বলতে গেলে প্রায় সব পুরুষের জীবনে কোনো না কোনো সময় প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন বা দ্রুত বীর্যপাত হয়। বিশেষ করে অল্প বয়সী পুরুষদের বেলায় বেশি হয়। তবে সবসময় এটাকে রোগ বলা যায় না। স্বাভাবিক ভাবেই এমনটা হতে পারে।
নারী পুরুষ দুজন ভিন্ন মানুষ। তাদের দুজনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হবে সেটাইতো স্বাভাবিক। পরস্পরের শরীর বুঝে তাল মিলিয়ে নিলে অনেকেরই এ ধরনের সমস্যা চলে যায়। এর জন্য প্রয়োজন যৌন বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান। তাই বলা যায় অনভিজ্ঞ যারা এই সমস্যায় ভুগছেন তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই সমস্যাটা রোগ আকারে নেই। জানা বোঝার দুর্বলতাই তাদের এ ধরনের সমস্যায় ভোগার একমাত্র কারণ।
দ্রুত বীর্যপাতকে রোগ বলব যখন
১. কোনো ব্যক্তির লিঙ্গ তার স্ত্রীর ভ্যাজাইনা বা যোনিপথে প্রবেশ করানোর এক মিনিটের মধ্যে বীর্যপাত হয়ে যায়।
২. তিনি চাইলেও যদি যৌনমিলনের সময়কালকে দীর্ঘায়িত করতে না পারেন, অর্থাৎ বীর্যপাতের উপর যদি তার নিয়ন্ত্রণ না থাকে।
৩. স্ত্রীর যৌন আকাঙ্ক্ষার তৃপ্তি না হওয়ার কারণে যদি দাম্পত্য জীবন যন্ত্রণাদায়ক হয়।
বীর্যপাতের ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত শর্তগুলো পূরণ হলেই কেবল তখনই কেবল তাকে দ্রুত বীর্যপাত বা প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন রোগ হিসেবে সনাক্ত করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে যৌন বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে দম্পতিদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া বা সম্পর্ক থাকতে হবে। সম্পর্কের সমস্যা থেকে যৌন সমস্যা হলে ডাক্তারি মতে তাকে যৌন রোগ বলা যাবে না।
দ্রুত বীর্যপাতের শিকার হন যারা
● সাধারণত কম বয়সী পুরুষ, যাদের যৌন অভিজ্ঞতা কম।
● প্রথমবারের মতো যারা যৌন মিলন করছেন অথবা নতুন কোনো সঙ্গিনীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করছেন।
● সে সব পুরুষ স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন না, ব্যবসা বা চাকরির কারণে দূরে থাকেন এবং অনেকদিন পরপর শারিরীক সম্পর্ক করার সুযোগ পান।
● যৌন মিলনে যারা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন বা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় যৌন মিলন করেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা যায় যে, দ্রুত বীর্যপাত পুরুষদের মধ্যে একটি প্রধানতম যৌন সমস্যা। সাধারণভাবে বলা যায় শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগ লোক এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দেখা যায় যে, এ সমস্যা ১৭ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত বয়সে হতে পারে, এর গড় হার ২২ দশমিক ৭ ভাগ। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ২৪ ভাগ, জার্মানিতে ২০দশমিক ৩ ভাগ, ইটালিতে ২০ ভাগ। আর বাংলাদেশে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় এর হার ২৭ ভাগ।
দ্রুত বীর্যপাতের কারণ
শারীরিক কারণ
● সেরোটোনিন নামক এক ধরনের জৈব রাসায়নিক উপাদানের ঘাটতি।
মানসিক কারণ:
● যৌন বিষয়ে অনভিজ্ঞতা।
● যৌন বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব।
● যৌনতা সংক্রান্ত ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক ধারণা ।
● যৌনতা সংক্রান্ত নেতিবাচক ধারণা, যেমন- যৌনতা মানেই খারাপ,এই বিষয়ে চিন্তা করা, আলোচনা করা খারাপ ছেলেদের কাজ ইত্যাদি।
● হস্তমৈথুন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা, যেমন হস্তমৈথুনে যৌন ক্ষমতা নষ্ট হয়।
● সঙ্গিনীকে যৌন তৃপ্তি দেওয়া সংক্রান্ত অনিশ্চয়তায় ভোগা।
● ছোটবেলায় যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া।
