বাংলাদেশে মাদকাসক্তির ব্যাপকতা

0
323
বাংলাদেশে মাদকাসক্তির
বাংলাদেশে মাদকাসক্তির ব্যাপকতা

বর্তমান বাংলাদেশের ভয়াবহতম সংকটের নাম মাদক। আমাদের দেশে কিশোর সন্ত্রাসীর ক্রমবর্ধমান দাপটের যে তথ্য সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তার মূল কারণ সম্ভবত নিহিত রয়েছে এখানেই। দেশের সর্বত্র স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা গুলি বা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যের পেছনেও মাদকাসক্তির ভূমিকা অন্যতম। এখন আলো ঝলমলে নগরীর প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন মাদকের সর্বগ্রাসী বিস্তার।

দেশে মাদকের ভয়াবহ পরিসংখ্যান
বাংলাদেশে মাদকাসক্তির ব্যাপকতা নির্ধারণে দেশে প্রথমবারের মতো একটি সমীক্ষা পরিচালিত হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এই সমীক্ষা পরিচালনা করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের আর্থিক সহায়তায় ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই সমীক্ষা চালানো হয়। দেশের সাতটি বিভাগের সাত বছরের ঊর্ধ্বে ১৯ হাজার ৬৬২ জনের ওপর বাংলাদেশে মাদক ব্যবহারের প্রকোপ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের ওপর সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালক মো. ফারুক আলমের নেতৃত্বে মোট পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বছরব্যাপী পরিচালিত এই সমীক্ষার তত্ত্বাবধান করেন।

সমীক্ষা অনুযায়ী, এদেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক, মাদকাসক্তের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩০০। আর ৭ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫৬ হাজারের কিছু বেশি। ১৯ হাজার ৬৬২ জনের কাছ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃত প্রশ্নমালা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের অ্যালকোহল, স্মোকিং অ্যান্ড সাবসট্যান্স স্ক্রিনিং টেস্ট (এএসএসআইএসটি) করা হয়েছে বলে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালক ফারুক আলম।

বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। তবে আরো বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশ পাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশে মাদকাসক্তির এই ব্যাপকতা উদ্বেগজনক বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই সমীক্ষার আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ধারণা করত, দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। সমীক্ষায় তা অর্ধেক বলা হলেও অধিদপ্তর এখন বলছে, এই সংখ্যাও আশঙ্কাজনক। সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, বিভাগ অনুযায়ী মাদক ব্যবহারকারী সবচেয়ে বেশি রয়েছে ঢাকা বিভাগে ৩৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। মাদকের প্রকার অনুসারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গাঁজা ৮২ দশমিক ৯০ শতাংশ, অ্যালকোহল ২৭ দশমিক ৫০, ইয়াবা ১৫ দশমিক ২০, অপিয়ড ৫ দশমিক ৩০ এবং ঘুমের ঔষধ ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। পুরুষের মধ্যে মাদক ব্যবহারকারী ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নারীদের মাঝে দশমিক ৬ শতাংশ।

পেশা অনুসারে বাংলাদেশে মাদকাসক্তির হার শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এটি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর রয়েছে বেকার জনগোষ্ঠী, যা ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ৪ দশমিক ৩ শতাংশ, কৃষক ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং চাকরিজীবীদের মধ্যে মাদক সেবন করেন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব
১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে এখন মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখ। আর এখানে এখন মাদক হিসেবে ব্যবহারের শীর্ষে রয়েছে ইয়াবা নামের এক ধরনের উত্তেজক ট্যাবলেট। এছাড়াও হেরোইন, গাঁজা এবং ফেনসিডিলের ব্যবহারও উল্লেখযোগ্য। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মোট হেরোইন উদ্ধার করেছে ৪৮ কেজি, গাঁজা ১৬ হাজার কেজি, ফেনসিডিল দেড় লাখ বোতল, ইয়াবা ট্যাবলেট ৫০ লাখ পিস। এর বাইরে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ড বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এই আইনে ২০১৭ সালে সারাদেশে মোট মামলা হয়েছে ১,০৬,৫৩৬টি।

এই মামলাগুলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ডের অভিযোগ, আটক এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ভিত্তিতে করা হয়েছে। আর এ সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য ধরা পড়ে, তা বিক্রি হওয়া মাদকের মাত্র ১০ শতাংশ আর ৯০ শতাংশ মাদকই ধরা পড়ে না। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ইউএনওডিসি)-র মতে, বাংলাদেশে বছরে শুধু ইয়াবা ট্যাবলেটই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, প্রতিটির দাম দুইশ টাকা হিসেবে যার বাজারমূল্য প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ইয়াবার ব্যবহার ৮০ শতাংশ বেড়েছে আর ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বেড়েছে ৪৬ শতাংশ।

২০১০ সালে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭০ লাখ। ৭০ লাখের মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবী আছে ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। তাদের মধ্যে ৭০ ভাগের বয়সই ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। মাদকাসক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সব দেশের মধ্যে সপ্তম। মাদকাসক্তরা মাদকদ্রব্য কেনায় বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে।

মাদক দ্রব্য প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং কিছু প্রস্তাবনা
আশির দশকে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। এ সমস্যা মোকাবেলায় মাদকের অপব্যবহার, পাচার রোধ ও ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতার বিকাশ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, ১৯৮৯ জারি করা হয়। অতঃপর ২ জানুয়ারি ১৯৯০ তারিখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ প্রণয়ন করা হয় এবং নারকটিকস অ্যান্ড লিকার পরিদপ্তরের স্থলে একই বছর তৎকালিন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অধীনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ তারিখ এ অধিদপ্তরকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করা হয় এবং সর্বশেষ এ অধিদপ্তরে একই মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম
দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তিনটি কর্মকৌশল বা পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে-

  • ১. চাহিদা হ্রাস
  • ২. সরবরাহ হ্রাস
  • ৩. ক্ষতি হ্রাস

১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজকে মাদকমুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সমস্যার মাঝেও প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘ সফলতা রয়েছে। কিন্তু তারপরও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে সফলতা অর্জিত হয়েছে এমন দাবি করা যুক্তিসংগত হবে না। আজও সমাজের নানাবিধ সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাদক সমস্যা। যার অভিশাপ থেকে যুবসমাজ মুক্ত হতে পারছে না। বাংলাদেশে মাদকাসক্তির ব্যাপকতা থেকে  উত্তরণের জন্য করণীয় হতে পারে :

  • অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট শাক্তিশালী করার জন্য বিভাগীয় শহর এবং সিটি কর্পোরেশনসমূহে র‌্যাবের মতো স্ট্রাইকিং ফোর্স সৃষ্টি করা ।
  • জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে এনজিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কমিউনিটি লিডারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ।
  • ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াকে মাদকবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টিতে সম্পৃক্ত করা।
  • প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে মাদকাসক্তির চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করা।
  • সীমান্ত এলাকায় মাদক পাচারে জড়িত অতি দরিদ্রদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং সেফটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা।
  • অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রেশন ও ঝুঁকিভাতা প্রবর্তন করা।
  • কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগার আধুনিকীকরণ করা।
  • মাদক-মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পৃথক আদালত গঠন।
  • মাদকের পাচাররোধে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করা।

সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত।

Previous articleদুঃস্বপ্ন মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়: গবেষণা
Next articleবিবাহ বিচ্ছেদ কমাতে পারে একসঙ্গে রোমান্টিক সিনেমা দেখা: গবেষণা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here