রদানকে নিউরোপেপটাইডস্‌ বলা হয়। ত্বকে অবস্থিত অন্যান্য বস্তুরা কীভাবে মানসিক চাপের দ্বারা প্রভাবিত হয় তা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। সেই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে লাগাতার মানসিক চাপ আমাদের ত্বকের সামগ্রিক অবনতি ঘটায়।

তার মানে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার কারণে আমাদের ত্বকে তার প্রতিক্রিয়া ঘটে?
ত্বকের অসুখে মনোরোগের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় এবং কিছু মনোরোগের বহিঃপ্রকাশ আমাদের ত্বকের উপরেও পড়ে। ঠিক একইভাবে কয়েকটি ত্বকের সমস্যা যেমন- ব্রণ এবং সোরিয়াসিস মূলত মানসিক চাপের দ্বারা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এসব কারণে ত্বক ও মনের পারস্পরিক যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ হয়। একে সাইকোডার্মাটোলজিক সমস্যা বলা হয়।

সাইকোডার্মাটোলজিক সমস্যার বিষয়ে আপনি সংক্ষেপে আমাদের কিছু বলতে পারেন?
হ্যাঁ, সাইকোডার্মাটোলজিক সমস্যা হল আমাদের ত্বক ও মনের পারস্পরিক জটিলতা। এই সমস্যা তিনভাগে বিভক্ত:
১. সাইকোফিজিওলজিক সমস্যা- এই ধরনের সমস্যার একটা মনোগত ভিত্তি রয়েছে এবং মানসিক চাপ ও অন্যান্য মনোগত কারণে সেই সমস্যার আরও অবনতি ঘটে। যেমন- এক্‌জেমা এবং সোরিয়াসিস
২. মনোরোগ সংক্রান্ত সমস্যার কারণে ত্বকের জটিলতার লক্ষণ-
উদাহরণ- ট্রাইকোটিল্লোম্যানিয়া- অনবরত চুল-টানা।
ডিলিউশন অফ প্যারাসাইটোসিস- এই অবস্থায় মানুষ নিজেকে তুচ্ছ এবং পরাশ্রয়ী বলে মনে করে। যদিও সে আদৌ তেমন প্রকৃতির হয় না।
বডি ডিসমরফিয়া- যেখানে মানুষের মনে তার দেহের ত্রুটি সম্পর্কে পূর্বনির্ধারিত ধারণা জন্মায়।
৩. ত্বকের সমস্যা সহ মানসিক লক্ষণ- যেখানে মানসিক জটিলতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নির্দিষ্ট ত্বকের সমস্যা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে মানসিক চাপের কারণ হিসেবে কলঙ্কের বোধ দায়ী থাকে।
উদাহরণ- ভিটিলিগো (শেতী), সোরিয়াসিস, অ্যালিবিনিজম, এক্‌জেমা।
৪. মিসসেলানিয়াস- এই ধরনের সমস্যার মধ্যে রয়েছে মনোরোগ এবং ত্বক সংক্রান্ত ওষুধের বিপরীত প্রতিক্রিয়া।

আপনার কি কখনও কখনও মনে হয় যে মানুষ খুব সাধারণ এবং ক্ষতিকর নয় এমন ত্বকের সমস্যার কারণে মানসিকভাবে অস্থির বা অধীর হয়ে ওঠে?
বহু বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েরাই ব্রণ-র সমস্যা নিয়ে মানসিক চাপে ভোগে। তারা এই সমস্যার হাত থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেহাই পেতে চায়। তারা ব্রণ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকে আর তাড়াতাড়ি ব্রণ-ফুসকুড়ির হাত থেকে মুক্ত হওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু এই অহেতুক মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের পিছনে তেমন জোরদার কোনও কারণ থাকে না। আসলে ব্রণ হল হরমোনের পরিবর্তনের বহিঃপ্রকাশ এবং অধিকাংশের ক্ষেত্রেই জীবনে এই সমস্যা একবার দেখা দেয়। ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে এই সমস্যার প্রকোপ কমতে থাকে। এই সমস্যা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা এবং ব্রণ বা ফুসকুড়ি নিয়ে খোঁচাখুচি করার ফলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে।

ত্বকের সমস্যার কারণে যে ধরনের চিন্তা বা উদ্বেগ মানুষের মনে জন্মায় তা কি শেষমেশ মানসিক চাপের আকার নেয়, যার ফলে জীবনটা একেবারে দুর্বিষহ হয়ে যায়?
হ্যাঁ। এমন অনেক মানুষ থাকে যারা ব্রণ, অনুজ্জ্বল চুল, ভিটিলিগো বা শেতীর কারণে আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে পড়ে। কারণ তারা ভাবে যে এসব কারণে তাদের  বাহ্যিক সৌন্দর্য কমে যাচ্ছে। কিছু লোকের মধ্যে আবার নির্দিষ্ট কয়েকটি ত্বকের সমস্যা দেখা দিলে মনে বিষণ্ণতা বা রাগ জন্মায়। এসব সমস্যার কারণে সমাজ একজন মানুষকে কী চোখে দেখবে সেই নিয়ে তার মনে চিন্তা জন্মায়। এই পরিস্থিতিতে পারিপার্শ্বিক মানুষজনের উচিত সমস্যায় আক্রান্ত মানষের সঙ্গে সময় কাটানো। একজন চিকিৎসকের কর্তব্য হল এসব বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত করে  উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তাদের সঙ্গে ডাক্তারের কথাবার্তা বলা, তাদেরকে সমস্যার বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলা এবং সাহায্যকারী দলের কাছে তাদের পাঠানো।

সেই সব অহেতুক চিন্তায় ভোগা মানুষের প্রতি আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
সমস্যা সম্পর্কে তাদের বোঝাতে হবে এবং অবস্থার উন্নতি ঘটানোর জন্য তাদের  সক্ষম করে তোলা জরুরি। সেই সঙ্গে অসুখ সম্পর্কে প্রকৃত ব্যাখ্যা করে তাদের  শিক্ষিত করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। যেমন- পৃথিবীর জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ  মানুষ তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার ব্রণ-র সমস্যায় ভোগে। এই বিষয়ে সচেতন থাকা খুবই জরুরি এবং অহেতুক মানসিক চাপ অনুভব করা একেবারেই উচিত নয়।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

 

Previous articleভালোবাসা ও মিথ
Next articleকরোনা পরবর্তী ট্রমা সামলাতে করণীয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here