● মাদকাসক্ত রোগী নেশা ছাড়ার পর পর অথবা মানসিক কিছু কিছু রোগের ওষুধ গ্রহণ শুরু করার পর দ্রুত বীর্যপাত হতে পারে।
দ্রুত বীর্যপাত থেকে যেসব সমস্যা দেখা দেয়:
● যৌনমিলনে অনীহা ।
● লিঙ্গ উত্থান জনিত সমস্যা।
দ্রুত বীর্যপাত যেন না হয় এজন্য অনেকেই মিলনের সময় মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে নেন অথবা লিঙ্গে কম অনুভূতি গ্রহণ করেন। ফলে অনেক সময় মনোযোগের অভাবে লিঙ্গ নরম হয়ে যায়। তাতে যৌনমিলন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আবার মিলনের সময় এই মনোসংযোগহীনতার জন্য স্ত্রীর বিরক্তি, যৌন আবেগের ঘাটতি হিসেবে দেখা দিতে পারে।
অন্যদিকে দিকে বার বার দ্রুত বীর্যপাতের জন্য স্ত্রী যৌন মিলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে হবে ভেবে, কোনো কোনো পুরুষ এক ধরনের ‘প্রত্যাশা জনিত চাপ’ বা পারফরম্যান্স অ্যাংজাইটিতে ভুগতে শুরু করেন। ফলে তার মনে স্বাভাবিক যৌন আগ্রহের পরিবর্তে পরীক্ষা পাশের ভীতি কাজ করতে শুরু করে। যৌনমিলন তখন তার কাছে হয়ে যায় পরীক্ষার মতো নিরস ভীতিকর চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। তখন দেখা দেয় লিঙ্গ উত্থান জনিত সমস্যা। তার প্রভাব পড়ে দাম্পত্য সম্পর্কে ।
চিকিৎসা বা প্রতিকার
● দ্রুত বীর্যপাত একটি নিরাময়যোগ্য সমস্যা। দুইভাবে এর চিকিৎসা করা হয়। ওষুধ ও সেক্সথেরাপি।
ওষুধ:
কিছু কিছু ঔষধ আছে যা বীর্যপাতকে বিলম্বিত করে মিলনের সময়কে দীর্ঘায়িত করে। ডেপোক্সিটিন সে ধরনের একটি ঔষধ। যা বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বে এবং বাংলাদেশে দ্রুত বীর্যপাত রোগের একমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত ঔষধ। ঔষধটি দুই স্নায়ুর সংযোগস্থলে সেরোটেনিন জাতীয় নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমান বাড়িয়ে দিয়ে বীর্যপাতকে বিলম্বিত করে। ফলে মিলনের সময় দীর্ঘায়িত হয়।
সাইকোথেরাপী/সেক্সথেরাপী
● সাইকোথেরাপী হল বিশেষ ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে মানুষের চিন্তা চেতনা আবেগ অনুভুতিকে কাজে লাগিয়ে অসুস্থতাকে সাড়িয়ে তোলা হয়। আর তা করা হয় কথা বলার মাধ্যমে।
● যৌন সমস্যার সমাধান যে ধরনের সাইকোথেরাপীর মাধ্যমে করা হয় তাকে সেক্সথেরাপী বলে।
● এটি একটি বিশেষায়িত সাইকোথেরাপী (সেক্সথেরাপী) যা দ্রুত বীর্যপাতে কার্যকরী । এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রী,প্রত্যেকের সেক্স-এর ব্যাপারে আস্থা ফিরিয়ে আনা ও আবেগের সঠিক প্রকাশ নিশ্চিত করা।
● যৌনমিলন ছাড়াও দম্পতির পারস্পরিক বোঝাপড়ায ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
● মোটামুটি ৬-১০টি সেক্সথেরাপী সেশনের মাধ্যমে দ্রুত বীর্যপাত এর চিকিৎসা সম্ভব। আর তাতে সময় লাগে মাত্র তিন সপ্তাহ।সারা জীবনের কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসাকালটি অল্পই বলা যায়।
বিজ্ঞানের এই আধুনিক যুগেও সেক্স সম্পর্কে যথেষ্ট কু-সংস্কার ও ভ্রান্তধারণায় বাস করছি ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ পরিচালিত সাইকিয়াট্রিক সেক্স ক্লিনিকে কাজ করতে যেয়ে তেমনই একটি বাস্তব চিত্রের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত।এ সম্পর্কিত উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকেরও বাংলাদেশে যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে। ফলে বহু সম্ভাবনাময় দম্পত্তির দাম্পত্য জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
দ্রুত বীর্যপাত একটি নিরাময়যোগ্য সমস্যা। ঔষধ ও সেক্সথেরাপির মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনের যৌন অসুবিধা দুর করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।
ডাঃ এস এম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকৎসক, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।