দুই সন্তানের জননী জিনিয়া সরকারের মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকে। দুই মেয়ে আর স্বামী নিয়ে চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের জিনিয়ার সংসার। বড় মেয়েটি জন্মান্ধ। আর এই বড় মেয়েকে নিয়েই তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় দিনের প্রায় পুরোটা সময়।
প্রথম দিকে স্বামী ভেবেছিলেন, সারাক্ষণ মেয়েদের পেছনে খাটতে হয় বলেই হয়তো জিনিয়ার মেজাজ সবসময় এমন খিটখিটে থাকে। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর তার ভুল ভাঙল। কারণ সমস্যাটি বেড়েই চলছিল। স্বামী বুঝতে পারলেন এই সমস্যার সমাধান না করলে আরো বেশি খারাপের দিকে যাবে। তাই একদিন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে।
সুন্দরী তরুণী রাহেলা গত বছরের মার্চে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন। পাড়ার এক বখাটে দীর্ঘদিন ধরে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। কিন্তু রাহেলা সাড়া না দেয়ায় একদিন দিন-দুপুরেই তার দিকে এসিড ছুড়ে মারে। দীর্ঘদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নেয়ার পর রাহেলা বাড়ি ফিরে যান। এখন তিনি কিছুটা সুস্থ হলেও সারাক্ষণ বিষণœ থাকেন। কারো সঙ্গেই তেমন একটা কথা বলেন না। জিনিয়া এবং রাহেলার মতো এমন লাখো নারী রয়েছেন যারা ভুগছেন বিষণœতায়। ভুগছেন মানসিক সমস্যায়। কিন্তু এসব নারীর শতকরা ৯৯ শতাংশই কখনো মনোবিজ্ঞানীর দ্বারস্থ হননি। মূলত অসচেতনতা এবং অজ্ঞতাই এর মূল কারণ। অধিকাংশ নারী বুঝেনই না যে, তারা বিষণ্ণতায় ভুগছেন।
আর এসব নারীর কথা ভেবেই এক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় উইমেন ইনোভেশন ক্যাম্পের মাধ্যমে চালু করছে ‘নারীর মানসিক স্বাস্থ্য’বিষয়ক একটি সেবামূলক ওয়েবসাইট। খবর বাসস।
জানা গেছে, এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নারীরা তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সব তথ্য বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জানতে পারবেন। নারীরা বিশেষ করে সন্তান প্রসবের পর এক ধরনের প্রসবজনিত বিষণ্ণতায় ভোগেন। এই বিষণ্ণতা থেকে উত্তরণের উপায় পাবেন এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। এ ছাড়াও বাচ্চা কীভাবে লালন-পালন করতে হবে, এমন তথ্যও থাকবে এখানে। এই ওয়েবসাইটের মূল পরিকল্পনাকারী হলেন মনিরা হোসেন, যিনি নিজে একজন এসিড সন্ত্রাসের শিকার।
মনিরা বলেন, আমি নিজে একজন ভুক্তভোগী। আমি বুঝি একজন এসিডদগ্ধ নারী কেমন মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যান। মূলত সেখান থেকেই নারীদের জন্য কিছু করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করি। আর গত বছর উইমেন ইনোভেশন ক্যাম্পে আমার এ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরি এবং ২০১৭ সালের ৪ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে আমার এ পরিকল্পনাটিকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এমনকি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমাকে দেয়া হয়েছে ১৯ লাখ টাকা।
মনিরা বলেন, নারীরা পরিবার এবং সমাজে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এর ফলে তারা দিন দিন মানসিক রোগে ভুগছেন, যা পরবর্তীতে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আমরা এ ধরনের নারীদের জন্য কী কী করণীয় এবং কোথায় এর সমাধান পাওয়া যাবে এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সেসব বিষয় জানাব। এ ছাড়াও এখানে একটি হটলাইন থাকবে যার মাধ্যমে নারীরা চাইলে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার জন্য কাউন্সিলিং নিতে পারবেন বলে জানান মনিরা। তিনি বলেন, এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সেবাগ্রহণকারীরা সরকারের আরো যেসব স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে সেসব সম্পর্কেও জানতে পারবেন। সরকারের স্বাস্থ্যসেবা তথ্য এই ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকবে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, মানসিক সমস্যাকে আমরা অনেকেই পাগলামি বলে থাকি। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মানসিক বিষণ্ণতার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়াকে অনেকেই পাগলামি ভাবেন। আবার অনেকে মনে করেন এটা বিলাসিতা। অধিকাংশই আবার এ বিষয়ে সচেতন নন। কিন্তু দীর্ঘদিন যদি একজন ব্যক্তি মানসিক বিষণ্ণতায় ভোগেন তবে তা আরো খারাপের দিকেই যায়।
তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোর দিকে নজর দিলে আমরা দেখি সেখানে শিশু হতে একেবারে বৃদ্ধ সবাই মাসে একবার অথবা ছয় মাসে অন্তত একবার ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। আবার কেউ কেউ শুধু মাসে একবার যান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। এই মানসিক রোগ যে কোনো কারণে হতে পারে। পারিবারিক অশান্তি, অফিসে ঝামেলা, বাচ্চা সামলাতে না পারা আরো বিভিন্নভাবে একজন নারী বিষণ্ণতায় ভুগতে পারেন। কিন্তু এর প্রতিরোধের জন্য দরকার সঠিক সময়ে, সঠিক পরামর্শ এবং চিকিৎসা।
নারীদের জন্য সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, এই সেবা যাতে প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় সে জন্য সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে।