ডা. মো. আব্দুল মতিন
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মানসিক রোগ বিভাগ
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।
সোশ্যাল ফোবিয়া এক ধরনের উদ্বেগজনিত মানসিক সমস্যা যেখানে একজন ব্যক্তি যখন জনসমাগমে যায় বা এমন কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার কথা চিন্তা করে তখন সে মারাত্মকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এই অনাকাক্সিক্ষত সামাজিক ভীতি তার প্রতিদিনকার জীবনে যথেষ্ট সমস্যা ও প্রতিবন্ধতার সৃষ্টি করে। সে ভাবে যে সবাই তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বা তার বিভিন্ন বিষয়ের সমালোচনা করছে, যেমনÑতার হাঁটাচলা, কথা বলা, পোশাক—পরিচ্ছদ এমনকি তার চেহারা ভালো বা খারাপ এসব নিয়ে সমালোচনা করছে এমনটি ভেবে আগে থেকেই আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি সবসময় বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতি, যেমন অনেক লোকের মধ্যে কথা বলা, মঞ্চে কোনো পারফর্ম করা, বক্তৃতা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো এড়াবার চেষ্টা করে অথবা এড়ানো সম্ভব না হলে সাহায্যকারী হিসেবে কাউকে সাথে রাখার চেষ্টা করে। সোশ্যাল ফোবিয়াকে অনেক সময় পরিবারের সদস্য ও নিকটজনেরা স্বাভাবিক লাজ—লজ্জা ভেবে ভুল করে থাকেন। তবে মনে রাখতে হবে, একজন লাজুক প্রকৃতির ব্যক্তি লোকজনের মাঝে সামান্য সমস্যা হলেও তার কাজকর্ম চালিয়ে নিতে পারে কিন্তু সোশ্যাল ফোবিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তি অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতার কারণে তার সামাজিক, ব্যবসায়িক বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করতে পারে না।
যেসব ক্ষেত্রে সমস্যা হয় : সাধারণত রেস্টুরেন্ট, ক্যান্টিন, ডিনার পার্টি, বোর্ড মিটিংসহ যেসব পরিস্থিতিতে জনগণের পর্যবেক্ষণের সম্মুখীন আশঙ্কা থাকে সেসব ক্ষেত্রে সোশ্যাল ফোবিয়া তৈরি হয়। সোশ্যাল ফোবিয়া সাধারণত দুই প্রকারের হয় যথা-১। সাধারণ বা জেনারালাইজ্ড সোশ্যাল ফোবিয়া এবং স্পেসিফিক সোশ্যাল ফোবিয়া।
সাধারণ বা জেনারালাইজ্ড সোশ্যাল ফোবিয়াÑএক্ষেত্রে ব্যক্তির সকল সামাজিক পরিস্থিতিতেই সমস্যা তৈরি হয়। যেমন সকল ক্ষেত্রে সে মনে করবে যে সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কী করছে না করছে সবাই তা ফলো করছে। মার্কেট বা রেস্তোরাঁতে দরকার থাকলেও যেতে মন সায় দিচ্ছে না, লোকজনের সামনে খেতে বা কথা বলতে বা নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে অসুবিধা হচ্ছে ইত্যাদি। আবার স্পেসিফিক সোশ্যাল ফোবিয়াতে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কিছু বিশেষ পেক্ষাপটে সোশ্যাল ফোবিয়া হয়। যেমনÑজনসমক্ষে কথা বলা, অন্যের সম্মুখে লেখালেখি করা, জনসম্মুখে বাদ্যযন্ত্র বাজানো ইত্যাদি। তবে এক্ষেত্রে সে লোকজনের সাথে মোটামুটি মেলামেশা করতে পারে।
উপসর্গসমূহ :
১। উপযুক্ত কারণ ছাড়াই পাবলিক প্লেসে সমালোচিত বা অপমানিত হওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকা এবং উক্ত স্থান গমনে বিরত থাকা।
২। পাবলিক প্লেসে যাওয়া বা যাওয়ার চিন্তায় ব্যক্তির মধ্যে ভীষণ উদ্বিগ্নতা তৈরি হওয়া এবং ফেস না করে এড়িয়ে যাওয়া।
৩। ভয়ের মাত্রা প্রকৃত অবস্থার চেয়ে তীব্র হওয়ার ফলে স্বাভাবিক কাজকর্ম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়া।
