নারীর ক্ষমতায়ন ও মানসিক স্বাস্থ্য

১৮৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমসময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নের দাবিতে আন্দোলনকে স্মরণ করে ১৯১০ সালে সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেৎকিনের প্রস্তাবে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে পালিত হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে উদযাপন করে। তারপর থেকে ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। এই দিবস পালনকে উপলক্ষ্য করে দেশে দেশে নারী আন্দোলন কর্মীরা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তাদের সকল কর্মতৎপরতা ও শক্তিকে সংহত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে গ্লোবাল সামিটে এসডিজি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন কর্মসূচির স্লোগান উঠেছে ‘কাউকে পিছনে ফেলে নয়, সকলকে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে’- তা সে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো লিঙ্গ, প্রচ্ছদ প্রতিবেদনগোত্র, রাজনৈতিক মতাদর্শ, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত অবস্থান ও পিছিয়ে পড়া যেকোনো জনগোষ্ঠীর মানুষই হোক না কেন। সেই লক্ষ্যে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে নানাবিধ উদ্যোগ শুরু হয়েছে। নারী আন্দোলনও যার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

ঐতিহাসিকভাবেই নারীরা সবদিক দিয়েই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অন্যতম অংশ। এখন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য, অমর্যাদা, অন্যায্যতা ও অবিচারের শিকার নারী। আমরা জানি দীর্ঘ বৈশ্বিক-জাতীয় নারী আন্দোলন, বিশিষ্ট নারীবাদী, চিন্তক, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক (বেগম রোকেয়া, সিমন দ্য বুভোয়ার, মেরি ওলস্টন ক্রাফট, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ)-এর দর্শন, ভাবনা এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন অভিজ্ঞতায় এটাই সত্যি বলে প্রতীয়মান হয়েছে- বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে পিছনে না রেখে, নারী-পুরষের বৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া সার্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সামগ্রিকভাবে মানবজাতির উন্নয়ন সম্ভব না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদ ও কর্মসূচিতে তার প্রতিফলন ঘটেছে (জাতিসংঘ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যমূলক সনদ-১৯৭৯, ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলন-১৯৯২, কায়রো জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন ঘোষণা-১৯৯৪, চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন বেইজিং -১৯৯৫)। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মতো স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও নারী নানাবিধ বৈষম্যের শিকার। স্বাস্থ্য হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক মঙ্গলময় অবস্থা; শুধুমাত্র রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি না। সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রায় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উপভোগের অধিকার নারীর মানবাধিকার। নারী স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত রয়েছে তাদের আবেগজনিত, সামাজিক ও শারীরিক কল্যাণ। ‘সিডও’ তে বলা হয়েছে কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই নারীর স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, রক্ষা এবং নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ‘কায়রো ঘোষণা’য় নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে যা কিনা নারীর ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন ও নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য। ‘বেইজিং ঘোষণা ও কর্ম পরিকল্পনা’য় বলা হয়েছে জীবনব্যাপী নারীর যথাযথ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও তথ্য প্রাপ্তি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং সেরা স্বাস্থ্য অর্জন করার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত হলো সমতা যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পারিবারিক দায়িত্বের সমবন্টন, উন্নয়ন ও শান্তি। বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় নারী উনড়বয়ন নীতি ও স্বাস্থ্য কর্মসূচিতেও নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব এবং উদ্বেগের সঙ্গে চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলো নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা। কেননা নারীর প্রতি বৈষম্যের অন্যতম কারণ নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা। আবার সহিংসতার কারণে নারী ও কন্যারা নানান ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। বিশ্ব নারী আন্দোলন নারীর প্রতি সহিংসতাকে নারীপুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত ‘ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে’ ঘোষিত হয় ‘নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারীর অধিকার মানবাধিকার’। ভিয়েনা সম্মেলন নারীর প্রতিপ্রকাশ্য জনজীবনে ও ব্যক্তিজীবনে সকল প্রকার নিষ্ঠুর সহিংস আচরণ বন্ধ করার দাবি জানায়। এই ঘোষণামতে- নারী নির্যাতন বলতে বোঝাবে সেই ধরনের জেন্ডারভিত্তিক সহিংস আচরণ যা নারীর শারীরিক-মানসিক দুঃখ-কষ্টের কারণ হবে এবং যা কোনো নারীর ব্যক্তিগত ও বাইরের জীবনে নিষ্ঠুরনির্যাতনমূলকভাবে কোনো নারীর স্বাধীনতায় আঘাত ও বাধার সৃষ্টি করবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত (১৯৯২) নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ সিডও সংক্রন্ত ১৯ নম্বর সাধারণ সুপারিশে বলা হয়েছে- নারীর প্রতি বৈষম্য, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ২০১৭ এর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘কেউ রবে না পিছে, নারী ও কন্যার নির্যাতন মুক্ত জীবন চাই’। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রার ৫ নং লক্ষ্য (SDG Goal-5) জেন্ডার সমতা অর্জন ও নারী ও কন্যা শিশুর ক্ষমতায়ন।
নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের ক্ষমতার সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতা। নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি, বৈষম্য, সম্পদ সম্পত্তিতে অধিকারহীনতা, ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাধা সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতাকে টিকিয়ে রেখেছে।

