দৈনন্দিন জীবনে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কোনও না কোনওভাবে মানসিক চাপের জন্ম হয়। যে কোনও পরিস্থিতি বা অবস্থার কারণে আমাদের মধ্যে স্ট্রেস হতে পারে। যেমন- স্কুলের বিষয় নিয়ে একটা বাচ্চার মধ্যে মানসিক চাপ দেখা দিতে পারে; বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে তাদের প্রিয়জনদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়ে ওঠার জন্য মানসিক চাপের জন্ম হয় আবার কাজের সফলতা বা সম্পর্কজনিত কারণকে কেন্দ্র করে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মনে মানসিক চাপ দেখা দিতে পারে।
স্ট্রেস কি এবং কাকে বলে?
স্ট্রেস কথাটি আজকাল প্রায় সব ক্ষেত্রেই বহুল-ব্যবহৃত (আর কিছুক্ষেত্রে অতিরিক্ত ও ভুলভাবে ব্যবহৃত) হলেও স্ট্রেস-কে শব্দের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা একটু হলেও কঠিন কাজ। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার, রোজকার কাজের চাপ আর স্ট্রেস আলাদা — বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজকার টুকিটাকি চাপকে কিন্তু স্ট্রেস বলে না। কোনো চাপকে স্ট্রেস হিসেবে গণ্য করতে হলে সেটা একটা মাত্রা ছাড়াতে হয়।
স্ট্রেস-এর বিভিন্ন মাত্রাকে বিজ্ঞানী গিলিয়ার্ড সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন:
- যে যে কারণে স্ট্রেস হতে পারে (Input function):কর্মক্ষেত্রের চাপ, যেমন, কম সময়ে বেশি কাজ করা, কাজে নির্ভুল থাকার চাপ, প্রতিকূল পরিবেশে কাজ বা তীব্র মানসিক আঘাত/অশান্তির মধ্যে কাজ।
- স্ট্রেস-এর কারণে যা যা হতে পারে (Output function):ব্যক্তির নিজস্ব অনুভব (যা ব্যক্তিবিশেষে বিভিন্ন রকম হতে পারে) ও তার আচরণে বদল।
- তাতে মনের উপর প্রভাব:এটি স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্নরকম হতে পারে।
- স্ট্রেস-এর ফলে কোনো মানুষের কার্যক্ষমতার উপর প্রভাব:যা গুণগত এবং পরিমাণগত, উভয়ভাবেই কমতে থাকে।
যখন আমরা বলি যে আমরা মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছি, তখন সাধারণত আমরা এটাই বোঝানোর চেষ্টা করি যে পরিবেশ বা পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী আমরা কোনও না কোনও প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করছি বা বিশেষ কোনও পরিস্থিতির কারণে আমাদের মধ্যে উত্তেজনা এবং অস্বস্তির বোধ জাগছে। ডাক্তার উইলিয়াম আর লোভাল্লো তাঁর ‘Stress and Health’ বইতে স্ট্রেস সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন এটা এমন একটা অবস্থা বা বিষয় যার দুটো উপাদান রয়েছে- একটা হল বাহ্যিক উপাদান, যা আমাদের দৈহিক পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত; আরেকটা হল মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক উপাদান, যার সঙ্গে মানবজীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তিমানুষ কীভাবে তার করণীয় কাজ বা আচরণ করবে তা যুক্ত থাকে।
মানসিক চাপকে আমরা জীবনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবেই বিবেচনা করি। আমাদের জীবনে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে মানসিক চাপ জন্মানোর সম্ভাব্য কারণগুলো লুকিয়ে থাকে। দৈনন্দিন জীবনে রান্না করা বা গাড়ি চালানোর মতো ঘটনা থেকে স্ট্রেসের জন্ম হতে পারে; মানসিক চাপের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো হল পরীক্ষার প্রস্তুতি, চাকরির ইন্টারভিউ বা সাক্ষাৎকার অথবা পুরনো জায়গা ছেড়ে নতুন কোনও জায়গায় চলে যাওয়া, জীবনে ঘটে যাওয়া বড়সড় বিপর্যয় যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ভয়াবহ অসুস্থতা প্রভৃতি।
স্ট্রেস কিভাবে হয়?
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ আমরা সবাই কমবেশি অনুভব করি। মানুষের মন ঠিক কোথায় অবস্থিত, সেটা এক কথায় বলা খুব কষ্ট, কিন্তু মানসিক চাপের প্রভাব কিন্তু শরীরের সর্বত্র কমবেশি পড়ে। এখন প্রশ্ন হতে পারে কিভাবে? মূলত যে দুটো পদ্ধতিতে এই প্রভাব কমবেশি শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, তা হলো:
- এন্ডোক্রিন বা হরমোন সিস্টেম
- ইমিউন বা প্রতিরক্ষা সিস্টেম
হরমোন সম্পর্কে আমরা সকলেই আজকের দিনে অল্পবিস্তর জানি। সহজ করে বললে, হরমোন হলো শরীরের সেই রাসায়নিক যা কোনো গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হয়ে সাধারণত উৎপত্তিস্থল থেকে দূরে অন্য কোনো অঙ্গের উপর ক্রিয়া করে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলির প্রকাশ ও তাদের নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
আমাদের শরীরে হরমোনগুলির কার্যকারিতা সাধারণত একে অন্যের উপর পারস্পরিক ভাবে নির্ভরশীল, অর্থাৎ, একটির বেশী কম নিঃসরণের উপর অন্যটির নিঃসরণ ও সেই মত কাজ করা নির্ভর করে। এই সম্পর্কগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্বিমুখী হওয়ায় শরীর জুড়ে হরমোনগুলির কাজ করার ধরণকে বিভিন্ন অক্ষ বা axis -এ কল্পনা করা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে HPA axis এবং HPG axis স্ট্রেস প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ।
শরীরের ভিন্ন হরমোনগুলির মধ্যে স্ট্রেস বিষয়ক যে হরমোনগুলোর কথা জানা প্রয়োজন তা হলো HPA axis এবং HPG axis।
HPA axis আমাদের শরীরে বিভিন্নভাবে কাজ করে। সামগ্রিকভাবে শরীরের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে স্মৃতি, নতুন জিনিস শেখা, অনুভূতি, এমনকি ব্যাথা ও ঘুমের মতো প্রাথমিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলিও অনেকাংশে এই axis-এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়াটির স্বাভাবিক কর্মক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটলে তা বহুক্ষেত্রেই মন, চিন্তা বা উৎকণ্ঠার বিভিন্ন অসুবিধে বা অসুখে পরিণত হতে পারে। এমনকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, স্বাভাবিক বুদ্ধি ইত্যাদিতেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
HPG বা Hypothalamo-pituitary-gonadal axis অন্যদিকে মানুষের যৌনক্ষমতার স্বাভাবিক পরিণতি প্রাপ্ততার সাথে সাথে সমগ্রভাবে ভালো থাকা, মানসিক সুখ-শান্তি ও কর্মদক্ষতা বজায় রাখতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে এই axis-এর অন্তর্গত testosterone আর Di-hydro Epiandrosterone হরমোনটির অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক গবেষণাতে দেখা যাচ্ছে, উৎকণ্ঠা, ভয় পাওয়া ও তাকে সময়ের সাথে জয় করা এবং স্মৃতিশক্তি রক্ষা করায় এই হরমোনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। স্মৃতিশক্তি এবং অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যা শিখি, তা থেকে আমাদের ভবিষ্যতে আসতে চলা স্ট্রেস ও তার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সাবধান হতে পারি ও পুরোনো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা সেই স্ট্রেস-কে আরো ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারি। সঙ্গত কারনেই, এই দুই অক্ষ যখন ঠিকভাবে কাজ করে না তখন এই সমস্ত কাজগুলিও ঠিক ভাবে সম্পন্ন হয় না।
এই দুই অক্ষ-ই শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক অবস্থায় পূর্ণ মাত্রায় বা বলা ভালো সঠিক মাত্রায় কাজ করে থাকে এবং শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখে। মুশকিল তখনি হয় , যখন স্ট্রেস-এর কারণে এই দুই অক্ষ বেশি মাত্রায় কাজ করতে থাকে, যার ফল স্বরূপ কিছু হরমোন অধিক পরিমাণে ক্ষরণ হতে থাকে। এতে শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্যটি নষ্ট হয়ে যায়, ফলে নেগেটিভ ফিডব্যাক পদ্ধতি টি সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়ে এবং করটিসল জাতীয় হরমোন আরো বেড়ে গিয়ে স্ট্রেস-এর বিভিন্ন উপসর্গগুলি তৈরি করে।
Immune system বা শারীরবৃত্তীয় প্রতিরক্ষা ক্ষমতাটির কাজ হলো, শরীরের দুর্গ সৈনিকের মতো পাহারা দেওয়া। বাধা-বিপত্তি-ঝড়-ঝঞ্জা যাই আসুক না কেন, অনুগত সৈনিকের মতো সে তার সমস্ত হাতিয়ার দিয়ে দুর্গ ও দুর্গের মালিককে রক্ষা করে যাবে। তবে যেকোনো সৈনিক যতই পারদর্শী হোক না কেন, তারও যেমন লড়াই করার ক্ষমতা সীমিত, ঠিক একইভাবে শরীরের প্রতিরক্ষা ক্ষমতাটি একটি নির্দিষ্ট সময় অব্দিই বাইরের শত্রুর সাথে লড়তে পারে। বিজ্ঞান শেষ দুই দশকে ক্রমাগত প্রমাণ করেছে যে সর্দি, কাশি বা জ্বর-এর মতো ইনফেকশন-এ যেমন শরীর-এর প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ঠিক একই ভাবে মানসিক চাপও তাৎক্ষণিকভাবে বা সুদূরপ্রসারী ক্ষেত্রেও শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যা আমাদের ভিতর থেকে আরো দুর্বল করে দেয়। এই দুর্বল শরীরে অন্য অসুখ বাসা বাঁধতে অল্প সময় নেয় যা খুব সঙ্গত কারণেই আমাদের মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত করে তোলে। ফলস্বরূপ, স্ট্রেস/চাপ/চিন্তা সব একসাথে ক্রমাগত বাড়তে থাকে। আর এই চক্রের আবর্তে শরীর থেকে মন বেচারা ক্রমশ আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
এই দুই অক্ষ-ই শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক অবস্থায় পূর্ণ মাত্রায় বা বলা ভালো সঠিক মাত্রায় কাজ করে থাকে এবং শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখে। মুশকিল তখনি হয় , যখন স্ট্রেস-এর কারণে এই দুই অক্ষ বেশি মাত্রায় কাজ করতে থাকে, যার ফল স্বরূপ কিছু হরমোন অধিক পরিমাণে ক্ষরণ হতে থাকে। এতে শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্যটি নষ্ট হয়ে যায়, ফলে নেগেটিভ ফিডব্যাক পদ্ধতি টি সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়ে এবং করটিসল জাতীয় হরমোন আরো বেড়ে গিয়ে স্ট্রেস-এর বিভিন্ন উপসর্গগুলি তৈরি করে।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে