ছবি আঁকা আমার কাছে নেশা-রনবী

0
166

ছবি আঁকা আমার কাছে নেশার মতোই ছিল রনবী তাঁর সম্পর্কে কোনো বিশেষণই যথেষ্ট নয়। রং-তুলির জগতে কিংবদন্তি তিনি। চিত্রিত ছবির ভেতর দিয়ে তিনি সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে গেছেন বিরামহীন। তিনি খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী। সকলের কাছে যিনি রনবী নামেই বেশি পরিচিত। মনের খবর’র সাথে কথা বলেছেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি।

মনের খবর: আপনার ছবি আঁকার শুরুর দিকের গল্পটা যদি একটু বলতেন
রনবী: আর সব বাচ্চারা যেরকম থাকে-কেউ গান গাইতে চায়, কেউ নাচতে চায়, কেউ ছবি আঁকতে চায়, কেউ শুধুই লেখাপড়া করতে চায়, কেউ শুধু অংক মজা পায় বলে অংক করতে চায়। সেরকমই আমারো ছেলেবলা থেকে ছবি আঁকতেই ইচ্ছে হয়েছিল। আমার বাবা ছবি আঁকতেন আমি সেটা দেখতাম। ছবি আঁকা দেখতে ভালো লাগত, কেন ভালো লাগত জানি না, এখনো জানি না ছবি আঁকতে কেন ভালো লাগে। একেবারে শৈশবে চক দিয়ে স্লেটে ছবি আঁকতাম, তারপর স্কুলের রাফ খাতায় আঁকতাম-এভাবেই শুরু হয়েছিল। এরপর আস্তে আস্তে পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়তে লাগলে যে, এই ছেলেটার আঁকার হাত ভালো। তখন থেকেই পাড়া-মহল্লার লোক আমাকে দেয়াল পত্রিকা থেকে শুরু করে নানান কাজে ছবি আঁকার জন্য ব্যস্ত রাখত। এভাবেই আস্তে আস্তে ছবি আঁকার সাথে মনেপ্রাণে মিশে গেলাম। তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চারুকলায় পড়ব। সেই মোতাবেক ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হই। তারপর থেকে তো চলছে ছবির সাথেই। প্রাথমকি পর্যায়ে বলা যায় যে, এটাতে এক ধরনের মোহ কাজ করত। আর্ট কলেজে যখন ভর্তি হই তখন চোখ আরো খুলে গেল, চারদিক যখন দেখতে শুরু করলাম তখন কী আঁকব, কেন আঁকব, কার জন্য আঁকব এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। সেই ভাবনার মধ্যেই এখনো প্রতিনিয়ত বসত করছি।

মনের খবর: ছবি এবং মন একে অপরের সাথে কীভাবে জড়িত?
রনবী: প্রতিটা ছবির সাথে মনের একটি ব্যাপার জড়িত থাকে, চিন্তার সাথে, ভাবনার সাথে একটা ব্যাপার জড়িত থাকে। আমরা বাস্তব জীবনে আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটতে দেখছি সেগুলো থেকেই ভাবনা নিয়ে কাজের মধ্যে ফুটিয়ে তুলি। তার মধ্যে কিছুটা আধুনিকতা, কিছুটা সংস্কার, কিছুটা ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ থাকে।

মনের খবর: আপনার খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠার পেছনে নিজের কোন কোন গুণগুলো কাজ করেছে বলে মনে করেন?
রনবী: আমি ঠিক জানি না। খ্যাতির জন্য কখনো কাজ করিনি। এক নাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছি, সেটাই আমার আসল উদ্দেশ্য। একজন শিল্পী নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য ছবি আঁকেন। প্রতিটি ছবি আঁকার জন্য বা সেই ছবিটি সম্পন্ন করার জন্য প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি নিজের মধ্যে কাজ করে, একটা জেদ কাজ করে। আমার ভেতরও সেইরকমই ইচ্ছাশক্তি এবং জেদ কাজ করত।

মনের খবর: এত বছর ধরে ছবি আঁকছেন, কখনো কি একঘেয়ে লেগেছে বা বিরক্তি বোধ করেছেন?
রনবী: না, সেরকমটি হলে তো এতদিন ধরে আঁকতে পারতাম না। আসলে এই কাজটি এমনিই যে আমার প্রতিটি ক্যানভাসেই নতুন উদ্দীপনা, নতুন প্রেম, নতুন নতুন ভাবনা, নতুন নতুন চিন্তা যুক্ত থাকে। এই নতুনত্বের কারণেই হয়ত একঘেয়েমিটা কখনো আসেনি। আর এই কাজটা মূলত অসীম একটি ব্যাপার, এর শেষ নেই। একটা ছবি শেষ হওয়ার পর আরেকটা ছবির জন্য নতুন করে ইচ্ছাশক্তি এবং জেদ সঞ্চার হয়। তবে বিরক্তি আসে তখন যখন এমন হয় যে, আমি ছবির মধ্যে যে জিনিসটি ফুটিয়ে তুলতে চাচ্ছি সেটি ঠিকমতো আসছে না, যে রংগুলো ফুটিয়ে তুলতে চাইছি সেটি ঠিকমতো অসছে না।

মনের খবর: এই ধরনের বিরক্তির সময়ে কি কখনো মানসিক চাপ অনুভব করেন?
রনবী: এটাই তো একধরনের মানসিক চাপ যে, আমি যেটা চাচ্ছি সেটা হচ্ছে না। সেটি না হওয়া পর্যন্ত এই মানসিক চাপটা প্রচন্ড পরিমাণে থাকে। একজন শিল্পীর মধ্যে নিখুঁত হওয়ার একটা প্রবণতা কাজ করে। শতভাগ না হলেও সে চেষ্টা করে সর্বোচ্চ নিখুঁত করার, এটি একজন শিল্পীর জন্য এক ধরনের মানসিক চাপ।

মনের খবর: এই যে এতদিন ধরে রং তুলির সাথে আছেন, নিজের কাছে কি এটাকে কখনো নেশা বা আসক্তি মনে হয়েছে?
রনবী: আসক্তি শব্দটি আমার কাছে শুনতে খারাপ লাগে। ছবি আঁকা ছাড়া আর কোনো কিছু কখনো ভাবিনি, একসময় এটি আমার কাছে নেশার মতোই ছিল, যখন এটাকে পেশা হিসেবে নিলাম তখন নেশার সাথে পেশা যুক্ত হয়ে এটা আরো বেগবান হল। আর এটাকে যদি আসক্তি বলেন তাহলে বলব সব আসক্তি বা নেশাই খারাপ নয়।

মনের খবর: নিজের আঁকা ছবি আপনার মনের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলে এবং অন্যদের মনকে এটা কীভাবে প্রভাবিত করে বলে মনে করেন?
রনবী: অন্যের মনের খবর তো আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। আমি যখন দর্শক হিসেবে অন্যদের ছবি দেখি তখন একজন সাধারণ দর্শকের চোখেই দেখার চেষ্টা করি। যখন কারো ভালো কাজ দেখি, তখন নিজের মধ্যে ভালো লাগা কাজ করে। আমার মনে হয় এরকমটি সকল শিল্পীর মধ্যেই কাজ করে। শুধু নিজের কাজের প্রশংসায় ভাসলেই বড়ো হওয়া যাবে না। প্রশংসা অন্যের জন্যও করতে হবে।

মনের খবর: আমাদের চোখে আপনার সাফল্য অনেক, আপনার কোনো অপূর্ণতা কি নিজের ভেতরে কাজ করে?
রনবী: তা তো করেই। ওই যে বললাম, এটি একটি অসীম প্রক্রিয়া-যা কিছু করছি সেটিই চূড়ান্ত না। চূড়ান্ত যে কোথায় সেটাই জানি না, এটি একটি অপূর্ণতা।

মনের খবর: রাগ, ক্ষোভ, অভিমান এই ব্যাপারগুলো কী আপনার ভেতরে কাজ করে?
রনবী: মানুষ মাত্রই তার মধ্যে রাগ, ক্ষোভ, অভিমান থাকে। কখনো নিজের ওপর ক্ষোভ জন্মাতে পারে, কখনো অন্যের ওপর ক্ষোভ জন্মাতে পারে। সেইসঙ্গে মন খারাপও হতে পারে। তবে সেগুলো থেকে উত্তরণের একটি উপায় থাকতে হয়। তবে অন্য কেউ ভুল করলে খুব রাগ হয়, কিন্তু সেটা হয়ত প্রকাশ করি না, নিজের মধ্যেই ক্ষোভটা কাজ করে যে-কেন এমন করল?

মনের খবর: এই উত্তরণের উপায়গুলো কী এবং মন খারাপ হলে মন ভালো করার জন্য কী করেন?
রনবী: অন্যদের থেকে শিল্পীদের হিসেব একটু আলাদা। আমাদেরকে সবসময় কাজের বিষয়বস্তুর মধ্যে থাকতে হয়। নতুন নতুন ভাবনার মধ্যে থাকতে হয়, এইসব ভাবনার মধ্যে ডুবে যেতে পারলে রাগ, ক্ষোভ, অভিমান কিংবা মন খারাপ বোধটা কাজ করে না। এর বাইরে মন খারাপ হলে আমি গান শুনি অথবা বই পড়ি কিংবা কবিতা পড়ি। কিন্তু মন ভার করে বসে থাকি না।

মনের খবর: স্মৃতিকাতরতা ব্যাপারটি কি তাড়িত করে?
রনবী: এখন এমন একটি বয়সে অবস্থান করেছি যখন স্মৃতিকাতরতা আসলে খুব বেশি পরিমাণে কাজ করে। কাদেরকে দেখেছি, কাদের সাথে মিশেছি, কাদের সাথে কাজ করেছি এই ব্যাপারগুলো এই বয়সে এসে খুব বেশি মনে পড়ে।

মনের খবর: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
রনবী: মনের খবরকেও আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টিতে তারা যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে সেটি সত্যিই প্রশংসনীয়।

Previous articleনেতিবাচক চিন্তা দূরে রাখবেন যেভাবে
Next articleস্ট্রেসমুক্ত থাকতে কর্মজীবী নারীদের করণীয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here