প্যানিক ডিসঅর্ডারে কার কি দায়িত্ব

0
32

২৬ বছরের কন্যার মাথায় খুব যত্ন করে পানি ঢালছেন জাহেদা বেগম। মেয়েটার কিছুদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে এক রোগ, যেটার কারনে পুরো পরিবারই বেশ অস্থিরতায় আছেন। মেয়েকে নিয়ে গত এক মাসের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি রেখেছিলেন দুইবার। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে যাওয়া, তার সাথে বুক ধড়ফড় করা, হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া এবং সাথে তীব্র মৃত্যুভয় –এরকমটা দেখে ঘরের কেউই স্থির থাকতে পারেন না। হাসপাতালে সব শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যদিও সব কিছু স্বাভাবিক পাওয়া গেল, জাহেদা বেগমের মন শান্ত হলোনা। তার ভয় থেকেই যাচ্ছে। মেয়ে কিছুটা হলেও ডাক্তারের পরামর্শে স্থির থাকার চেষ্টা করলেও মায়ের মন কেবলই আশংকায় ছেয়ে যায়।

জাহেদা বেগমের প্রশ্ন যদি কোন কিছু শরীরে সমস্যা না থাকে তাহলে এমন হবে কেন? তাই উনি হোমিওপ্যাথির কিছু ওষুধ, পরিচিত একজন নবীন চিকিৎসকের কাছ থেকে শ্বাসকষ্টের কথা বলে ইনহেলার, ঘরোয়া পদ্ধতি যেমন মাথায় পানি ঢালা; বিভিন্ন মশলা সমৃদ্ধ তেল মালিশ, তাবিজ সবই চালিয়ে যাচ্ছেন। মেয়েকে চিকিৎসক যা নিয়ম কানুন দিয়েছিলেন, সেগুলো এক দুইবার কাজে না আসায় আর সেগুলোর প্রতি ভরসা নাই তার। তবে এতসব করেও লক্ষন দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে।

* ৪৫ বছরে এসে প্রতিদিন নিজের সাথে একটা যুদ্ধ চালাতে হচ্ছে সাদাত সাহেবের। বাবার মৃত্যুর চার পাঁচ মাস পর থেকেই ঘটনাটা হচ্ছে। প্রথমে রাতে ঘুম থেকে উঠে বিষয়টা হতো৷ বুকটা চেপে আসতো, সাথে পেটেও ব্যথা, হাত পা কাঁপুনি, তলপেটে মোচড় আর সেই সাথে প্রচন্ড ভয়৷ উঠে টয়লেট যেতে যেতে বুঝতে পারতেন ঘামে ভিজে গেছেন একদম। পরে এটা দিনের বেলাও শুরু হলো। শিক্ষক মানুষ তিনি। একসময় ক্লাসে, টিচার্স রুমেও এই অভিজ্ঞতা হলো। ঊর্দ্ধে আধা ঘন্টা এই অবস্থার সাথে যুদ্ধ করা লাগে, কিন্তু সেটাই ইদানিং খুব ক্লান্ত, বিষন্ন করে তুলছে তাকে৷ স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা এই অবস্থাটাকে কোনরকম গুরুত্বই দিতে চায়না এটা আরো একটা কষ্ট। এক বন্ধুকে বলার পর সেও হেসে উড়িয়ে দিয়েছে৷ তবে সাদাত সাহেব নিজে এটাকে হার্টের সমস্যা হিসেবে মনে করেন এবং প্রায়ই ইসিজি করান এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখান।

উপরের ঘটনাগুলো প্যানিক ডিজঅর্ডার বা হঠাৎ তীব্র আতংকের রোগের রোগীদের ক্ষেত্রে হরহামেশাই হয়ে থাকে। রোগী নিজেও বুঝে উঠতে পারেন না যে কি করতে হবে, পরিবারের সদস্যরাও হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন, চিকিৎসকদের সিদ্ধান্ত গ্রহনেও বিভিন্ন সমস্যা হতে থাকে। এরকম ক্ষেত্রে কার কি করনীয় সেই বিষয়েই আজকের লেখা।

রোগীর নিজের করনীয়ঃ প্যানিক ডিজঅর্ডারের জন্য একজন চিকিৎসকের দেয়া ব্যবস্থাপত্র মেনে নেয়াই যথেষ্ট। একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছে সম্পূর্ন ইতিহাস বলা, শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা যথাযথ ভাবে করার পর, সংশ্লিষ্ট ল্যাবরেটরি পরীক্ষা যেমন রক্তের কিছু পরীক্ষা, ইসিজি এগুলো করিয়ে নেয়া -এটা প্রয়োজন। চিকিৎসক সেই অনুযায়ী ওষুধ, রোগ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য, কিছু ব্যয়াম, রুটিনের পরিবর্তন এগুলো দেবেন। সেইসব মেনে চলা এবং নিয়মিত ফলো আপ করালে রোগটি অনেক নিয়ন্ত্রনে থাকে, অনেক রোগী সম্পূর্ন লক্ষনমুক্ত থাকেন।

  • একাধিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, বার বার প্যানিক এটাক হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া,অক্সিজেন নেয়া, ইনহেলার ব্যবহার, ঘুমের ওষুধ খাওয়া, প্যানিক এটাকের ভয়ে জীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাদ দেয়া, একা থাকতে না পারা এরকম পদ্ধতিগুলো প্যানিক এটাক হওয়াকে আরো বাড়িয়ে দেয়। কারন মস্তিষ্ক তখন শিখে যে এই এটাকগুলো ভয়ংকর কিছু এবং সেই জন্য কোন না কোন ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এড়িয়ে যাওয়া বা এরকম ছদ্মআত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থাগুলো এই সমস্যা কে তখন জিইয়ে রাখে।

তাই প্যানিক এটাকের সময়টাকে যেতে দিতে হবে। প্রথমদিকে রিলাক্সেশন করা যায়৷ গভীর ভাবে পেট ফুলিয়ে নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে পেট চেপে শ্বাস ছেড়ে দিতে হবে কয়েকবার৷ এতে করে দম বন্ধ লাগা,

বুকে চাপ লাগা এসব লক্ষন নিয়ন্ত্রন করা যাবে। যার ফলে পরবর্তিতে এই সময় স্থির থাকা সম্ভব হবে। এছাড়াও শুরুর দিকে আরামদায়ক স্থানে বসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে দেখেও এটাকের সময়টাকে যেতে দেয়া/ নিয়ন্ত্রন করা শিখে নেয়া যায়।

  • জীবন যাপন স্বাভাবিক রাখতে হবে। প্যানিক ডিজঅর্ডারের রোগী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জীবন যাপন কে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন, ঘরের বাইরে যান না, ওষুধ সাথে রাখেন এবং যেকোন সময়েই সেই ওষুধ ব্যবহার করেন, চিকিৎসক নির্ভর হয়ে যান, সাময়িক ভাবে উদ্বিগ্নতা কাটাতে ধুমপান মদ্যপানের আশ্রয় নেন, বার বার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। এইরকম ‘সতর্কতা মূলক’ ব্যবস্থাগুলো বন্ধ করতে হবে। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যকর নিয়ম কানুন গুলো মেনে চলা, যেমন সারাদিনে আট থেকে দশ গ্লাস পানি পান করা, পর্যাপ্ত ঘুমানো, পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, অন্য কোন রোগ থাকলে সেটার যথাযথ চিকিৎসা করা, ধুমপান, মদ্যপান, অন্য কোন আসক্তি থেকে বিরত থাকা- এগুলো পালন করাই যথেষ্ট। যেমন কারো ডায়াবেটিস এবং প্যানিক ডিজঅর্ডার আছে। সেই ক্ষেত্রে নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করতে হবে এবং ডায়াবেটিসের ওষুধ নিয়ম কানুন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মেনে চলতে হবে। এই রোগী যদি খালি পেটে ব্যায়াম করেন, তাতে তার রক্তে শর্করা কমে গিয়ে প্যানিক এটাকের মতোই লক্ষন দেখা দিবে এবং এই আতংক থেকে সহজে বের হতে পারবেন না, কারন প্রতিবারই তার একটা ভয় থাকবে যে লক্ষনগুলো শর্করা কমে যাওয়ার জন্য।

*অভিভাবকের/পরিবারের সদস্যদের করনীয়ঃ প্যানিক ডিজঅর্ডার যে কোন বয়সেই হতে পারে, তবে তরুণ বয়স থেকে শুরু করে মধ্যবয়সেই বেশি দেখা যায়। এরকম ক্ষেত্রে অভিভাবক এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের রোগীর সমস্যা হেসে উড়িয়েও দেয়া যাবেনা, আবার অতিরিক্ত যত্নআত্তিও করা যাবেনা।

  • পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া হলে রোগীর জন্য সেটা খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় এবং সেটা বাড়তি মানসিক চাপ হিসেবে কাজ করে। তাই এই কষ্টটা যে তার আছে সেটা মেনে নিতে হবে। “এগুলো কিচ্ছুনা, ঢং, কাজ করলেই হবে” এই জাতীয় মন্তব্য বন্ধ করতে হবে।
  • সাধারনত প্যানিক ডিজঅর্ডার শুরু হয় জীবনে বড় ধরনের কোন চাপমূলক পরিস্থিতির পর অথবা কাছের কোন মানুষের মৃত্যু/ অসুস্থতা, জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তনের পর দেখা দেয়। তাই এই রোগের রোগীকে সেই চাপমূলক পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সহায়তা করাটা খুব প্রয়োজন। যেমন শোকের পর এই অবস্থা দেখা দিলে শোকের অনুভূতি প্রকাশ করতে দেয়া, আর্থিক ক্ষতির পর শুরু হলে সেইটা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা ইত্যাদি।
  • অতিরিক্ত যত্নআত্তি, নিজেরা ভয় পেয়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভুল ধারনা দেয়া সাধারন ভাবে সাহায্যের সমার্থক। চেম্বারে প্যানিক ডিজঅর্ডারের রোগী বলছিলেন তার একজন আত্মীয় দেখা হলেই “বুক ধড়ফড় করে কিন্তু আমার বড় ভাইয়ের হার্ট এটাক হয়েছিলো, আপনি সাবধানে থাইকেন কিন্তু” এই রকম কথাবার্তা বলেন। পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন এই রকম উপকার কতটা ভয়ংকর হতে পারে।

* চিকিৎসকের করণীয়ঃ চিকিৎসক রোগীকে যথাযথভাবে রোগ নির্ণয়ের পর এই রোগটি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারনা দেবেন। যদি ওষুধ, মনস্তাত্ত্বিক এবং আচরনগত চিকিৎসা কাজ না করে, অথবা অন্য কোন মানসিক রোগ একসাথে থাকে, সেই ক্ষেত্রে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করবেন।

প্যানিক ডিজঅর্ডার আক্রান্ত পাশের ব্যক্তিকে সাহায্য করতে পারবেন নিজ অবস্থানে থেকেই- এই আশায় শেষ করছি। কভিড প্যানডেমিকের পরবর্তী এই রোগটি অনেক ব্যাপক আকারে দেখা দেয়ার তথ্যও প্রচুর। সুতরাং নিজ অবস্থানে এই রোগের বিষয়ে সহযোগিতা খুব গুরুত্বপূর্ন।

ডা. সৃজনী আহমেদ

সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ

ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ১০ম সংখ্যায় প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

Previous articleঅতি চঞ্চলতার বিস্তারিত; মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনের জানুয়ারি সংখ্যায়
Next articleকরোনা ভাইরাসের আক্রমণ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলেছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here