কিরণের বয়স ২৯ বছর। তার দু’টি সন্তান রয়েছে। ছেলেটির বয়স চারবছর এবং মেয়েটির বয়স দু’বছর। কিরণের যখন মাসিক হত তখন সে খুব বদমেজাজি ও খিটখিটে হয়ে পড়ত। তখন সে নিজের কাজকর্মে মনোযোগ দিতে পারত না; কাজ শেষ করার নির্ধারিত সময় নিয়ে কিরণ বেশ অধীর ও উত্তেজিত বোধ করত। অথচ সেই কাজগুলো সে মাসের বাকি দিনগুলোতে অত্যন্ত সহজভাবেই করতে সক্ষম হত। মাসিক চলাকালীন কিরণ মানসিকভাবে বিষণ্ণ বোধ করত এবং ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিত। এইসময়ে কোনও কারণ ছাড়াই বাচ্চাদের উপর রাগারাগি করার পরে তার মধ্যে একপ্রকার অপরাধ বোধ জন্মাত। কিন্তু সমস্যার সুরাহা করার ক্ষেত্রে কিরণ ছিল একেবারে অসহায়।
কিরণের এরকম মেজাজ-মর্জির ঘন ঘন বদল তার সামাজিক, ব্যক্তিগত ও পেশাদার জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। যখন কিরণ ভাবত যে সে একজন মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে তখন তার স্বামী তাকে বলতে তার ‘শুধু পিএমসিং’ (‘just PMSing’) রয়েছে। কিন্তু যখন কিরণ ডাক্তারের কাছে গেল তখন সে জানতে পারল যে তার পিএমডিডি নামক সমস্যা রয়েছে। এরপরে সে একজন মনোবিদের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করল।
প্রি-মেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম (পিএমএস) হল প্রতিটি মাসিক চক্রের সময়ে মহিলাদের মধ্যে শারীরবৃত্তীয় ও হরমোনজনিত পরিবর্তন দেখা দেওয়া। মাসিক চক্রের দ্বিতীয় পর্যায় এই বিশেষ বদল ঘটতে দেখা যায় এবং এর উপসর্গগুলো মহিলাদের ঋতুচক্রের শুরুতে ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে ওঠে। কিছু মহিলার ক্ষেত্রে প্রি-মেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম এতটাই গুরুতর হয়ে ওঠে যে তাদের জীবনযাত্রার মানের অবনতি হয়। এই অবস্থাটাকেই বলা হয় প্রিমেন্সট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার (পিএমডিডি)।
এই দুটোর মধ্যে কী পার্থক্য রয়েছে?
যেখানে ৭৫ শতাংশ মহিলার ক্ষেত্রে প্রি-মেন্সট্রুয়াল সিনড্রোমের উপসর্গ লক্ষ করা যায় সেখানে পিএমডিডি-র সমস্যা মাত্র ৩-৮ শতাংশ মহিলার মধ্যে দেখা দেয়। আপাতভাবে পিএমএস এবং পিএমডিডি-র লক্ষণগুলো একইরকম মনে হয়, যেমন- অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, স্তনের শিথিলতা, পেশি বা গাঁটে ব্যথা, ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা, প্রবল খাওয়ার ইচ্ছা এবং হঠাৎ মেজাজ-মর্জির বদল ঘটা। কিন্তু ভয়াবহতা বা গুরুতর বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এই দুটো সমস্যার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়, অর্থাৎ,
- অবসাদ- পিএমএস-এর ফলে যে অবসাদ দেখা দেয় তাতে কিছুক্ষণের জন্য মহিলাদের মধ্যে বিষণ্ণতার বোধ জাগতে পারে। কিন্তু পিএমডিডি-র ক্ষেত্রে বিষণ্ণতা, অসহায়তা, অপরাধ বোধ বেশ গভীর হয়ে দেখা দিতে পারে। এছাড়া আত্মহত্যার চিন্তাও মাথায় আসতে পারে।
- উদ্বেগ- পিএমএস-এর ক্ষেত্রে মানসিক উদ্বেগ খুব কম বা না-ও দেখা দিতে পারে। কিন্তু পিএমডিডি-র ক্ষেত্রে উদ্বেগ খুবই গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। সেই সঙ্গে সবসময়ে মানসিক উত্তেজনা ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ
জাগতে পারে। - মেজাজ-মর্জির বদল- পিএমএসে আক্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে মর্জির বদল ঘটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ঘটনা। কিন্তু পিএমডিডি-র ক্ষেত্রে সমস্যা গুরুতর হয়। জীবনের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ তাদের নাগালের বাইরে চলে যায় এবং কখনও কখনও খুব সামান্য বিষয় নিয়ে তারা লড়াই-ঝগড়া শুরু করে।
- জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি- পিএমএস-এর সময়ে মহিলারা অবসাদে ভোগে এবং তারা তাদের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পিএমডিডি-র ফলে তারা তাদের পরিবার ও কাজকর্মের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়ে। আর এই অবস্থাতেই তারা সবসময়ে থাকতে চায়।
পিএমডিডি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নীচের দশটি লক্ষণের মধ্যে পাঁচটি থাকতেই হবে এবং প্রথম চারটির মধ্যে অন্ততপক্ষে একটা ঋতুস্রাবের আগে চক্রাকারে দেখা দিতে হবে-
১. উল্লেখযোগ্যভাবে বিষণ্ণতা, হতাশায় ভোগা বা আত্মহননের চিন্তা করা
২. গুরুতর মানসিক উদ্বেগ বা উত্তেজনা
৩. উল্লেখযোগ্য অনুভূতিগত পরিবর্তন
৪. লাগাতার এবং জোরদার খিটখিটে ভাব
৫. দৈনন্দিন কাজকর্মে আগ্রহ কমে যাওয়া
৬. মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটা
৭. ক্লান্তি, শক্তির অভাব বোধ করা
৮. খিদের ধরন বদলে যাওয়া, খাওয়ার প্রবল ইচ্ছে জাগা ও বেশি পরিমাণে খাওয়াদাওয়া করা
৯. অতিরিক্ত ঘুম বা অনিদ্রায় ভোগা
১০. শারীরিক সমস্যা হিসেবে স্তনে ব্যথা, অতিরিক্ত ঋতুস্রাব এবং মাথা ব্যথা
দেখা দেয়।
পিএমএস মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের সাহায্যের প্রয়োজন না-ও পড়তে পারে, কিন্তু পিএমডিডি-র জন্য বিশেষজ্ঞের সহায়তা একান্ত জরুরি হয়ে ওঠে।
পিএমডিডি হওয়ার পিছনে কী কারণ থাকে?
পিএমডিডি-র সঠিক কারণ এখনও অজানা। কিন্তু ঋতুচক্রের সময়ে হরমোনের মাত্রার ওঠা-পড়া এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। পিএমএস ও পিএমডিডি-র সঙ্গে অবসাদ ও অন্যান্য মেজাজগত সমস্যা যুক্ত থাকে। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টা অজানা। অর্থাৎ, এর কারণ অবসাদ অথবা এর ফলাফল পিএমএস বা পিএমডিডি কিনা, তা পরিষ্কার নয়।
কীভাবে পিএমডিডি নির্ধারণ করা হয়?
পিএমএস বা পিএমডিডি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনও প্রথাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। কিন্তু সমস্যার লক্ষণগুলোর স্থায়িত্ব, গভীরতা ও গুরুত্বের উপর নির্ভর করে ডাক্তার এই সমস্যা নির্ধারণ করতে সক্ষম হন। এজন্য প্রায়শই ডাক্তাররা দুটো মাসিকচক্রের তালিকা তৈরি করে। এই তালিকায় সাধারণভাবে মহিলাদের মানসিক অবস্থা, বাহ্যিক লক্ষণ এবং খাওয়া ও ঘুমের ধরনের সম্পূর্ণ তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর ডাক্তার সেই লক্ষণগুলো পরীক্ষা করেন এবং তাদের গুরুতর বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে পিএমএস বা পিএমডিডি নির্ধারণ করে থাকেন।
সমস্যার সম্পূর্ণ চিহ্নিতকরণের জন্য মহিলাদের থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যা, যেমন- অবসাদ রয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। এছাড়া অন্যান্য সম্ভাব্য কারণগুলোও সমস্যা নির্ধারণের করার ক্ষেত্রে খতিয়ে দেখা হয়। এসবের উপর নির্ভর করে পিএমডিডি-র চিকিৎসা করা হয়।
কীভাবে পিএমডিডি-র চিকিৎসা করা হয়?
এই চিকিৎসার লক্ষ্য হল মহিলাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। পিএমএস-এর মোকাবিলা করা যায় জীবনযাত্রার বদল ঘটিয়ে, যেমন- সঠিক খাওয়াদাওয়া এবং শরীরচর্চা করে। পিএমডিডি-র চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে-
- ওষুধ প্রয়োগ- এক্ষেত্রে অবসাদবিরোধী ওষুধ ব্যবহার করা হয় এবং তা সমস্যার লক্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষেত্রে কার্যকরী ফল দেয়। জন্ম নিরোধক বড়িও ডিম্বাণু উৎপাদন বন্ধ করার জন্য প্রয়োগ করা হয়। এভাবে পিএমডিডি-র লক্ষণগুলো কমানোর চেষ্টা করা হয়। একটা কথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে এইধরনের ওষুধগুলো শুধু পিএমডিডি-র চিকিৎসার জন্যই স্বীকৃত, পিএমএস-এর জন্য নয়।
- আচরণগত কৌশল- ওষুধের সঙ্গে মানসিক চাপ ও রাগ আয়ত্তে রাখার কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে।
- জীবনযাত্রার পরিবর্তন- নিয়মিত শরীরচর্চা, সঠিক খাদ্যতালিকা, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক চাপ কমিয়ে সমস্যার লক্ষণগুলোর মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।
সূত্র-
১. Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, 4th Edition (2000).
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন