নিঃসঙ্গতা, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তিনটি বিষয়ই পরস্পর অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করলে নিঃসঙ্গতা বা একাকী বোধ করার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। যার ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চাপ পরে বা মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
নতুন এক গবেষণার ফলাফল অনুসারে, সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন- ফেইসবুক, টুইটার ইত্যাদিতে বেশি সময় কাটালে নিঃসঙ্গ বোধ করার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। আর এই নিঃসঙ্গতা থেকেই মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য বাড়তে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যত বেশি সময় কাটায় ততবেশি তাদের মধ্যে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন বোধ করার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। এখান থেকেই সৃষ্টি হয় নিঃসঙ্গতা। আর নিঃসঙ্গতা থেকে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। এর ফলে সামাজিক ও ব্যক্তিগত ভাবে তরুণ সমাজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
গবেষণার প্রধান গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গের ব্রায়ান প্রাইম্যাক বলেন, সহজাতভাবেই মানুষ সামাজিক জীব, তবে আধুনিক জীবনযাত্রা আমাদের একত্রিত করার পরিবর্তে আলাদা করে ফেলছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমাজের এই শূন্যতা পূরণ করতে পারে। তবে গবেষণা মতে, এই সমাধান হয়ত মানবজাতির কাম্য ছিল না।
আমেরিকান জার্নাল অফ প্রিভেন্টিভ মেডিসিন নামক জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় আরও বলা হয়, অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কের পূর্ণতা আনতে একজন মানুষ যখন সামাজিক একাত্মতা ও বাস্তব বন্ধনের অভাব বোধ করে তখন ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সামাজিকভাবে একঘরে অনুভূতির মহাওষুধ হতে পারে না। এই সামাজিক যোগাযোগ মানুষকে নিঃসঙ্গ করতে সাহায্য করছে। আর এই নিঃসঙ্গতাই এক সময় মানুষকে মানসিক রোগী করতে সাহায্য করবে।
গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯ থেকে ৩২ বছর বয়সি দেড় হাজার মার্কিন নাগরিকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নিয়ে প্রকাশিত অনুভূতি গবেষকরা পর্যালোচনা করেন। তাদের ব্যবহৃত মাধ্যমগুলো ছিল ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটার, গুগল প্লাস, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, রেডিট, টাম্বলার, পিন্টারেস্ট, ভাইন ও লিঙ্কডইন।
পেশেন্ট-রিপোর্টেড আউটকামস মেজারমেন্ট সিস্টেম নামক বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে অংশগ্রহণকারীদের একাকিত্বের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।
দেখা যায়, যারা প্রতিদিন দুই ঘণ্টার বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করেন তাদের একাকিত্বের পরিমাণ, যারা দিনে আধা ঘণ্টা ব্যবহার করেছেন তাদের তুলনায় দ্বিগুন।
আবার যারা বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম সপ্তাহে ৫৮ বার বা আরও বেশি ব্যবহার করেছেন তাদের একাকিত্বের পরিমাণ, যারা আরও কম বার মাধ্যমগুলো ব্যবহার করেছেন তাদের তুলনায় প্রায় তিনগুন।
গবেষকদের বিশ্বাস, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার প্রকৃত সামাজিকতা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। কারণ, অনলাইনে যত বেশি সময় ব্যয় করা হবে, বাস্তবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ততই কমতে থাকবে। এভাবে যোগাযোগ কমতে কমতে একটা সময় দেখা যায় মানুষ একে বারে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়।
এছাড়াও সোশাল মিডিয়ার কিছু বিষয় মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, কেউ যখন সোশাল মিডিয়ায় দেখবে তার বন্ধুরা কোথাও গিয়ে আনন্দ করছে কিন্তু তাকে আমন্ত্রণ জানায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণত সবাই নিজেদের সাফল্য ও অর্জনগুলো প্রকাশ করে।
তাই গবেষকরা বলেন, এই মাধ্যমগুলোতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করার ফলে অপরের প্রতি ঈর্ষা জন্মাতে পারে। এবং বিকৃতভাবে বিশ্বাস করতে পারে যে- অন্যরা খুব সুখী এবং সফল জীবনযাপন করছে, যা আমার নেই।
এভাবেই মানুষ অন্যদের থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে জীবন যাপন করতে অভ্যাস করবে। আর এই অভ্যাসই মানুষকে এক সময় নিঃসঙ্গ ভাবতে থাকবে। আর এই নিঃসঙ্গতা থেকেই মানুষ মানসিক রোগীতে পরিণত হবে। তাই আমাদের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম পরিবর্তন করে স্বশরীরে যোগযোগ করার অভ্যাস বাড়াতে হবে।