ডা. মুনতাসীর মারুফ
সহযোগী অধ্যাপক, কমিউনিটি এন্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।
মানুষ বিভিন্ন কারণে ভুলে যেতে পারে। ভুলে যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ, এনকোডিং ফেইলিওর। অর্থাৎ যেকোনো তথ্য ভুলে যাওয়ার কারণ হচ্ছে তথ্যটি ব্যক্তির স্মৃতিতে প্রোথিত-ই হয়নি। আর যা মনে বা স্মৃতিতে গাঁথেনি তা মনে করতে গেলে মনে আসবে না সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই ঘটে এনকোডিং ফেইলিওরে।
কিছু ভুলে যাওয়া কেবলই সময়ের সাথে সাথে ঘটে যায়। ভুলে যাওয়ার ক্ষয় মতবাদ অনুসারে, স্মৃতিতে গাঁথা অনেক তথ্যই পুনঃচর্চা বা আলোচনার অভাবে ধীরে ধীরে স্মৃতি থেকে মুছে যায়। আবার অনেকের মতে, নতুন ঘটনা বা তথ্য এসে পুরোনো তথ্য বা স্মৃতির জায়গা দখল করায় অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো স্মৃতি মুছে যায়। কোনো তথ্য বা ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় না হলে সেটিও মানুষ ধীরে ধীরে ভুলে যায়।
ভুলে যাওয়ার ইন্টারফিয়ারেন্স মতবাদ অনুযায়ী, নতুন তথ্য বা ঘটনা পুরোনো তথ্য বা ঘটনাকে মনে করতে বাধা দেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে, পুরোনো তথ্যও নতুন তথ্যকে মনে করতে বাধা দেয়।
অনেক ক্ষেত্রে কোনো তথ্য বা ঘটনা মনে আসি আসি করতে করতেও আসে না। সেখানে কোনো একটি শব্দ বা কিউ দিলে পুরো তথ্য বা ঘটনাটি হয়ত মনে পড়ে যায়। পড়াশোনা বা পরীক্ষার ক্ষেত্রে হরহামেশাই ঘটতে দেখা যায় এমনটা। একে কিউ-ডিপেন্ডেন্ট ফরগেটিং বলা হয়।
বিভিন্ন রোগের কারণেও মানুষ ভুলে যায়। বিষণ্ণতা রোগ ভুলে যাওয়ার অন্যতম কারণ। জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার রোগেও মানুষ ভুলে যায়। ডিসোসিয়েটিভ অ্যামনেশিয়া রোগে আক্রান্তরা মানসিক কোনো চাপের কারণে সাময়িকভাবে ভুলে যায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা ব্যক্তিকে। পড়াশোনা মনে রাখতে না পারার অন্যতম কারণ হতে পারে বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা বা অন্যান্য লার্নিং ডিজঅর্ডার।
বার্ধক্যে ভুলে যাওয়া হতে পারে ডিমেনশিয়া রোগের উপসর্গ। ডিমেনশিয়া মস্তিষ্কের এমন এক ধরনের সমস্যা যা মানুষের স্মৃতি, চিন্তা, আচরণ ও আবেগকে প্রভাবিত করে। বয়সের সাথে সাথে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ও হার বাড়তে থাকে।
বিশ্বের নানা দেশের গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৬৫ বছরের অধিক বয়সি জনগোষ্ঠীর মাঝে মাঝারি থেকে গুরুতর স্মৃতিভ্রংশের হার ৫ শতাংশ, আর ৮৫-ঊর্ধ্ব মানুষের মাঝে এ হার ২০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত।
বাংলাদেশ আলঝেইমার্স সোসাইটির এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে নয় লাখ হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। যেসব রোগের কারণে ডিমেনশিয়া হতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আলঝেইমার্স রোগ। ১৯০৭ সালে জার্মান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যালয়েস আলঝেইমার এ রোগটির বর্ণনা করেন। পরবর্তিতে তার নামানুসারে এ রোগের নামকরণ করা হয়।
আলঝেইমার্স রোগের প্রাথমিক অবস্থায় রোগীর স্মৃতিশক্তি বিশেষত স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি লোপ পেতে থাকে। রোগী সকালে কী খেয়েছেন তা দুপুরেই ভুলে যেতে পারেন।
কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাও মনে করতে পারেন না। পরবর্তিতে, সময় ও স্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তি দেখা দেয়, পরিচিত লোকজনকেও চিনতে অসুবিধা হয়। চিন্তাশক্তি, বোধ বা ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে, ফলে রোগীর জীবনযাপন এমনকি দৈনন্দিন কাজকর্ম করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
এক পর্যায়ে রোগাক্রান্তরা নিজেদের শারীরিক যত্ন নিতেও অক্ষম হয়ে পড়েন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। অনেকের আচরণ, আবেগ, মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হতে পারে।
কেউ আবার বিষণ্ণতা ও সন্দেহবাতিকতার মতো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন। মস্তিষ্কের বিভিন্ন ইমেজিং পরীক্ষায় দেখা গেছে, রোগাক্রান্তদের মস্তিষ্কের আকার ছোটো হয়ে যায়, এর ভেন্ট্রিকল বা প্রকোষ্ঠ বড়ো হয়, কর্টেক্স ও হিপ্পোক্যাম্পাস অংশের স্নায়ুকোষের ক্ষয় হতে থাকে। স্মৃতি-প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক বা নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণগত তারতম্য বিশেষত অ্যাসিটাইলকোলিনের কর্মক্ষমতায়
ঘাটতি দেখা দেয়।
- এপোয়েন্টমেন্ট নিতে যোগাযোগ করুন – APPOIMTMENT
- আরো পড়ুন- ওসিডি কমলেও আমার ডিপ্রেশন কমছে না