৪। অন্য কোনো রোগ বা সমস্যা যেমনÑস্বাভাবিক লজ্জা, সামাজিক দক্ষতার অভাব, প্যানিক ডিজঅর্ডার, এগোরাফোবিয়া, বিষণ্ণতা, সিজোফ্রেনিয়া, এভয়ডেন্ট পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা অন্যান্য অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার ইত্যাদি রোগের কারণে এই সমস্যাগুলো হচ্ছে না, তা ভালোভাবে নিশ্চিত হওয়া।
৫। ৬ মাস বা তার বেশি সময় ধরে সমস্যা বিদ্যমান থাকা। এছাড়াও
— অনুরূপ পরিস্থিতিতে হাত—পা কাঁপা, লজ্জায় রক্তিম হওয়া, অতিরিক্ত ঘামা, গলা মুখ শুকানো, বুক ধড়ফড় করা, শ্বাস—প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া, শরীর ঝিম ঝিম করা, ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হওয়া ইত্যাদি।
— রোগী হীনম্মন্যতা ও আত্মসম্মানহীনতায় ভোগে, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
— এছাড়াও উদ্বিগ্নতা কমাতে এলকোহল বা মাদক সেবন করা
— বিষণ্ণতা ও অন্যান্য উদ্বিগ্নতাজনিত রোগে একই সাথে ভুগতে থাকা।
যে বয়সে সোশ্যাল ফোবিয়া বেশি হয়:
সাধারণত কিশোর বয়সে সোস্যাল ফোবিয়া বেশি হয়। প্রায় ১২% সাধারণ মানুষের মধ্যে সোশ্যাল ফোবিয়া হতে পারে এবং ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে এই রোগের হার প্রায় সমান। প্রথমত কোনো কারণ ছাড়াই পাবলিক প্লেসে সোশ্যাল ফোবিয়া হতে পারে এবং পরবর্তিতে একই ধরণের পরিস্থিতিতে বার বার এটা হতে থাকে। তবে উদ্বিগ্নতার তীব্রতা ও পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।
সোশ্যাল ফোবিয়ার কারণ—
১। জিনগত কারণ- সোশ্যাল ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মীয়—স্বজনের মধ্যে এই রোগের হার অনেক বেশি।
২। যে বিষয়কে সে ভয় পায় তার সাথে অতীতের অনুরূপ কোনো ঘটনা মিলিয়ে সে এক তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে।
৩। সামাজিক পরিস্থিতিতে অন্যের দ্বারা অযথা সমালোচিত বা বিরূপভাবে মূল্যায়িত হওয়ার ভয়। এই ভয় ব্যক্তির কিছু ভুল ধারণার সাথে সম্পর্কিত, যেমন-
— সামাজিক পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ভালো পারফর্মেন্স করার আকাক্সক্ষা।
— নিজেকে অযোগ্য মনে করা বা হীনম্মন্যতায় ভোগা।
— সামাজিক পরিস্থিতিতে নিজের কাজের অতিরিক্ত মূল্যায়ন নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করা।
— অন্যরা তার কাজকে অবমূল্যায়িত করবে বা তিরস্কার করবে এমন চিন্তা বারবার মনে আসা।
— নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করা, যেমন চোখে চোখ রেখে কথা না বলা।
৪। কোনো বিষয় নেগেটিভ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের এমিগডালা ও ইনসুলাতে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া। ইনসুলার অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার ফলে উদ্বিগ্নতার শারীরিক উপসর্গ তৈরি হয়, যেমন-গা ঘামা, একই নেগেটিভ চিন্তা বারবার মনে আসা ইত্যাদি।
সোশ্যাল ফোবিয়া কর্মক্ষমতা নষ্ট করে:
১। অতিরিক্ত সামাজিক ভীতির কারণে সোশ্যাল ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়। যেহেতু সে মনে করে সবাই তাকে নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করছে, তাই সংকোচের কারণে সে পাবলিক প্লেসে গমন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে শুরু করে। ফলে স্কুলগামী বাচ্চা স্কুলে যেতে চায় না, একজন ব্যবসায়ী তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বাসায় অবস্থান করে, বাজার করতে বা ডাক্তারের নিকট যেতে চায় না, চাকরিজীবী বেশি মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, এমন চাকুরি করতে চায় না বা চাকরি পরিবর্তন করতে চায়।
২। সোশ্যাল ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সে ভাবতে শুরু করে যে, তাকে দিয়ে আর কিচ্ছু হবে না। ফলে আস্তে আস্তে তার মধ্যে অতিরিক্ত অস্থিরতা থেকে একপর্যায়ে বিষণ্ণতা তৈরি হয়। ফলে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩। অনেকে হতাশা থেকে নিজের ক্ষতি করে বা আত্মহননের চিন্তা করে। কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত সামাজিক ভয় ও হতাশা থেকে মুক্তি পেতে মাদকে জড়িয়ে পড়ে। ফলে তারা কর্মক্ষম থেকে পরিবার ও সমাজে অবদান রাখার পরিবর্তে বোঝায় পরিণত হয়।
৪। সোশ্যাল ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় শুরুতে তার সমস্যার গুরুত্ব দেয় না। কেউ কেউ সঠিক চিকিৎসকের নিকট থেকে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা গ্রহণ না করে কবিরাজি, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ কবজ, পানিপড়া ইত্যাদি অপচিকিৎসার পিছনে অনেক বেশি সময় নষ্ট করে ফেলে। একপর্যায়ে তার মনোবল মারাত্মকভাবে পড়ে এবং তার দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম করার শক্তিও হারিয়ে ফেলে।
সোশ্যাল ফোবিয়া থেকে মুক্তির উপায় :—
সোশ্যাল ফোবিয়া সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে শুরু হয়ে অনেক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে এমনকি বৃদ্ধকাল পর্যন্ত থাকতে পারে। প্রায় ৫০% সোশ্যাল ফোবিয়ার রোগী শুরুতে বা সমস্যা শুরু হওয়ার অনেক পরে চিকিৎসার শরণাপন্ন হয়।
চিকিৎসাসমূহ—
১। সাইকোএডুকাশনের মাধ্যমে রোগী ও পরিবারের লোকজনের সাথে তার রোগের ধরন, রোগের কারণ, তীব্রতা, চিকিৎসা পদ্ধতি, আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতে হবে। রোগী ও পরিবারের লোকজনকে আশ্বস্ত করতে হবে।
২। হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে আত্ববিশ্বাস বাড়ানোর কৌশল শিখতে হবে, প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ কোর্স করা যেতে পারে।
২। এক্সপোজার থেরাপির মাধ্যমে রোগী সামাজিক পরিস্থিতিতে যেন সেফটি বিহেভিয়ার না করে সেটা শেখাতে হবে, যেমন, সে যেন যেকোনো সামাজিক পরিস্থিতি এড়িয়ে না গিয়ে সাহসের সাথে তা মোকাবিলা করে।
৩। সাইকোথেরাপি, যেমন-কগ্নিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, সাইকোডাইন্যামিক সাইকোথেরাপির মাধ্যমে রোগ সম্পর্কে রোগীর যে সমস্ত ভুল ধারণা বা অহেতুক ভীতি আছে তা সংশোধন করতে হবে।
৪। সেলফ হেল্প বুক ব্যবহারের মাধ্যমে রোগীর অস্বাভাবিক আচরণ বা আচরণগত যেসব সমস্যা আছে তা ঠিক করার মাধ্যমে সঠিক গ্রহণযোগ্য আচরণ করার কৌশল শেখাতে হবে।
৫। সহজভাবে মানসিক চাপ কমানোর কৌশল শেখাতে হবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। মাইন্ডফুলনেস, রিলাক্সেশন পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেকে কীভাবে শান্ত রাখা যায় তা শেখাতে হবে। এতে করে সোশ্যাল ফোবিয়া অনেক কমে যাবে।
৬। সাইকোথেরাপির পাশাপাশি মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনে এন্টিডিপ্রেসেন্ট (SSRIs, SNRI, MAOIs, atzpical antidepressants), বেঞ্জোডায়াজিপিন ও বিটা—ব্লোকার জাতীয় কিছু ওষুধ সেবন করলে আরো ভালো ফল পাওয়া যায়।