সবাই কেন গাইতে গেলে প্রেমের গানই গায়
ঘুরে ফিরে ভালোবাসার কথাটাই
আমি অন্য কিছু গাইবো বলে তোমার কাছে এসে
সবাই কেবল সবাই হয়ে যাই
সেদিন অবসরে মনের খবর এর জন্য মাদকাসক্তি নিয়ে একটা কিছু লেখার যুদ্ধ করছিলাম। মামাতো ভাইটা দেখে বলল, ‘সেই একই প্যাঁচাল আর কত গিলাবেন সবাইকে’। বাক্যটার অন্তর্নিহিত অর্থ করলে দাঁড়ায়, একই কথাগুলো ইনিয়ে-বিনিয়ে, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে, নতুন বোতলে পুরনো মদ খাওয়ানই নাকি আমাদের মতো ডাক্তার লেখকদের কাজ। শুনেই কেমন দুলে উঠল মাথাটা। সে কি জানে একটা লেখা তৈরির পেছনে আমি কত কী-ই না করি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো- ‘তাই তো কপাটে লাগাইয়া খিল স্বর্গে মর্তে খুঁজিতেছি মিল, আনমনা যদি হই এক-তিল অমনি সর্বনাশ!’
কিন্তু সর্বনাশ তো যা হওয়ার হয়েই গেল। সারাদিন ধরে যেসব ‘দীর্ঘ-হ্রস্ব ছন্দ’ গাঁথছি, তা যে আসলে ‘মাথা ও মুন্ডু, ছাই ও ভস্ম’ সে তো আমার অজানা নয়। তবু তো লিখতে হবে। তাহলে কী করণীয়? একটু অন্যভাবেই লিখব। কিন্তু, পারবো কি? তখনই অঞ্জন দত্ত বাঁচিয়ে দিলেন। কাব্যি করে এখন বলা চলে, দিনশেষে যখন ‘সবাই কেবল সবাই হয়ে যাই’, তখন অন্যভাবে লিখতে গিয়ে সেই একই ঘ্যানর ঘ্যানর হয়ে গেলেও আর ভয় নেই আমার। তাই শুরুটাই হোক বিষণ্ণতা নিয়ে।
‘সিজোফ্রেনিয়া’কে যদি বলা হয় রাজা, তবে ‘বিষণ্ণতা’কে সাইকিয়াট্রির বর্তমান ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডর বলা চলে। বলতে গেলে বর্তমান বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই যেন এর সাথে পরিচিত, বলা চলে একটু বেশিই পরিচিত। তবে কিশোর বয়সী আর সদ্য যৌবনে পা রাখা ছেলেটা বা মেয়েটার মধ্যে মুহূর্তে মুহূর্তে যেন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার হারটা অনেক বেশি। তাই তো প্রতিদিনই ফেসবুকের দেয়ালে কোনো না কোনো স্ট্যাটাসে ভেসে আসে বিষণ্ণতার সুর। এই বয়সী ছেলে-মেয়ের আড্ডায় একটু গভীরভাবে কান পাতলে বোধ হবে এই ফেসবুক স্ট্যাটাস আসলে তাদের কাছে যেন একধরনের সামাজিক স্ট্যাটাস বহন করে। আর অতি অবশ্যই অনেক অনেক মোটিভেশনাল স্পিচ, ছবি, ভিডিও। দিনশেষে সেই একই প্রশ্ন-সবাই কেন গাইতে গেলে প্রেমের গান গায়? সবাই কেন মনের কথা বলতে গেলে বিষণ্ণতাকে কচলায়?
