মোহাম্মদ লাবু মিয়া। দেশের সবচেয়ে পুরনো বাঁশের বাঁশির কারিগরদের মধ্যে একজন ও বংশীবাদক। নামে না চিনলেও ঢাকা শহরের শাহবাগ থেকে টিএসসি গিয়েছেন, কিন্তু তার বাঁশির সুর শুনেননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। তেষট্টি বছর বয়সী এই মানুষটি বাবার পেশা নিজের মধ্যে লালন করছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবৎ। মনের খবর পাঠকদের জন্য তাকে নিয়েই আজকের তারকার মন। তার মনের খুঁটিনাটি বিষয় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন হাসনাত নাঈম।
মনের খবর: কেমন আছেন?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
মনের খবর: আপনার বাঁশির চর্চা কবে থেকে শুরু?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: মূলত ১৯৭৫ সালে প্রথম বাঁশি নিয়ে রাস্তায় নামি। কিন্তু যুদ্ধের আগে আমি যখন পঞ্চম শ্রেনীতে পড়তাম, তখন থেকেই বাঁশির সঙ্গে আমার সখ্যতা। এটা আমার বাবা মরহুম খাদেম খুকু মিয়ার পেশা ছিলো। আমার কাছে এটা তার ঐতিহ্য। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাচ্ছি তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে।
মনের খবর: ছোটবেলায় আপনি কি হতে চেয়েছিলেন?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: আমি যখন ধানমন্ডি গভার্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র ছিলাম, তখন আমার ইচ্ছে ছিলো বড় বংশীবাদক হবো। কিন্তু চেষ্টায় কিছু ভুল-ত্রুটি থাকায় তা আর হতে পারি নাই। আমাকে বংশীবাদক নাই বলেতে পারেন কিন্তু আমি বাঁশের বাঁশির কারিগর। পৃথিবী যতদিন আছে, বাঁশের বাঁশি ততদিন থাকবেই। এটার মরণ নাই।
মনের খবর: আপনি তো এখনো স্বপ্ন দেখেন, আপনার স্বপ্নটা কেমন?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: এখন তো আর বয়স নাই কিছু করার। তারপরও মানুষের স্বপ্ন থাকে। আমার বাবা ব্রিট্রিশ, ভারত, পূর্ব পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে এই বাঁশের বাঁশির ব্যবসা করেছে। এটা তার ঐতিহ্য। তার ঐতিহ্যকে আমি এখনো লালন করে আছি। আমার স্বপ্ন বংশ পরামপরায় এই ঐতিহ্যের পেশাকে ধরে রাখা। তাই আমার দুই ছেলে আছে এখন এই কাজে। আমার আর একটা স্বপ্ন ছিলো মিউজিকের একটা দোকান কারর। আল্লাহর রহমতে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ২য় তলায় ‘লাবু ফ্লুটস’ নামে একটি মিউজিকের দোকান করতে পেরেছি।
মনের খবর: সব মানুষেরই তো রাগ হয়। আপনার রাগটা কেমন?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: রাগ তো হয়ই। আমি যখন একটা বাঁশি বানানোর পর শত চেষ্টা করেও ভালো সুর তুলতে না পারি, তখন আমার খুব রাগ হয়। কারণ, এতো কষ্টের পরও আমি সুন্দর একটা বাঁশিতে ভালো সুর আনতে পারলাম না। বর্তমানে এটাই আমার রাগের বড় কারণ।
মনের খবর: ঐ সময় রাগ দমন করেন কিভাবে?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: যখন আমি সুন্দর একটা বাঁশিতে ভালো সুর তুলতে না পারি, তখন আমার অন্য বাঁশি গুলো বাজিয়ে নিজের রাগ দমন করি।
