প্রতিটি প্রতিকূলতা নতুন সুযোগ নিয়ে আসে

0
56

প্রতিটি প্রতিকূলতা মানুষের জীবনে সবসময় নিয়ে এসেছে নতুন সুযোগ, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা। যদিও পাটিগণিতের কিছু অংক আমরা ছোটবেলায় করেছি ভিন্ন কথায়। যেখানে একজন মাঝি থাকতেন, থাকত তার নৌকা, আর নদীতে থাকত স্রোত, কখনো অনুকূল স্রোত, কখনো প্রতিকূল স্রোত। এবং আমাদেরকে সমাধান করতে হতো এরকম যে, সেই মাঝি স্রোতের অনুকূলে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিচ্ছেন দুই ঘণ্টায় আর ফিরে আসতে সেই পাঁচ কিলোমিটার পথই তার পাড়ি দিতে লাগছে চার ঘণ্টা, যখন স্রোত থাকে প্রতিকূলে। যেখানে স্রোতের অনুকূলে তার নৌকার গতিবেগ ছিল ১০ কিলোমিটার আর স্রোত যখন প্রতিকূল তখন গতিবেগ কমে এসেছে ছয় কিলোমিটারে।
সাধারণ হিসাব বলে যে, এটাই তো হয়, এটাই হবে। চারদিকে আনুকূল্য থাকলে এগুনো সহজ, কম সময়ে বেশিদূর যাওয়া যায়। আর কোনো একটা প্রতিকূলতা চলে এলেই হলো! দুই ঘণ্টার জায়গায় তখন লাগবে চার ঘণ্টা, কিংবা গতি ১০ কিমি থেকে কমে হবে ছয় কিমি। যেমন, বাতাসের সময় সাইকেল চালাতে বাতাস সাহায্য করে তাই সময় কম লাগে। যুক্তি ঠিক আছে। কিন্তু বিশ্বাস যেখানে চলে আসে যুক্তি সেখানে খোঁড়া হয়ে যায়। আর বিশ্বাস বলে যে, প্রতিকূলতা যত বেশি এগিয়ে যাওয়াটা ধীর হলেও সেই এগোনোটা একটা সময় হয়ে যায় ঐতিহাসিক উদাহরণ। আমরা কয়েকটি জীবনের কথাই আজকে শুনি। তাহলেই দেখব প্রতিকূলতা তাদেরকে করেছে মহান, করেছে কালজয়ী।
দুখু মিয়া বলে আমরা চিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। এই যে দুখু মিয়া থেকে জাতীয় কবি হওয়া-এই সাফল্য আসলে তার মনের প্রচণ্ড শক্তির বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। দুঃখে দুঃখে তার জীবন কেটেছে বলে তার নাম ছিল দুখু মিয়া। এত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যে, মাত্র ১১ বছর বয়সে আসানসোল শহরে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে রুটির দোকানে কাজ নিয়েছিলেন। পরে পড়াশোনার কিছুটা সুযোগ পেলেও এন্ট্র্যান্স (এখন যেটা এসএসসি) পরীক্ষা দিতে পারেন নি। চলে গেলেন যুদ্ধে। সেখান থেকে ফিরে কোলকাতায় এসে পুরোদমে লেখা শুরু করলেন কবিতা। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। বেরুলো অগ্নিবীণা ও বিষের বাঁশি। রবীন্দ্র প্রতিভা তখন মধ্য গগণে। আর কোলকাতার শিল্প-সাহিত্য সংবাদপত্র তখন উচ্চবর্ণের দখলে। কোনো বৈরী পরিবেশই নজরুলের আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা আটকে রাখতে পারে নি।
জর্জ বার্নার্ড শ’-কে আমরা চিনি আইরিশ নাট্যকার হিসেবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাকে চেনে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে। অথচ আমরা কি জানি যে, তিনি স্কুলে পড়ালেখা করেছেন কত বছর? মাত্র পাঁচ বছর। মাত্র ১৫ বছর বয়সে কেরানির কাজ নেন। কারণ, দারিদ্র্য। তা-ও বেতন ছিল কত জানেন? আমাদের টাকায় মাসে ৪০ টাকা। কিন্তু তিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, একদিন তিনি একজন বড় লেখক হবেন এবং হয়েছেনও। কীভাবে? তিনি প্রতিদিন লিখতেন। এই লেখা ছিল নিয়মিত। লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে তার সময় লেগেছিল নয় বছর। লেখক জীবনের প্রথম এই নয় বছরে তার লেখা থেকে আয় হয়েছিল আমাদের টাকার হিসেবে মাত্র ৩০০ টাকা। কিন্তু লেখক হিসেবে পরবর্তী সময়ে উপার্জন করেছেন লাখ লাখ টাকা। তার বিশ্বাসই তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেইসাথে ছিল কিছু কৌশল। যখন তার বই সেভাবে বিক্রি হচ্ছিল না, তিনি দোকানে দোকানে যেতেন আর জিজ্ঞেস করতেন যে, র্বার্নাড শ’-র বই আছে কিনা? তারা বলত যে, র্বার্নাড শ’ আবার কে? তিনি বলতেন, এত বড় লেখককে চেনেন না। বিভিন্ন দোকানে দোকানে গিয়ে এইভাবে বলতে থাকতেন। দোকানিরা দোকানিরা মিলেও তো কথা হয়। তারা একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করছে, এরকম এসে খুঁজছে। তোমার কাছে আছে কিনা। বলে যে নাই, কিন্তু মনে হচ্ছে এনে রাখা দরকার। দেখা যেত যে, এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত দোকানে দোকানে র্বার্নাড শ’-র বই এবং লোকজনও কেনা শুরু করেছে।
শুধু সাহিত্য নয়, যারা বিত্তবান হয়েছেন তাদের ক’জন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন? এক এক করে আমাদের দেশের বিত্তবানদের দিকে তাকালে দেখব তাদের অধিকাংশই এসেছেন সাধারণ অবস্থা থেকে। মনের শক্তির উপরে বিশ্বাস ও সেই শক্তির উদ্ভাবনী প্রয়োগই তাদের সফল করেছে। ভারতেশ্বরী হোমসের প্রতিষ্ঠাতা আর পি সাহার জীবন যদি দেখি, নিতান্ত দীনহীন অবস্থা থেকে তিনি ধনকুবেরে পরিণত হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও যারা ধনকুবের হিসেবে পরিচিত তাদের শতকরা নব্বই জনই খুবই সাধারণ অবস্থা থেকে এসেছেন।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের কথাই ধরুন। এর যে প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বিনি, তার ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজতে গিয়ে বিশ্লেষকরা একবাক্যে যে কথাটি বলেন সেটা হচ্ছে ‘এ ট্রু স্টোরি অফ র‌্যাগস টু রিচেস’। কেন? কারণ গ্রামের এক সাধারণ স্কুল শিক্ষকের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে মেজ ছিলেন ধীরুভাই। যখন মেট্রিক (এখন যেটা এসএসসি) পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এলেন, অসুস্থ বাবা বললেন সংসারের হাল ধরতে। বাবার অনুরোধ রাখতে তিনি ছুটলেন এডেনে জীবিকার সন্ধানে। যোগ দিলেন জাহাজে মাল পরিবহনকারী একটি কোম্পানিতে মাল খালাসের কেরানি হিসেবে। অবশ্য স্কুলে পড়াকালীনও তিনি ছুটিছাটায় তীর্থযাত্রীদের মাঝে ভাজাভুজি বিক্রি করতেন। এডেনে কেরানির কাজ, তারপর কিছুদিন তেলের ফিলিং স্টেশনে কাজ করার পর গেলেন দুবাইতে। সেখানে কিছু টাকা-পয়সা জমিয়ে এলেন দেশে। শুরু করলেন টেক্সটাইল ব্যবসা। এটাই ছিল আজকের রিলায়েন্সের শুরু।
আসলে প্রতিটি প্রতিকূলতা কাটাতে প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শুকরিয়া এবং বাস্তব কাজ। আর বাস্তবে কাজে নামার জন্যে প্রয়োজন বিশ্বাস। শুধু সাফল্যের ক্ষেত্রে নয়, রোগ থেকে নিরাময়ের জন্যে, সুস্থতার জন্যেও বিশ্বাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’-এর যে ধারণা তা মূলত এ বিশ্বাসেরই আধুনিক পরিভাষা। রোগমুক্তির বেলায় রোগীর বিশ্বাসই মূল ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানীরা বলেন, কখনো কখনো ওষুধের চেয়েও ভালো কাজ করে। বিষণ্ণতা, অস্টিও আর্থ্রাইটিস, পার্কিনসন্স, আইবিএস, মাথাব্যথা ও ত্বকের সমস্যা দূর, ব্যথা উপশম, হৃদযন্ত্রের গতি ও রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা, ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং কিডনি অকার্যকারিতায় এসব রোগে যারা ভুগছেন তাদের মধ্যেও আশাবাদী ও বিশ্বাসী মানুষরা তুলনামূলক সুস্থ জীবনযাপন করেন। কারণ একটাই-বিশ্বাস নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
বিশ্বাস যদি করা যায়, তাহলে তা আপাতদৃষ্টিতে দুরারোগ্য ব্যাধিকেও নিরাময় করে দিতে পারে। বিখ্যাত লেখক ও মনস্তাত্ত্বিক নেপোলিয়ান হিল মনের বলের আরো চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তার ছেলে জন্মগ্রহণ করে কানের পর্দা ছাড়া। ছেলে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় ডাক্তাররা তাকে জানায়, সারা জীবন সে বধির থাকবে। হিল লিখেছেন, আমি বিশ্বাস করতাম তার শোনার একটা বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টি করার জন্যে প্রকৃতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা আমার রয়েছে। আমি তার অবচেতন মনের মাধ্যমে কাজ শুরু করি। ক্রমাগত চেষ্টার ফলে স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতার ৬৫ ভাগই পুনরুদ্ধারে সক্ষম হই। অবচেতন মন ইন্দ্রিয়ের অভাবও পূরণ করতে পারে বিকল্প মাধ্যমে।
সূত্র: একুশে টিভি অনলাইন

Previous articleকিশোরদের জন্য মদের চেয়ে গাঁজা ক্ষতিকর: গবেষণা
Next articleবিষণ্ণতার সঙ্গে জিনের সম্পর্ক, চিকিৎসায় খুলবে নতুন দিগন্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here