ডা. ফাতেমা তুজ জোহরা জ্যোতি
এমবিবিএস, বিসিএস, রেসিডেন্ট এন্ড এডলুসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বিএসএমএমইউ।
ডিভোর্স একটি চ্যালেঞ্জিং সময়, দুজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের জন্যে এবং তাদের সন্তানের জন্যেও। ডিভোর্সের সময় ও পরে সকলেরই স্বাভাবিক গতানুগতিক জীবনে পরিবর্তন আসে। যে সন্তানটি বাবা—মা দুইজনকে একসাথে দেখে অভ্যস্ত, হঠাৎ করেই কোনো একজনকে বেছে নেয়া এবং অন্যজনকে ব্যতিত থাকা, এই ব্যাপারটি সন্তানের মানসিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি নেতিবাচক ভূমিকাই রাখে।
সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কিনা তা আইডেন্টিফাই করা ভীষণ জরুরি। বিরূপ মানসিক প্রভাবগুলো একজন শিশু নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করতে পারে:
বিভিন্ন বয়সে শিশুর প্রতিক্রিয়া বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। এখানে বিভিন্ন বয়সভিত্তিতে বিভিন্ন লক্ষণগুলোর কিছু সাধারণ উদাহরণ দেয়া হলো:
প্রি—স্কুলাররা: শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে পারে অথবা যে দক্ষতাগুলো তারা আয়ত্ত করেছিল তা হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। একে রিগ্রেশন বলে। এছাড়া শিশুরা মা—বাবাকে অঁাকড়ে ধরে থাকতে চায়, আড়াল হলেই উদ্বিগ্ন দেখায় অথবা সে ঘনঘন কান্না করতে থাকে।
বয়স ৬—৮: ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখে, স্কুলে অ্যাকাডেমিক পারফরমেন্স হ্রাস পায়, নানান শারীরিক সমস্যা যেগুলোর কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না সেগুলো দেখা যেতে পারে।
Preteens: রাগ, বিদ্রোহ ভাব বেড়ে যাওয়া, নিজেকে দোষারোপ করা, নিজেকে পরিবার এবং বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। একা একা থাকা।
কিশোর—কিশোরী: বিষণ্ণতা হতে পারে, তারা ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করতে পারে, নিজেকে আঘাত করা বা ক্ষতি করতে পারে অথবা নেশায় ঝুঁঁকে যেতে পারে।
এছাড়া সন্তানের মাঝে দেখা দিতে পারে-
পরিত্যক্ত হওয়ার ভয়: ছোটো বাচ্চারা বিশেষ করে তাদের নন—কাস্টোডিয়াল পিতামাতাকে সম্পূর্ণরূপে হারানোর বিষয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। এক্ষেত্রে তাদেরকে ভালোবাসা ও সঠিক প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে আশ্বস্ত করা জরুরি।
পরিবর্তনশীল জীবন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ: বাড়ি, স্কুল, আর্থিক ক্ষেত্রে বাধা মূলত তাদের স্বাভাবিক জীবনকে কঠিন করতে পারে। এক্ষেত্রে যথাযথ আর্থিক ও অন্যান্য সম্পর্কের স্থিতিশীলতা কিছুটা উদ্বেগ কমাতে পারে।
নিম্নোক্ত কিছু উপায়ে সন্তানের এই নেতিবাচক মানসিক প্রভাবকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি:
ক্লিয়ার কমিউনিকেশন: পরিষ্কার এবং খোলামেলা আলোচনা সন্তানের সাথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সন্তানের কাছে আপনার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা, সে সাথে বয়স—উপযুক্ত তথ্য প্রদান করাই হলো ক্লিয়ার কমিউনিকেশনের মূল চাবিকাঠি। শিশুরা প্রায়শই নিজেদের তাদের পিতামাতার বিচ্ছেদের জন্য দায়ী করে, যা থেকে তাদের মাঝে অপরাধবোধ এবং নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়। সে কারণে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যে বিবাহবিচ্ছেদ তাদের দোষ নয়, এটি নিজেদের মাঝে মতের অথবা অন্য যেকোনো অমিলের কারণে হয়েছে, তাহলে সহজেই শিশুর নিজের মনের উপর এই অপ্রয়োজনীয় অপরাধবোধ কমাতে সাহায্য করতে পারেন।
নিজস্ব কলহ থেকে সন্তানকে দূরে রাখুন: সন্তানদের যতটা সম্ভব পিতামাতার নিজেদের মাঝের যেকোনো দ্বন্দ্ব বা নেতিবাচক কথোপকথন থেকে দূরে রাখা প্রয়োজন। সন্তান যদি বাবা—মায়ের কলহ বা দ্বন্দ্বের সময় উপস্থিত থাকে, তবে দেখা যায় যে তা সে সন্তানদের মাঝে উদ্বেগজনিত রোগ, বিষণ্ণতা এবং পোস্ট—ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD) ডেকে আনতে পারে।
স্বাভাবিক রুটিন মেনে চলা: স্থিতিশীলতা শিশুদের জন্য স্বস্তিদায়ক, এবং একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বাভাবিক রুটিন এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের মাঝে স্বাভাবিকতার অনুভূতি প্রদান করতে পারে। সে রুটিনটি হতে পারে ঘুমানোর নির্দিষ্ট সময় মেনে চলা যা আগে থেকেই ছিল, বিকেলে প্রতিদিনকার মতো খেলতে যাওয়া অথবা ছুটির দিনগুলোতে কোথাও ঘুরতে যাওয়া থেকে যেকোনো কিছু। এভাবে জীবনের এমন একটি ট্রানজিশনের সময় নিত্যদিনের কিছু স্বাভাবিক রুটিন মেনে চললে শিশুর উপর নেতিবাচক মানসিক প্রভাব কম পড়বে।
শিশুর অনুভূতির প্রকাশকে উৎসাহিত করুন: শিশুদের যথাযথ সুযোগ দিতে হবে যেন তারা তাদের মনোভাব নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারে, তাদের মনের প্রশ্নগুলো যেন সহজেই করতে পারে সে নির্ভয় দিতে হবে। সেগুলোকে নন—জাজমেন্টালি দেখতে হবে। বিচার ছাড়াই তাদের অনুভূতি এবং উদ্বেগ প্রকাশ করার সুযোগ করে দিলে তা তাদের মানসিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। শিশু সকলের কাছে তার মনের কথা নাও বলতে পারে, এক্ষেত্রে শিশু যার কাছে সব থেকে বেশি কম্ফোর্টেবল অনুভব করে সে ব্যক্তিটি শিশুর সহায়ক হতে পারে।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে: অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের সময় বাবা—মা দুইজনই অত্যন্ত মানসিক চাপের মাঝে থাকেন। বিচ্ছেদের নানান কমপ্লিকেশন তাদের আছন্ন করে রাখে। সেক্ষেত্রে শিশুর শারীরিক ও মানসিক দিকের যথাযথ যত্নের ঘাটতি হতে থাকে। যা শিশুর জন্যে অত্যন্ত অযাচিত ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে শিশুর মানসিক ও শারীরিক দিকের যত্নের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে হবে। কেননা বিচ্ছেদের কারণে নিজেদের মাঝের কমপ্লিকেশন একসময় ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের সময় তার উপর বাবা—মায়ের বিচ্ছেদের এই নেতিবাচক ব্যাপারগুলো দীর্ঘমেয়াদি নানান মানসিক রোগ ডেকে আনে। শুধু মানসিক রোগ নয়, শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক বিকাশেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আপনার নিজস্ব আচরণ সম্পর্কে সচেতন হোন: শিশুরা প্রায়শই তাদের বাবা—মাকে রোল মডেল হিসেবে দেখে। সে বাবা—মা থেকে শেখে যে কীভাবে কঠিন পরিস্থিতি পরিচালনা করতে হয়। তাই শিশুর সামনে নিজের আচরণ আবেগের নিয়ন্ত্রণ জরুরি। স্বাস্থ্যকর উপায়ে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।
ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ অনেক কারণেই হতে পারে। এখানে কোনো একজনের দোষ থাকতেই হবে এবং অন্যজনকে নিষ্পাপ হতে হবে ব্যাপারটি তা নয়। এমনকি ডিভোর্স অনেক বড় সমস্যার সমাধানও বটে। একই ছাদের নিচে বাবা—মায়ের মাঝে দীর্ঘদিন কলহ দেখে যে সন্তান বড়ো হয় তার মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি অনেকটাই বেশি। এক্ষেত্রে বিচ্ছেদ সমস্যার সমাধান ডেকে আনে। সমাজে ডিভোর্সকে ডিক্রিমিনালাইজড করতে হবে। স্বাভাবিকভাবে দেখতে হবে। সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব যেন সন্তান ও তার পিতা—মাতা কারো উপরে না পরে সেটি খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা আমরা নিশ্চিত করতে পারবো।