মনের খবর: সব মানুষের কিছু না কিছু স্মৃতি থাকে। আপনার স্মৃতি গুলো কেমন?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: স্মৃতি মানুষের জীবনের অংশ। স্মৃতি কখনো সুখের হয় আবার কখনো কষ্টের। আমার স্মৃতিটা কষ্টের। যুদ্ধের পর আমাদের সংসারে অনেক অভাব-অনটন দেখা দেয়। যার ফলে আমি বাধ্য হয়ে জীবিকার জন্য বাঁশি বিক্রি শুরু করি। ১৯৭৫ সালে আমি একদিন আমার বাবার ব্যাগ থেকে ২৫টি বাঁশি নিয়ে আমার স্কুল ব্যাগে ভরে না বলে বাসা থেকে বের হই। সেদিন সকাল ৯টায় বের হয়ে আমি রাত ৯/১০টার দিকে বাসায় ফিরি। এদিকে বাবা-মা খুব চিন্তায় পড়ে যায়। ছেলে কোথায় গেল। সেই সময় বাইতুল মোকারম মসজিদ ও নবাবপুর রোড খুব জমজমাট ছিলো। তাই, ঐ রাস্তায় আমি সারাদিন ঘুরে ঘুরে সব বাঁশি বিক্রি করে রাতে বাসায় ফিরি। পরে মা কিছুক্ষন বাকা দিলো এবং জিজ্ঞাসা করলো কোথায় গিয়েছিলাম। তখন আমি বললাম, বাবাকে না বলে আমি ২৫টা বাঁশি নিয়ে সারাদিন বিক্রি করেছি। তারপর বাঁশি বিক্রির টাকা গুলো মাকে দিলাম। এতে বাবা খুব রাগ করে বললেন, আমি তো এটা চাই নাই।
এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টের স্মৃতিময় বিষয়। এরপর এই বাঁশি নিয়েই আমি ভারত পাকিস্তান ঘুরে বেড়াইছি। আর ১৯৯০ সালের পর থেকে আমি এই চারুকলার সামনে নিয়মিত বসে আসছি।
মনের খবর: আমাদের দেশে বাঁশির অবস্থান কেমন?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: কোন এক সময় আমাদের দেশের গ্রামের মানুষ মনে করতো, বাঁশি শুধু রাখালরা বাজায়। কিন্তু এটা রাখালিয় বাঁশি নয়, বাঁশি উচ্চাঙ্গ সংগীতের একটি অংশ। বাঁশি বাজানোর জন্য পড়াশোনার প্রয়োজন আছে। তাই এখন এটি শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের হাতে। বাংলাদেশে বাঁশির অবস্থান অনেক ভালো আছে। আমার কাছে প্রতিদিনই নতুন পুরাতন ছেলে-মেয়ে আসে বাঁশি বাজানো শিখতে। তারা আমার সঙ্গে এই রাস্তায় বসেই বাঁশি বাজানো শিখে।
মনের খবর: একটি বাঁশি তৈরিতে কতদিন সময় লাগে?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: একরাতে আমি ১৫০ থেকে ২০০ বাঁশি বানাতে পারি। কিন্তু বাঁশি টিউন করতে দীর্ঘদিন সময় লাগে। কিন্তু কতদিন লাগে, সেটা বলা মুশকিল। কখনো বাঁশি টিউন করতে করতে নষ্ট হয়ে যায়।
মনের খবর:কেন আপনি এই জায়গাটাই বেছে নিলেন নিয়মিত বসার জন্য?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: ১৯৭৫ পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ অনুষ্ঠান গুলোসহ সবসময় এই রাস্তায় মানুষে ভরপুর থাকে। এই বিষয়টা আমার কাছে ভালো লেগেছে। দেশের সকল বড় বড় মানুষজন আসতো এখানে। এজন্য আমি এই জায়গাটাকে পছন্দ করেছি। তাই, এই চারুকলার দেয়াল গেসে এখনো বসে আছি। এছাড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আমাকে পছন্দ করে। আমার বাঁশির সুর শুনে। তাদের ভালোবাসাতেই বেঁচে আছি।
মনের খবর:ভালো লাগা ও খারাপ লাগা নিয়েই মানুষের মন। আপনার মনে যত্ন কিভাবে নেন?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: প্রতিদিন সন্ধ্যায় যে আমি এখানে আসি, এটাই আমার এখন ভালো লাগে। আমার এখন সবচেয়ে বেশি সময় কাটে বাঁশের সঙ্গে। এই বাঁশের বাঁশি বানাতে বানাতেই আমার রাত ভোর হয়ে যায়। কোন বাঁশিতে কোন সুর ভালো লাগে, এ গবেষণা করতে করতেই আমার সময় গুলো পার হয়। আমি এখানেই প্রশান্তি পাই।
মনের খবর:এখনো কি হতাশায় ভোগেন কিনা?
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: মানুষের জীবনই একটা হতাশা। হতাশা আমারও আছে। কিন্তু আমি বাঁশিতে সুর দিলে আমার হতাশা কেটে যায়।
মনের খবর:মনের খবরকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ লাবু মিয়া: মনের খবরের জন্য শুভ কামনা। আমার জন্য দোয়া করবেন।