মাহজাবীন আরা
সাইকোলজিস্ট
মাঝেমধ্যে ছোটোখাটো বিষয় ভুলে যাওয়া সব বয়সের মানুষের জন্যই স্বাভাবিক। আমাদের প্রায় সবার সঙ্গেই কোনো কোনো দিন এমনটা ঘটে যে, হয়ত জরুরি কোনো জিনিস কোথায় রেখেছি মনে করতে পারি না, আবার কখনো কারো সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হলে সহসা নাম মনে করতে পারি না। এর কারণ হয়ত আমাদের মন সেদিন অন্য কোনোকিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে; ফলে, ছোটো ছোটো বিষয়গুলো মনে রাখতে পারে না। তবে এটি যদি মারাত্মক আকার ধারণ করে তখনই সমস্যা দেখা দেয়।
ডিমেনশিয়া হলো মস্তিস্কের একটি রোগ। এর স্বাভাবিক ও সাধারণ একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়া বা ভুলে যাওয়া। ডিমেনশিয়া রোগে ব্যক্তির স্মরণশক্তি, চিন্তাশক্তি, আচরণ এবং অনুভূতি আক্রান্ত হয়। এই রোগ হলে মানুষ ধীরে ধীরে তাঁর স্মৃতিশক্তি হারাতে থাকেন। ভুলতে থাকেন সব কিছুই। সাধারণত ৬০ বছরের ওপরে বয়সের মানুষের ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তবে কমবয়সীরা যে ঝুঁকিমুক্ত তা নয়। যেকোনো বয়সেই এটা হতে পারে। এই রোগে আরো যেসব উপসর্গ আছে তার মধ্যে রয়েছে আচরণের পরিবর্তন, মেজাজ ও ব্যক্তিত্ব, পরিচিত জায়গাতেও হারিয়ে যাওয়া অথবা কথা গুছিয়ে বলতে না পারা; অর্থাৎ কারো সঙ্গে কথা বলার সময় কোন শব্দের পর কোন শব্দ ব্যবহার করবেন কিংবা একটা বাক্যের পর পরের বাক্যে কী বলবেন সেসব তারা মেলাতে পারেন না। এটা এমন এক পর্যায়ে গিয়েও পৌঁছাতে পারে যে রোগী খেয়েছেন কিনা সেটাও তিনি মনে করতে পারেন না, কারো নাম বা চেহারা এমনকি কিছুক্ষণ আগে কি করেছেন এসব তারা সহজেই ভুলে যান। ক্রমাগত রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সমস্যাগুলো আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয় এবং রোগীকে সংকীর্ণ গন্ডিতে আবদ্ধ করে। ফলে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন দুর্বিসহ হতে থাকে।
এই রোগ চিকিৎসায় বা প্রতিরোধে এখনও কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। রোগীকে সময় দেয়া, যথাযথ সম্মান করা, সেবা করা সর্বোপরি প্রত্যহিক জীবনের মান বাড়ানোর মাধ্যমে এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির হার কমানো যায়। তাই ডিমেনশিয়া রোগীদের প্রতিদিনের পরিচর্যায় নিচের বিষয়গুলি খেয়াল রাখা জরুরি-
- রোগীকে একটি নোটবুক বা ক্যালেন্ডারে প্রতিদিনের করণীয় তালিকা বা কাজগুলি লিখতে সাহায্য করুন অথবা নিজে লিখে দিন।
- একটি রুটিন রাখার চেষ্টা করুন, যেমন প্রতিদিন একই সময়ে গোসল করা, পোশাক পরা এবং খাওয়া ইত্যাদি।
- ব্যক্তিটি উপভোগ করে এমন কার্যকলাপের পরিকল্পনা করুন এবং প্রতিদিন একই সময়ে তাকে নিয়ে সেগুলি করার চেষ্টা করুন।
- রোগীর খাওয়ার অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। চিনি খেতে হলেও খুব অল্প খেতে হবে। খাদ্য তালিকায় বেশি করে তাজা শাকসবজি, ফলমূল ও পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে।সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার কমাতে হবে। মাছের তেল মস্তিস্কের জন্য বেশ উপকারী।
- নিয়মিত ব্যায়াম ডিমেনশিয়া রোগের আশঙ্কা কমাতে পারে এবং যাদের ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে এর গতিও শ্লথ করতে পারে। তাই নিয়মিত ব্যায়াম করতে সাহায্য করুন; অন্ততপক্ষে, প্রতিদিন কিছু সময় হলেও একসাথে হাঁটুন।
- শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা খেয়াল রাখুন। ওজন নিয়ন্ত্রণে ভালো খাবার এবং ব্যায়ামের ভূমিকা রয়েছে।
- উচ্চ রক্তচাপ এবং ডিমেনশিয়ার সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে। তাই রোগীর উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে সতর্ক থাকুন এবং নিয়মিত পরীক্ষা করুন।
- ডায়াবেটিস থাকলে সঠিক চিকিৎসা করুন। কারণ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- ব্যক্তির রক্তের কোলেস্টরেলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডিমেনশিয়ার জন্য এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।
- রোগীকে শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখুন। সক্রিয় থাকার জন্য তিনি যাতে করতে পারেন এমন কিছু ছোটো ছোটো কাজে তাকে অংশগ্রহণ করানো যেতে পারে।
- প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত ঘুম মস্তিষ্কের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। রোগীকে নিয়মিত ঘুমের সময়সূচি ঠিক করে দিন এবং মেনে চলতে সহযোগিতা করুন; অর্থাৎ একই সময় উঠা, একই সময় ঘুমানো। কারণ, নিয়মিত সব কিছুতে সাড়া দেয় মগজ।
- ধূমপান, মদ্যপান কিংবা যেকোনো তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করতে তাকে উৎসাহিত করুন।
- উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার মতো মানসিক সমস্যা থেকে দূরে রাখতে তাকে পর্যাপ্ত সময় দিন, তার সাথে কোয়ালিটি সময় কাটান; অর্থাৎ ব্যক্তির মনকে ব্যস্ত এবং সক্রিয় রাখুন। আর যদি পূর্বেই কোনো মানসিক সমস্যা থেকে থাকে তবে সঠিক চিকিৎসা করুন।
অনেকের ধারণা, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ভুলে যাবেন। এটিকে আমরা অনেকেই খুব স্বাভাবিকভাবে নেই এবং ডিমেনশিয়া যে একটি রোগ, এ বিষয়ে সচেতন থাকি না। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পরও একজন মানুষ দীর্ঘদিন ভালোভাবেই বেঁচে থাকতে পারেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে ব্যস্ত থাকলে এই রোগের ক্রমাবনতির হার কমে আসে এবং বিষণ্ণতা, হীনম্মন্যতা ইত্যাদি বিষয় থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে সামলে নেয়ার শক্তি খুঁজে পায়।