নারীর প্রতি সহিংসতার ধরনগুলোর মধ্যে আছে পারিবারিক সহিংসতা, যৌন সহিংসতা, (ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, শ্লীলতাহানি, যৌন নির্যাতন, বৈবাহিক সম্পর্কজনিত ধর্ষণ) উত্যক্তকরণ, বিচারবহির্ভূত সালিশের নামে সামাজিক নির্যাতন, ক্ষতিকর চর্চাসমূহ (বাল্য বিবাহ, যৌতুক), আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা ও মানসিক নির্যাতন (সঙ্গী, পরিবার, সমাজ, কর্মস্থল)। বিবিএস-এর ২০১৫ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী-৮৭ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। তার মধ্যে ৭২.৬ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। তাছাড়াও বিবাহিত নারীরা যৌন সহিংসতা, মানসিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক নির্যাতন, আচরণ নিয়ন্ত্রণের শিকার হয়ে থাকে। নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্বিত হয়, জীবনব্যাপী শঙ্কামুক্ত থেকে তার জীবনযাপনের অধিকার লঙ্ঘিত হয়, মর্যাদাহানি হয়, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়, মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে তার জীবনযাপন করতে হয়। এই সবই তার উন্নয়ন, ক্ষমতায়নের পথকে বাধাগ্রস্ত করে ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।

পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং সহিংসতা নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দৈহিক নির্যাতন কখনো কখনো দৃশ্যমান হলেও, মানসিক নির্যাতন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুল্লেখিত থেকে যায়। শিশু-কিশোরী থেকে শুরু করে সকল বয়সের ধর্ষণের শিকার নারী, পথে-ঘাটে, যৌন হয়রানি ও উত্যক্তকরণের শিকার শিশু-কিশোরী, পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতার শিকার নারী, বিভিন্ন সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে আক্রান্ত নারী ও কন্যার মানসিক আঘাত, পরিবারে নারী ও কন্যার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, গৃহস্থালির কাজের চাপ, বিশ্রাম ও বিনোদনের অভাব, কর্মজীবী নারীদের গৃহস্থালি ও পেশাগত কাজের সমন্বয়ে মানসিক চাপ, নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও বৈবাহিক জীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধিকারহীনতা, সম্পদের উপর অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা-এই সবই নারীর মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বয়ঃসন্ধিকালীন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা এবং তথ্যের অভাব, বাল্যবিবাহের কারণে বয়ঃপ্রাপ্তির আগেই যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা, যৌন নির্যাতন, হিংস্রতা, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, অনিরাপদ গর্ভপাত, নিজের শরীর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগতার কারণে তারা শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক উভয় দিক দিয়েই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে যা কিনা তার শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অধিকারকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করে এবং তাদের জীবন মানের উপর দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে।

এই প্রেক্ষাপটে নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন একটি সমতাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জীবনচরে সকল পর্যায়ে নারীর স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মানব উন্নয়নের অন্যতম সূচক নারী-স্বাস্থ্য বিশেষত নারীর মানসিক স্বাস্থ্যকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকলকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। একদিকে একটি নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, সকল পর্যায়ের নীতি নির্ধারক ও বাস্তবায়নকারীদের জেন্ডার লেন্স ব্যবহার করতে হবে। নারীর প্রতি সকল ক্ষেত্রে সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষা কারিকুলামে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ বহুমাত্রিক কার্যক্রমে সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যার মানসিক আঘাত নিরসনে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে বিশেষত কিশোরী, বয়ঃসন্ধিকালীন, বয়স্ক নারীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কিশোর-কিশোরীদের কর্মস্থলে কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

এসবই একটি সুস্থ, শান্তিপূর্ণ, সুখী, নিরাপদ সমাজ গঠনে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

লিখেছেন

মালেকা বানু
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleনারীর মানসিক স্বাস্থ্য ও সচেতনতা
Next articleকর্মক্ষেত্রে নারীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কতোদূর?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here