কী ভাবছেন? বিদ্রুপ করছি? উপহাস করছি? একজন মনোরোগ নিয়ে কাজকারবার করা মানুষ হয়েও কেন এই ধরনের পশ্চাদপদ মানসিকতা? না, ভয় পাবেন না। সেরকম কিছুই নয়। লং ড্রাইভে উদ্দাম গতিতে ছুটে চলতে, বাতাসের ঝাপটা চোখেমুখে লাগাতে ভালোই লাগে। কিন্তু গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারালে কি চলে? একটা পা ব্রেকে দিয়ে রাখতেই হয়। এটা ভয় পাওয়া বা কাপুরুষতা নয়, নিরাপদে উপভোগ করার জন্যই দরকার। সেরকম বিষণ্ণতা আর মোটিভেশনাল স্পিচের ছড়াছড়িতে একটু রাশ ধরতেই হবে কাউকে না কাউকে, যেই মানুষটা আসলেই বিষণ্ণ-যার আসলেই সাহায্য দরকার তাকে সাহায্য করার জন্য। ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন যদি বলি, একজন অধ্যাপকের কাছে সর্দি জ্বরের রোগী দিয়ে যদি ভরিয়ে দেয়া হয়, তবে, আসলেই যাকে দেখার দরকার ছিল সেই রোগী সুযোগ নাও পেতে পারে অধ্যাপকের চিকিৎসাটা পেতে। তাই আগে বিষণ্ণতাকে চিনতে হবে।
কখনো কখনো মন খারাপ, ভালো না লাগা, অস্থিরতা, মরে গেলেই ভালো হতো, জীবনটাই ব্যর্থ, কিছুই পেলাম না, কিছুই পারব না-এমনটা লাগতেই পারে। সেটা কয়েকদিন স্থায়ী হতেই পারে। অথবা মনটা স্মৃতিকাতর হতেই পারে। চাওয়ার সাথে পাওয়ার মিল না হলে মনটা ভার ভার লাগতে পারে, কাজে উৎসাহ চলে যেতে পারে, হতাশাও আসতে পারে। তাই বলে এসব বিষণ্ণতা নয়। আর সেটা যখন অনেকের কাছে হয়ে দাঁড়ায় অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের একটি ভুল মাধ্যম-তখন তো সতর্ক হতেই হবে সবার।
বাংলাতে ‘বিষণ্ণতা’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে প্রচলিত হওয়াতেই আসলে এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি। তবে বোঝানোর সুবিধার্থে স্বাভাবিক বিষণ্ণতাকে শুধুই ‘মনখারাপ’ এবং রোগ বোঝাতে ‘বিষণ্ণতা’ শব্দটি এই লেখায় ব্যবহার করব। উভয় ক্ষেত্রেই মূল কারণ-যেকোনো প্রকারের ‘ক্ষতি’ (Loss) এর শিকার হওয়া। অন্যভাবে বললে চাওয়া এবং পাওয়ার মধ্যে অমিল ঘটা। এখন এক্ষেত্রে মন খারাপ হওয়া মানবমনের একটা স্বাভাবিক আবেগিক প্রতিক্রিয়া। যেমন : কেউ মারা গেলে, মনমতো কোন কাজ না হলে, ব্যবসায় ক্ষতি হলে, দুর্ঘটনার শিকার হলে, মানসম্মানের হানি হলে, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে মন খারাপ হবেই। এতে দোষের কিছুই নেই। আর মনের সাথে যেহেতু আবেগ, শারীরিক কর্মকান্ড, উদ্যম-উৎসাহ, চিন্তা করার ক্ষমতা এরকম আরো অনেক কিছু জড়িত, তাই মন খারাপ হলে এসবের সবকিছুতে সাময়িক কিছু বিরূপ প্রভাব পড়বেই। তবে তাতে কাজকর্মের খুব একটা হেরফের হয় না, ভালো কিছু ঘটলে তাতে মনে কিছুটা আনন্দ পেতে অসুবিধা হয় না, সময়ের সাথে সাথে বা নিজের চেষ্টায় তা কিছুদিনের মধ্যেই কমে আসে। কিন্তু সেটা বিষণ্ণতা নয়।
যদি এই মন খারাপ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হয়, মন খারাপের ধরনটা ব্যতিক্রম হয় বা স্বাভাবিকের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদের হয় তবে সেটা বিষণ্ণতা হতে পারে। হতে পারে একারণেই বললাম-বিষণ্ণতা বলতে গেলে যে যে বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণগুলো থাকতে হয় এটা তাদের মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য। তবে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আবার বিষণ্ণতারও অনেক ভাগ আছে। এই মেয়াদ তাই একেক ধরনের বিষণ্ণতায় একেক রকম। তবে বিষণ্ণতা বলতে আমরা সাধারণত Major Depressive Disorder-কেই বুঝে থাকি। DSM5* অনুসারে এক্ষেত্রে মন খারাপ থাকতে হবে একটানা দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে, প্রায় প্রতিদিনই এবং দিনের বেশিরভাগ সময় ধরে। সেই সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে অনীহা বা ইচ্ছে না হওয়া।
