ভালোবাসা শরীর না মন?

নারী নাকি পুরুষ, সম্পর্কের ইতি টানেন বেশি কে?

‘আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন বা প্রেমে পড়েছেন কারো?’- মাঝবয়সী কোনো ব্যক্তিকে ফেলে আসা জীবনের দিকে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে সত্য করে আপনার প্রশ্নটির জবাব দিতে বলুন তো। নিজের প্রতি সৎ থেকে সত্য কথাটা স্বীকার করেন যদি, তাহলে এমন কাউকে বোধ করি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার উত্তরটি না-বোধক হবে। কিন্তু তাকেই যদি আবার প্রশ্ন করে বসেন- ‘আচ্ছা, বলুন তো, ভালোবাসা কাকে বলে? প্রেমের সংজ্ঞা কী?’ দেখবেন, গুছিয়ে-বুঝিয়ে বলতে গিয়ে কেমন বার বার আটকে যাচ্ছেন তিনি। তার দোষ-ইবা দেবেন কেমন করে? প্রেম বা ভালোবাসার সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা তো এখনো দিতে পারেননি কেউ- না কোনো সাহিত্যিক, না কোনো দার্শনিক বা মনস্তাত্ত্বিক।

প্রেম আর ভালোবাসা একই ব্যাপার কিনা তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। যদিও ইংলিশটু-বেঙ্গলি ডিকশনারিতে ‘লাভ’ (LOVE)-এর অর্থ হিসেবে প্রেম ও ভালোবাসা দুটোরই উল্লেখ রয়েছে। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানেও ‘প্রেম’-এর অর্থ বা সমার্থক শব্দ হিসেবে ভালোবাসা এবং উল্টোভাবে ‘ভালোবাসা’র ক্ষেত্রে ‘প্রেম’ লেখা রয়েছে। তারপরও অনেকের কাছেই ‘ভালবাসা’ প্রেম নয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই নর-নারীর মধ্যকার প্রেমভালোবাসা বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি এই অনুভূতির কথাই বলা হচ্ছে। বাবা-মা-ভাই-বোন বা বন্ধুর প্রতি অনুভূতি এখানে আমাদের আলোচ্য নয়।

প্রেম বা ভালোবাসার অর্থ বোধে আমজনতা মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত। এক দলের কাছে ভালোবাসা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শরীর-প্রধান একটি অনুভূতি, শরীরের উপস্থিতি ছাড়া ভালোবাসার অস্তিত্ব তাদের কাছে অকল্পনীয়। তারা ভালোবাসার ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের অনুসারী। বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান নিউরোসায়েন্টিস্ট সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও তাঁর মতাদর্শী মনস্তাত্ত্বিকদের মতবাদ অনুসারে, সব প্রেমের উৎস শরীরী আকর্ষণ তথা যৌনতা। কালের প্রবাহে এই তত্ত্ব বিতর্কিত এবং এর বিপক্ষে শক্ত যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো এই মতবাদের প্রভাব কম নয়। এখনো অনেকের কাছেই প্রেম মানে মুখ্যত শরীর বা যৌনতা। যৌনতার তাড়না থেকেই ভালোবাসার অনুভূতির সৃষ্টি বা প্রেমের আবরণে শারীরিক মিলনই মূল লক্ষ্য বলে অনেকেই মনে করেন। তাদের মতে, যৌনতার আনন্দ বা সুখ ব্যতীত ভালোবাসা বা প্রেম টেকে না। বিপরীত মতাদর্শীদের কাছে প্রেম শাশ্বত-চিরন্তন-স্বর্গীয় এক অনুভূতি। সেখানে শরীরের কোনো স্থান নেই। পরস্পরের প্রতি মানসিক আকর্ষণই সেখানে প্রেম বা ভালোবাসার ভিত্তি এবং স্থায়িত্বের নিয়ামক। তাদের মতে, যতক্ষণ অনুভূতিটা মনের ততক্ষণই তা ভালোবাসা। এতে শরীর ঢুকে গেলে তা আর তাদের কাছে ভালোবাসা নয়-কেবলই যৌনতা, কাম। তাদের ধারণায়- মানসিক আকর্ষণ প্রবল হলেই কেবল প্রেম টিকে থাকে। এদের কাছে ভালোবাসা ব্যাপারটি ‘প্লেটোনিক’।

বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো যদিও মোটা দাগে প্রেমের কোনো তত্ত্ব উপস্থাপন করেননি,তবে তাঁর দর্শনের একাংশে এমন এক ধরনের প্রেমের ধারণা দেয়া হয়েছে, যা ইন্দ্রিয়াতীত এক চিরন্তন সৌন্দর্যের ধারক। কেউ আবার দেহজ আকর্ষণ-প্রধান অনুভূতিকে ‘প্রেম’ বলে আখ্যায়িত করেন আর মানসিকটি ‘ভালোবাসা’। আবার কেউবা বলেন, নর-নারীর পারস্পরিক ভালোবাসা বা প্রেমে শরীর বা যৌনতা আসতে পারে। তবে যৌনতাবিহীন ভালোবাসাই সত্যিকারের ভালোবাসা বা সত্যিকারের প্রেম। এই বিতর্ক চিরকালীন। মনীষী-বিজ্ঞানী-গবেষকরাও এখনো একমত হতে পারেননি, আসলে প্রেম বা ভালোবাসা শরীর-প্রধান, নাকি মন-প্রধান। তাই প্রেমভালোবাসার বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনায় শরীর বা মন কারো প্রতি পুরোপুরি পক্ষপাতিত্ব এড়িয়ে, দুই বিষয়ের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েই প্রেম বা ভালোবাসার পর্যায় বা প্রকারভেদ যা-ই বলি না কেন, তা করা হয়। প্রেমের ধরণ নিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি মতবাদ দিয়েছেন কানাডার প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ জন অ্যালান লী। তার থিয়োরির নাম- ‘কালারস অব লাভ’ (ভালোবাসার রং)।

আসলে রং-এর মতবাদের সঙ্গে মিল রেখে থিয়োরিটির এই নাম দেয়া হয়েছে। রং-এর থিয়োরি অনুযায়ী মূল রং তিনটি- লাল, সবুজ, নীল। বাকি সব রং এই তিন রং-এর ভিন্ন ভিন্ন মিশ্রণের ফল। একইভাবে লীর তত্ত্ব মতে, প্রেমের ধরন প্রধানত তিনটি- ইরোস (Eros), লুডোস (Ludos) এবং স্টর্জ (Storge)। ইরোস ধরনের প্রেমে মনের চেয়ে শরীর-সৌন্দর্য প্রভাব বিস্তার করে বেশি। এতে কামনা বা উপভোগই প্রধান এবং তাৎক্ষণিক আবেগ বেশি। লুডোস ঘরানার প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেমকে খেলা হিসেবে গ্রহণ করে। সম্পর্কের ব্যাপারে এরা মোটেও বিশ্বস্ত ও আন্তরিক নয়। একসঙ্গে একাধিক প্রেম চালিয়ে যেতে এরা দ্বিধাহীন। স্টর্জ ধরনের প্রেম হয় দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের, ভালোলাগার, মানসিক বোঝাপড়ার পরিণতিতে। এই ধরনের প্রেমে যৌনতার চেয়ে বিশ্বাস, নির্ভরতা ও মানসিক আকর্ষণের ভূমিকা বেশি। এই তিন প্রধান ধরনের প্রেমের সংমিশ্রণে আরো তিন রীতির প্রেমের দেখা মেলে। ইরস আর লুডোসের সংমিশ্রণে ম্যানিয়া (Mania)- যাকে বলা যায় ‘পাগলের মতো ভালোবাসা’। এতে আবেগ খুবই তীব্র থাকে, প্রিয়জনের সান্নিধ্য ছাড়া পৃথিবীর আর সবকিছুই অর্থহীন মনে হয়। লুডোস আর স্টর্জের সমন্বিত রূপ প্রাগমা (Pragma)- এই রীতির অনুসারী প্রেমিক প্রেমিকারা বাস্তববাদী। এরা আগে থেকেই জীবনসঙ্গীর মাঝে যেসব বৈশিষ্ট্য দেখতে চায় তার তালিকা করে রাখে এবং সে অনুযায়ী সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। সর্বশেষ ধরনটি হচ্ছে অ্যাগাপি (Agape)। এতে ইরোস আর স্টর্জ উভয় ধারার বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটে। অ্যাগাপি হচ্ছে নিঃস্বার্থ প্রেম। এতে প্রতিদানের আশা না করে প্রেমিক বা প্রেমিকা তার প্রিয়জনের জন্য নিজেকে বলতে গেলে উৎসর্গ করে।

ভালোবাসার আরেকটি গ্রহণযোগ্য মতবাদ দিয়েছেন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী রবার্ট জেফ্রি স্টার্নবার্গ। তাঁর মতবাদ ‘ভালোবাসার ত্রিভুজ তত্ত্ব হিসেবেই পরিচিত। তাঁর মতে, ত্রিভুজের তিন বাহুর মতো ভালোবাসারও তিনটি ভিন্ন উপাদান- Intimacy অন্তরঙ্গতা, Passion বা কামোচ্ছ্বোস এবং Commitment বা প্রতিশ্রুতি। অন্তরঙ্গতা বলতে বোঝায় পরস্পরের প্রতি সংলগ্নতা বা নৈকট্যের অনুভব। প্যাশন হচ্ছে কাম, জৈবিক আকর্ষণ বা যৌন আকাঙ্ক্ষা। আর দীর্ঘস্থায়িত্ব ও পারস্পরিক নির্ভরতায় ভবিষ্যতের পরিকল্পনাই হচ্ছে কমিটমেন্ট। ভালোবাসার এই তিনটি উপাদানের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ভালোবাসা বা প্রেমকে সাতটি ধরনে ভাগ করেছেন স্টার্নবার্গ। এর মধ্যে যেমন রয়েছে শুধু যৌনতানির্ভর ভালোবাসা বা Infatuated Love, রয়েছে Companionate Love-  সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী বিবাহিত জীবনে এ ধরনের ভালোবাসা দেখা যেতে পারে। যেখানে যৌনতা মখ্যু নয়, কিন্তু অন্তরঙ্গতা আর প্রতিশ্রুতির সমন্বয়ে ভালোবাসা তখনো বিরাজমান। অন্তরঙ্গতা আর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে যদি যৌনতাও বিদ্যমান থাকে তখন একে বলা হয় Consummate Love। একজন প্রেমিক বা প্রেমিকা তার প্রেম-জীবনে প্রেমের এই সাতটি ধরণই উপভোগ করতে পারেন, একই মানুষের প্রতি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন রীতির প্রেম অনুভব করতে পারেন। আবার সবগুলো ধরন একই ব্যক্তির জীবনে বা একই প্রেমের ক্ষেত্রে না ও ঘটতে পারে।

আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী হেলেন ফিশার প্রেমভালোবাসাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন- Lust, Attraction, Attachment।  Lust  হচ্ছে যৌনতার সমার্থক। Attraction হচ্ছে রোম্যান্টিক ভালোবাসা যাতে মানসিক তীব্র আবেগ প্রধান। আর  Attachment হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জন্য প্রয়োজনীয় গভীর অনুভূতি। ফিশারের মতেও, প্রেমভালোবাসার সম্পর্ক এই তিনটি ধরনের যে কোনো একটি দিয়ে শুরু হতে পারে এবং পরবর্তীতে তা অন্য ধরণে পরিবর্তিতও হতে পারে। আবার একই সঙ্গে তিনটি ধরণই উপস্থিত থাকতে পারে।

প্রেম কেবল শরীর-সর্বস্ব নাকি মন-সর্বস্ব- এই চিরকালীন বিতর্কের এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান নেই। মনস্তাত্ত্বিক, দার্শনিক, সমাজবিদরা ভালোবাসা বিষয়ে যেসব মতবাদ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন সেগুলোও যে সর্বজনগ্রাহ্য বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে তা-ও নয়। তবে এসব মতবাদের কথা ভেবে ভেবে কে কবে প্রেম করেছে, প্রেমে পড়েছে? ‘ভালোবাসা কারে কয়?’- সার্বজনীন এই প্রশ্নকে এক পাশে ঠেলে রেখেই যুগে যুগে প্রেমের আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিক প্রেমিকা।

Previous articleপাবনা মানসিক হাসপাতাল নিয়ে বিভ্রান্তিকর সংবাদ
Next articleভালোবাসার মানুষটিকে ভালো করে চেনার উপায়
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here