বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি আমাদের প্রধান সহায়ক। চলার পথে প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা প্রযুক্তিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে চলি। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ আমাদের জীবনকে করছে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। কিন্তু সেই সঙ্গে এই প্রযুক্তিই আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য হয়ে উঠেছে দুর্ভাগ্যের কারণ।
বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করলেই দেখা যায় ছোট্ট শিশুদের দেবার মত সময় ব্যস্ত কর্মজীবী দম্পতির নেই। তাই শিশুকে ভুলিয়ে নিজেদের কাজে সুবিধা করার জন্য তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে সেলফোন বা ট্যাবলেট। যে বয়সে বাবা-মায়ের মুখে বিভিন্ন গল্প শোনে সময় কাটানো কথা, সে বয়সে আমরা তাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছি কার্টুন দেখতে দিয়ে। কার্টুন তো শিশুর অবশ্যই ভালো লাগার বিষয়। আর সেলফোন, ট্যাবলেট, টেলিভিশন ও কম্পিউটারের মত ডিভাইসগুলোও শিশুরা সব সময়ই উপভোগ করে। কিন্তু সেটারও একটা বয়স আছে, সময় আছে। অনেক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এই সকল ইলেকট্রনিক ডিভাইসের অনেক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ডিভাইসগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার একটি শিশুর সামাজিক দক্ষতা উন্নয়নে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা, কাজের দায়িত্ব নেওয়া, ভালো আচরণ প্রদর্শন করা, মার্জিত ভাষা ব্যবহার, আবেগ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ, মৌখিক নির্দেশনা অনুসরণ এবং অন্যদের জন্য সহানুভূতি গড়ে তোলার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এছাড়াও একটি শিশু সামাজিক সংকেতে কম মনোযোগী ও কম শনাক্ত করতে পারে। শিশুর ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারে বেশি সময় ব্যয় করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। শুধু তাই নয় এটি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কিশোরদের মধ্যে যারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে ফেসবুকে লগইন করে তাদের প্রবল রাগ, মানসিক বিপর্যয়, আক্রমণাত্মক, অসামাজিক আচরণ ও অস্পষ্টতা বেড়ে যায়। গবেষণায় আরো দেখা যায়, যারা নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং ভিডিও গেমস খেলে তারা বেশি উদ্বেগ এবং হতাশা প্রদর্শন করে। এটি মস্তিষ্কের নির্বাহী কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। এই এক্সিকিউটিভ ফাংশন যেমন- পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার দেওয়া, সংগঠিত করা, এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও অন্তর্ভুক্ত। ফ্রন্টাল লোব হলো মস্তিষ্কের ক্ষেত্র, যা আমাদের নির্বাহী কার্য এবং জ্ঞানীয় দক্ষতা নিয়ন্ত্রণ করে। ইলেকট্রনিক্সের অত্যধিক ব্যবহারে ধূসর পদার্থ, ক্ষয় বা টিস্যু ভলিউমের ক্ষতি হতে পারে। ধূসর পদার্থ মেমরি, পেশি নিয়ন্ত্রণ, আবেগ, বক্তৃতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্ব-নিয়ন্ত্রণ, এবং দৃষ্টিভঙ্গি এবং শোনার মত কাজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের অত্যধিক ব্যবহার একটি শিশুর উপর শারীরিক প্রভাবও ফেলে। গবেষণায় আরো পাওয়া গেছে, যারা ভিডিও গেমস খেলে ও টেলিভিশন দেখার জন্য বেশি সময় ব্যয় করে তাদের স্থূলতা, ঘুমের সমস্যা এবং পেটের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। যে সকল শিশুরা ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলে, তাদের মাঠে বা বাইরে খেলতে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তারা বাস্তবিক খেলনাগুলোতে আগ্রহ হারায়, প্রেরণার অভাববোধ করে এবং ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি আগ্রহ থাকে না। আরো দেখা যায়, যারা বেশি সময় টেলিভিশন দেখে তারা পড়াশোনায় আগ্রহবোধ করে না এবং ধৈর্য ধারণের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। তাই আপনি যদি মনে করেন আপনার সন্তান ইতোমধ্যেই ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসে আসক্ত হয়েছে, তাহলে দ্রুত আপনার সন্তানের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো আনতে পদক্ষেপ নিন।
স্বাস্থ্যকর অনলাইন অভ্যাস গড়ে তুলতে উৎসাহ দিন
অনলাইনে এবং ভিডিও কলগুলোতে ভালো আচরণ প্রচার এবং পর্যবেক্ষণ করুন। আপনার শিশুদেরকে তাদের সহপাঠীদের প্রতি সদয় ও শ্রদ্ধাশীল হতে, পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে রুচিশীল হতে এবং শয়নকক্ষ থেকে ভিডিও কলে যোগদান এড়িয়ে চলতে উৎসাহিত করুন।অনলাইনে উৎপীড়ন বা অনুপযুক্ত অনলাইন সামগ্রী সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে স্কুলের নীতিমালা ও হেল্পলাইনের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করুন। শিশুরা অনলাইনে বেশি সময় ব্যয় করার কারণে তাদের অনেক বেশি বিজ্ঞাপনের সংস্পর্শে আসতে হতে পারে, যেসব বিজ্ঞাপনে অস্বাস্থ্যকর খাবার, লৈঙ্গিক ধারণাভিত্তিক বা বয়স অনুপযুক্ত উপাদানের প্রচারণা থাকতে পারে। তাদের অনলাইন বিজ্ঞাপনগুলো শনাক্ত করতে এবং আপনার দেখা কিছু নেতিবাচক বার্তাসহ ভুলগুলো একত্রে খুঁজে বের করার সুযোগটি ব্যবহার করতে সহায়তা করুন।
আপনার সন্তানকে নিজে সময় দেন এবং ভালো বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে বলুন। ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারে সময় নির্ধারণ করে দিন। সামাজিক কাজে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য উৎসাহ দিন। সন্তানদের সামনে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের ব্যবহার পরিহার করে, নিজেই হয়ে উঠুন সন্তানের আদর্শ মডেল।
উক্ত নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশিত। প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।