বর্তমান সময়ে হাজার রকম প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠে একটা শিশু। প্রশ্ন হলো এদেশে জন্ম নেয়া একটা শিশুকে রঙিন শৈশব উপহার দেয়া কি অসম্ভব? হয়তো নয়। শৈশব চুরি যাওয়া শিশুদের নিয়ে নানারকম উদ্যোগ আমাদের আশাবাদী করে। প্রচলিত কাঠামোর বাইরে বিভিন্ন স্কুলের প্রতিষ্ঠা, মানসিক বিকাশ সহযোগী সংগঠন, ডে কেয়ারসহ আরো বিভিন্ন কার্যক্রম আমাদেরকে আশ্বাস দেয়। নিঃসন্দেহে এই উদ্যোগগুলো প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। কিন্তু পরিবর্তনের ইশারা দেবার জন্য যথেষ্ট। আবার উল্টোদিকে শিশুকে শিক্ষিত করার নানামুখী প্রক্রিয়ার দিকে চোখ ফেরালে উদ্বেগকেও এড়ানো যায় না।
এমন কখনো সম্ভব নয় যে একটা শিশু জন্ম নেবে আর সে কিছুই শিখবে না। সে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে নতুন কিছু শিখতে শিখতে বেড়ে ওঠে। কী সে শিখবে সেটা নির্ভর করে তার অবস্থানের ওপর। পৃথিবীর বদলের সাথে সাথে শিশুর শিখনমাধ্যমেরও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। স্লেট-পেন্সিলের জায়গায় কাগজের খাতা আর কাঠপেন্সিল প্রতিস্থাপিত হয়েছে তো সেই কবে। এখন তারও প্রয়োজন পড়ে না। কাগজ কলমের কাছাকাছি যাবার আগেই শিশু বিস্তর শিখে যাচ্ছে। দুই থেকে আড়াই বছরেই সে রাইমস সহ আরো অনেক কিছু শিখে যায় স্ক্রিনে চোখ রেখে। এটা কতটা ফলদায়ক সেটা অন্যপ্রসঙ্গ। যে প্রসঙ্গটি এখন বলতে চাচ্ছি সেটা হলো সন্তানের শিক্ষা এবং শেখানো নিয়ে অভিভাবকের উদ্বেগ। কখনো কখনো যেটিকে বাড়াবাড়ি রকমের উদ্বেগ বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। বাচ্চার বয়স তিন বছর না হতেই অভিভাবকের অস্থিরতা তৈরি হয়। কোনো কোনো বাচ্চাকে আড়াই বছর পেরুতে না পেরুতেই স্কুলো দিয়ে দেন তার অভিভাবক। এই বয়সী একটা বাচ্চা যদি একটা সত্যিকারের খেলার স্কুলে যায় সেক্ষেত্রে আলাদা কথা। কিন্তু আমাদের দেশে সত্যিকারের খেলার স্কুল কয়টা? বাচ্চা স্কুলে গিয়ে পড়বে না, খেলবে; খেলতে খেলতে যা শেখার শিখবে- এরকম ভাবনাতেই বা কতজন অভিভাবক স্থির থাকতে পারেন! যে অভিভাবক চান না তার সন্তানকে এই বয়সে বই খাতায় বন্দি করতে তিনি হয়তো একটা উপযুক্ত স্কুল খুঁজে পান না যেখানে পড়ার চাপ কম। আবার কোনো স্কুল যদি থাকে যেখানে পড়ার চাপ কম সেখানে দেখা যায় অভিভাবকরাই অভিযোগ করে বসেন যে স্কুলে পড়ালেখা হয় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি নিজের কাছে পরিষ্কার বাচ্চাকে আমরা কেন শেখাতে চাই? কতটা শেখাতে চাই? আর কীভাবে শেখাতে চাই? যদিও কীভাবে শেখাতে চাই সেটা অনেক পরের প্রশ্ন।
প্রথম প্রশ্নে আসি- কেন শেখাতে চাই? কারণ, পড়ালেখা শিখবে, বড় হবে, মানুষ হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একটা শিশুকে ’মানুষ’ হওয়ার জন্য হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বোধ জন্মাবার আগে থেকেই। এরপর পঞ্চম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা, অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা, এস. এস. সি, এইচ.এস.সি, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষা, শেষে বি. সি. এস বা গালভরে বলার মত কোনো চাকরি পেলে তাকে ‘মানুষ’ হওয়া বলে। যদি তাই হয় তবে প্রশ্ন আসে- আমরা তাদের কতটা শেখাতে চাই?
একটু ভেবে দেখুন তো এই যে মানুষ হওয়ার একটা সামাজিক রূপরেখা আমরা দাঁড় করিয়েছি তার জন্যও কি প্লে গ্রুপের একটা বাচ্চার বর্ণমালা, নার্সারিতে ইংরেজি, বাংলা ব্যাকরণ অংক, ধর্ম, ওয়ানে বড় বড় নামতা এগুলো শিখে ফেলার প্রয়োজন আছে? আপনার বাচ্চা এত কিছু পারে এটা শুধু আপনার ভেতর একধরনে আত্মতুষ্টি দেয়া ছাড়া আর কি কিছু যোগ করেছে? যে বাচ্চাটি এত কিছু এত আগে শিখছে আর যে শিখছে না, মানে আরো পরে ধীরে ধীরে শিখছে; দু’জনেরই কি প্রথম গন্তব্য পি. এস. সি নামক পাবলিক পরীক্ষা না? তাহলে দ্রুত বেশি শিখে ফেলে বাচ্চাটির বাড়তি কোনো প্রয়োগের জায়গা কি আছে? যদি না-ই থাকে তবে কি আমাদের স্পষ্টভাবে জানা প্রয়োজন না একটা বাচ্চাকে কত বয়সে আমরা কতটা শেখাতে চাই? কতটুকু শিখলে বুঝবো ওর সামর্থ্য অনুযায়ী যথেষ্ট হয়েছে? কিংবা কোন শিক্ষাটা আগে প্রয়োজন আর কোনটা পরে হলেও চলবে?
এবার আসি কীভাবে শেখাতে চাই। যদি তিন, চার অথবা পাঁচ বছর একটি শিশু স্কুলে না যায় তাহলে কি সে কিছু না শিখে বসে থাকবে? আগেই বলেছি এটা কখনো সম্ভব নয়। শিশু শিখবেই। হাসতে, খেলতে, খেতে, হাঁটতে, দৌড়োতেই সে শিখে নিতে পারে তার প্রয়োজনটুকু। আবারো বলছি যদি সত্যিই তার বয়স উপযোগী কোনো স্কুল থাকে সেখানে সে যেতেই পারে। কিন্তু বিদ্যার জাহাজ বানিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে শিশুদের ওপর চড়াও হয় যেসব স্কুল তাদের ব্যাপারে আরেকবার ভাবুন। আপনার ভাবনাও বদলে দিতে পারে গোটা পদ্ধতি।
পারিপার্শ্বিক অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যায় সন্তান নিয়ে উদ্বেগের অন্যতম প্রধান কারণ সামাজিক চাপ। বাচ্চাকে স্কুলে দিয়েছ? কোথায় দিয়েছ? এখনো দাওনি! আমার মেয়ে/ছেলে তো এতকিছু শিখে ফেলেছে!! কিংবা ফেসবুকেই আনন্দিত মা-বাবা তাদের বাচ্চার ভালো রেজাল্টের খবর দিলেন। এতে করে যারা হয়তো ভাবছেন বাচ্চাকে আরো পরে স্কুলে দেবেন কিংবা এত দ্রুত এত কিছু শেখাবেন না, ধীরে ধীরে শেখাবেন- তারা চাপ অনুভব করেন। ভাবেন- পিছিয়ে পড়লেন না তো! কাজেই তাদের জন্য নির্লিপ্ত থাকা সহজসাধ্য হয় না। একটু একটু করেও যদি আমরা সচেষ্ট হই তাহলেও হয়তো বদলে যেতে পারে বর্তমান সময়ের শিশুদের বন্দিশৈশব।
প্রতি মুহূর্তে রঙ ছড়াতে ছড়াতে যে বড় হচ্ছে সেই সন্তানের বেড়ে ওঠাটাকে উপভোগ করুন; ’বড় হওয়া’র বিষয়টিকে চাপ হিসেবে না নিয়ে। তাহলেই বদলে যাবে ওর পৃথিবী।
সাদিকা রুমন, বিশেষ প্রতিবেদক
মনেরখবর.কম