এর বাইরে আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে-যেগুলো বিস্তারিত বলা এখানে অনর্থক। অনর্থক এই কারণেই, মানসিক রোগ শুধু কতগুলো লক্ষণের উপস্থিতি আছে কি নেই সেই চেকলিস্ট ধরে ধরে অর্থাৎ, টিক চিহ্ন দিয়ে দিয়ে নির্ণয় করা হয় না। অতএব, এখানে খন্ডিতভাবে গুটিকয়েক কথা লিখলেই আমি জানি অনেক পাঠক-পাঠিকা কলম নিয়ে বসে যাবেন লক্ষণ মেলাতে। আর চালাক (বুদ্ধিমান নয়) কিছু তরুণ-তরুণী এই সুযোগে হাজির হতে পারেন আমাদের কাছে, কী কী লক্ষণের কথা বলতে হবে আর কোনটা হবে না তা একেবারে গুছিয়ে নিয়ে। যেটা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়।
সে যাই হোক, বলছিলাম বিষণ্ণতার অনেক ভাগের কথা। দ্বিতীয় একটি বিষণ্ণতার ধরন নিয়ে বলতেই হয়, সেটি হচ্ছে Persistent Depressive Disorder। নামের মাঝেই এর অনেকটা বর্ণনা যেন দেয়া আছে। এখানেও ঘটনা প্রায়ই আগের মতোই। তবে এটি বড়দের মধ্যে বলতে গেলে দুই বছর আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এক বছরের বেশি সময় ধরে থাকতে হয় এবং এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কখনোই একটানা দুই মাসের বেশি ভালো থাকা হয় না। আরেক প্রকার বিষণ্ণতা আছে মহিলাদের মাসিকের সাথে সম্পর্কিত। মাসিকের আগে-পরে কিছুটা শারীরিক-মানসিক অশান্তি, অস্থিরতা থাকতেই পারে। এটা স্বাভাবিক। তবে এগুলোর মাত্রা এবং মেয়াদ যদি বেশি হয়, জীবনের নানা ক্ষেত্রে যদি অসুবিধা তৈরি করতেই থাকে তবে সেটা Premenstrual Dysphoric Disorder কিনা একজন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে জেনে নেয়াই ভালো।
বিষণ্ণতা হতে পারে গর্ভাবস্থায় এবং প্রসব পরবর্তী মানসিক চাপ থেকে, যাকে বলে Postpartum Depression। আরেকটা আছে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বিষণ্ণতা। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটা লক্ষণ হল বাচ্চার হঠাৎ হঠাৎ রাগে ফেটে পড়া। এর কেতাবি নাম Disruptive Mood Dysregulation Disorder। এছাড়াও মাদক নেয়ার কারণে, কিছু ঔষধ নেয়ার কারণেও হতে পারে বিষণ্ণতা। আরেক প্রকার বিষণ্ণতা হল শারীরিক অসুস্থতাজনিত বিষণ্ণতা। এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, থাইরয়েডের সমস্যার সাথে বিষণ্ণতার গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
আপনি কি এত তত্ত্বের কচকচি শুনে ক্লান্ত? হতাশ লাগছে? ঠিক করে ভেবে দেখুন তো-এটা কি এই লেখাতে যা চেয়েছিলেন তা না পাওয়াতে আপনার মন খারাপ, নাকি বিষণ্ণতা! বুঝতে পারছেন না? সে অবশ্য আপনার দোষ নয়-লেখকের ব্যর্থতা। বিখ্যাত শিল্পী ফেরদৌসী রহমান একটা অনুষ্ঠান করতেন বিটিভিতে এসো গান শিখি নামে। আর অনুষ্ঠানটি শেষ করতেন এই বলে, চলো তাহলে আমরা এই গানটি করতে করতে বাড়ি যাই। আসুন আমরাও কিছু কথা মনে গেঁথে রাখতে রাখতে মনের খবর’র পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টাই। কথাগুলো হলো-মন খারাপ খুবই স্বাভাবিক একটা আবেগ। একে মহৎ করে তোলা কিংবা দোষ হিসেবে দেখার কিছু নেই। এই মনখারাপই বিষণ্ণতা হবে-যদি তা তীব্র বা অস্বাভাবিক বা দীর্ঘমেয়াদি হয় এবং তা আপনার দৈনন্দিন জীবনযাপনে বাঁধা সৃষ্টি করে অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবেই সেটা বিষণ্ণতা হতে পারে। এক কথায়-মনখারাপ বিষণ্ণতার একটি অংশ হতে পারে, কিন্তু বিষণ্ণতা মন খারাপের চেয়ে অনেক বড় কিছু।
তাই নিজের দিকেও খেয়াল রাখুন এবং আপনার ঘনিষ্ঠ লোকজনদের কেউ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে তাঁর পাশে দাঁড়ান। উনি যদি বুঝতে না পারেন তবে বোঝানোর চেষ্টা করুন এবং চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসুন। ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। আর আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় কারণ-বিষণ্ণতা। অতএব, আপনার যথাযথ সচেতনতা নিজেকে ও অন্যকে হয়তো বাঁচিয়ে দিতে পারে আত্মহত্যা থেকে। কথাগুলো কি অন্য সবার মতো হয়ে গেল? ক্ষতি কী? ভালো কথা, গুরুত্বপূর্ণ কথা যদি চটকদার না হয়?
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে