পারিবারিক বন্ধন আয়ু বাড়ায়

0
88

মানুষ জীবনের পরতে পরতে বিভিন্ন উপলক্ষে ক্রমশ যুক্ত হতে থাকে নানা সামাজিক বন্ধনে। এসব সম্পর্কের গাঁথুনি যার জীবনে যতটা সুনিবিড় ও দৃঢ়, জীবনটাও তার কাছে ততটা উপভোগ্য ও সহজ। মানসিক দিক থেকেও তারা অধিক উঁচু স্তরে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সুষম পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনে যারা বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পান, তারা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘায়ু হন

গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে যারা বসবাস করে তাদের খাদ্যাভ্যাস তুলনামূলক স্বাস্থ্যকর এবং সুস্থ্য জীবনধারায় অভ্যস্ত। তাদের গভীর বিশ্বাস- আসুক যতই কঠিন সময়, কেউ না কেউ পাশে এসে ঠিক দাঁড়াবেই।

পারিবারিক বন্ধনে বাড়ে আয়ু : পারিবারিক একাত্মতা জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলে। বিজ্ঞানীরা রীতিমতো জোর দিয়ে বলছেন, পারিবারিক সম্প্রীতির সঙ্গে মানুষের দীর্ঘায়ু অর্জনের সম্পর্কটা একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত। তাদের মতে, বাবা-মা, সন্তান ও ভাইবোনদের সঙ্গে কাটানো আনন্দঘন মুহূর্ত দীর্ঘায়ু লাভে বিশেষভাবে সহায়ক। কিন্তু পারিবারিক বন্ধন যাদের দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে উল্টোটা।

পারিবারিক বন্ধনের সুফল : পারিবারিক একাত্মতার সুফল মানুষ পেতে শুরু করে জীবনের গোড়া থেকেই। যেসব পরিবারে বাবা-মা ও সন্তানদের মাঝে উষ্ণ সম্পর্ক বিরাজমান, ক্যান্সারের মতো অসুখে পড়ার সম্ভাবনা তাদের কম এবং এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যেসব পরিবারে একত্রে খাওয়া-দাওয়ার রীতি চালু আছে, তারা তুলনামূলক সুস্থ খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত। সাম্প্রতিক আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, এসব পরিবারের শিশুরা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম।

মৃত্যু ঝুঁকি কমায় : প্রবীণদের মধ্যে যারা তাদের পরিবারের সদস্য ও আপনজনদের প্রতি গভীর সখ্যতা অনুভব করেন, তাদের মৃত্যুঝুঁকি কম। যারা একান্ত সম্পর্কগুলোতে উষ্ণতা খুঁজে পান না, তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি বেশি। আমেরিকান সোশিওলজিক্যাল এসোসিয়েশনের বার্ষিক সভায় ৫৭ থেকে ৮৫ বছর বয়সী তিন হাজার মানুষের ওপর পরিচালিত গবেষণার ফল হিসেবে উক্ত তথ্য প্রকাশ করে।

গবেষকরা মনে করছেন, পরিবারের সদস্য ও প্রিয়জনদের প্রতি দায়িত্ববোধই এসব মানুষকে দীর্ঘজীবন লাভের ব্যাপারে আশাবাদী ও অনুপ্রাণিত করে তোলে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যালা-লানা স্কুল অব পাবলিক হেলথের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক জেমস ইভেন্যুক বলেন, আমাদের উচিত পরিবারের সদস্য-স্বজনদের সঙ্গে আরও একাত্মতা বাড়ানো, কখনোই একে অন্যকে এড়িয়ে চলা নয়।

হৃদ্যতা বাড়ায় তৃপ্তি ও আনন্দ :  আপনি ভালো আছেন, সুস্থ সুন্দর আনন্দময় জীবনযাপন করছেন, এর কিছু কৃতিত্ব দিতে হবে আপনার ভাইবোনদেরও। ভাইবোনের সঙ্গে সম্পর্কটা যাদের মধুর, তারা দৈহিকভাবে তুলনামূলক সুস্থ এবং মানসিক দিক থেকেও প্রজ্ঞাপূর্ণ। এমনটাই মত গবেষকদের।

সম্প্রতি ২৪৬টি পরিবারের সন্তানদের নিয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভাইবোনের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এদের মধ্যে যারা যতটা ইতিবাচক ও একাত্ম, বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার হার এদের ততটাই কম। আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশেষত বোনদের সঙ্গে একাত্মতা রয়েছে যাদের- একাকিত্ব, ভালবাসাহীনতা, আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব, উদ্বেগ, এমনকি ভয়ের মতো নেতিবাচক অনুভূতির আগ্রাসন তাদের জীবনে অনেক কম। আর বয়স এতে কোনো বাধা নয়। কারণ পরিণত বয়সের সুসম্পর্কধারী ভাইবোনদের নিয়ে পরিচালিত গবেষণাতেও দেখা গেছে, তারা অপেক্ষাকৃত সুখী ও আনন্দময় জীবনযাপন করেন। এ-ছাড়াও নিজেদের পাশাপাশি অন্য আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে বজায় থাকে তাদের সম্পর্কের উষ্ণতা।

পারিবারিক একাত্মতা দেয় সুখী জীবন : বিশ্বজুড়ে আধুনিক ধারার সমাজবিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য-গবেষকদের সাম্প্রতিক গবেষণার ভিত্তিতে এটা আজ এক প্রমাণিত সত্য যে, পারিবারিক ও সামাজিক একাত্মতা একজন মানুষকে সুস্থ সুখী সফল জীবনের পথে চালিত করে। তাই আমাদেরও উচিত এ যূথবদ্ধ জীবনযাপনের প্রতিটি সুযোগকেই কাজে লাগানো এবং প্রয়োজন আমাদের উত্তরপ্রজন্মকেও সাধ্যমতো এমন জীবনধারায় অভ্যস্ত করে তোলা।

যে কোনো বিষয়ে পারিবারিক আলোচনা, পরিবারের সবাই অন্তত একবেলা একসঙ্গে খাওয়া ইত্যাদি আচরণ-অভ্যাসের পাশাপাশি সঙ্ঘবদ্ধভাবে নৈতিকতার চর্চায়ও মনোযোগী হওয়া উচিত। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোরআন আলোচনা, ভাল কাজ করার প্রেরণা, বিনয়ের সঙ্গে ব্যবহার, সবার কল্যাণ কামনা ইত্যাদির চর্চা প্রতি সপ্তাহে করা উচিত।

পরিবারগুলোতে একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, সন্তান মা-বাবার কথা শোনে না। অনেকে এ-ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ করে বসেন। আসলে জীবনের কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে শক্তি প্রয়োগের বদলে কৌশল প্রয়োগ করাটাই সঙ্গত। ওখানে শক্তি প্রয়োগ করতে যাওয়াটাই ভুল। কারণ শক্তি প্রয়োগ করে এখনকার ছেলেমেয়েদের ভুল চিন্তা বা কর্মকাণ্ডকে থামানো যায় না। এর মোকাবেলা করতে হবে বুদ্ধি প্রয়োগ করে। এ জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় :
প্রথমত, সন্তান আপনার কথা শুনতে চায় না, কিন্তু কেন বন্ধুবান্ধবের কথা শোনে? কারণ সে মনে করছে, বন্ধুরা তার ব্যাপারে বেশি মনোযোগী। অথচ বাস্তবে তার ব্যাপারে মা-বাবার মনোযোগ যে অনেক বেশি, এটা সে বোঝে না। বুঝতে চায় না। এ জন্য সন্তানের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে হবে। সন্তানকে কথা শোনাতে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, আরেকটা কারণে সন্তান কথা শুনতে চায় না, সেটা হলো বাবা-মা-অভিভাবকদের কথাগুলো সে একইভাবে বহুবার শুনেছে। তাই তাকে বোঝাতে হবে একটু অন্যভাবে। পাশে বসিয়ে মমতা দিয়ে।
তৃতীয়ত, সব কাপড় কিন্তু সজোরে মাটিতে আছাড় দিয়ে ধোলাই করা যায় না, কিছু কাপড় খুব আস্তে আস্তে ঘষে পরিষ্কার করতে হয়। সন্তানও তেমনি। এজন্যে আগে তার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তখনই সন্তান আপনার কথায় প্রভাবিত হবে, সে আপনাকে ভালবাসতে শুরু করবে।

এই সুসম্পর্ক গড়ে তোলার একটি শক্ত ভিত্তি হতে পারে পরিবারে সালাম বিনিময়। সব ভালো কথারই শুভ প্রভাব আছে। প্রতিদিন হাসিমুখে এই নিরবচ্ছিন্ন কল্যাণ কামনার মধ্য দিয়ে আমাদের পরিবারগুলোতে সূচিত হতে পারে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।

আমাদের শান্তির উৎস আমাদেরই পরিবার। তাই পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে যেন কোনোভাবে গুরুত্বহীন মনে না করি। পরিবারে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, কিন্তু পারস্পরিক বোঝাপড়াটা যদি অক্ষুন্ন থাকে তবে কোনো চ্যালেঞ্জ বা প্রতিকূলতা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে না।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমনের খবর এর পথচলা ও সাফল্য গাঁথা
Next articleঘুমের বিশেষ কিছু সমস্যা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here