সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ থেকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় এগিয়েছে বহুদূর। মানুষের জীবনযাত্রা হয়েছে সহজ। কিন্তু মানুষের ঘুমের হার যেন কমেছে মারাত্মকভাবে। যখন বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ ছিল, তখন মানুষ সময়মতো ঘুমিয়ে পড়তো। কিন্তু বর্তমানে তরুণদের কাছে রাতজাগা যেন ফ্যাশন।
কিন্তু এর ফলে নিজেদের যে ক্ষতি করছে, এটাই যেন তারা বুঝছে না। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে একজন মানুষ ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। এর ফলে সুন্দর জীবনও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
করোনার এই সময়ে মানুষের ঘুমের সমস্যা বেড়েছে আগের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ সার্জনস ফর স্লিপ আপনিয়া- এর জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু জানিয়েছেন, করোনা মহামারির এ সময়ে ৪৫-৫০ ভাগ মানুষের ঘুম নিয়ে সমস্যা হচ্ছে যা থেকে বিষন্নতাসহ নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
ডা. মনিলাল আইচ টিটু বলেন, ‘বর্তমানে ঘুমের মহামারি চলছে। আসলে করোনায় চাকরি হারিয়ে আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের। এছাড়াও বাচ্চা, বড় সবারই মোবাইল বা ডিভাইস ব্যবহার বেড়ে গেছে। পারিবারিক সহিংসতা নেশায় আসক্তও একটা সমস্যা।’
বাংলাদেশে বর্তমানে ঘুমের অনিয়ম বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ, এখনো ‘ঘুমের সংস্কৃতি’ তৈরি না হওয়া। ডা. মনিলাল আরও যোগ করেন, ‘আমাদের এখানে রাতের খাবার খাওয়ার ও ঘুমানোর নির্দিষ্ট সময়সূচি মানার অভ্যাস নেই। এটি ঘুমের সমস্যা তৈরি করে। এছাড়াও রাতে শুয়ে গেলেও মোবাইল টেপার বদভ্যাস বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে রাতে না ঘুমিয়ে বাইরে যাওয়াটা একটা ট্রেন্ড হিসেবে ভাবছে।’
কিন্তু নিয়মিত যথার্থ পরিমাণে না ঘুমালে শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিকভাবেও ক্ষতি হয়ে থাকে। ডা. শারমীন ইয়াসমীন বলেন, ‘আট ঘণ্টা না হোক, অন্তত ছয় ঘণ্টাও যদি কেউ নিয়মিত না ঘুমাতে পারে তাহলে সেটিই ঘুমের সমস্যা বা অনিয়মিত ঘুম। এ সমস্যা নিয়মিত হলে তা জীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কাজের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। কারণ এটি মনোযোগ নষ্ট করে, মানসিক চাপ বাড়ায়, মেজাজ খিটখিটে করে ফেলে, এমনকি রক্তচাপসহ নানা স্নায়ুজনিত সমস্যা তৈরি করে।’
পৃথিবীজুড়ে ১৫৩টি দেশের ৫০ লাখ মানুষের উপর একটা গবেষণা চালিয়ে দেখা যায়, কম ঘুমের কারণে মানুষের বোধশক্তি কমে যায়, স্বাভাবিকত্ব নষ্ট হয় এমনকি স্মৃতিভ্রমের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে পেশাজীবনেও সমস্যা হয়। এছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়, শরীরে টিকা দিলেও এর কার্যকারিতা কমে যায়। হ্রদযন্ত্র ও রক্তনালীর রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। কারণ নিয়মিত ঘুম না হলে রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ঠিকমতো হয় না। এছাড়াও ঘুমের সমস্যার ফলে সৃষ্ট মানসিক সমস্যার কারণে পারিবারিক সুখ-শান্তিও নষ্ট হতে পারে।
ডা. মনিলাল বলেন, ‘টানা তিন মাস ঘুমের সমস্যা হলে, প্যানিক (আতঙ্কিত হওয়া), ফোবিয়া (ভীতি) ও ফ্যানটম পেইন (অকারণ অস্বস্তি) তৈরি হয়। ফলে বিষণ্ণতা এবং উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায়।
তাই নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনের জন্য নিয়মিত যথার্থ ঘুমানো উচিত। আট ঘণ্টা না হলেও ছয় ঘণ্টা হলেও ঘুমানো উচিত। আর সেটি না পারলে তিন-চার ঘণ্টার জন্য হলেও গভীর ঘুম দেওয়া উচিত।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সঠিক মাত্রায় নিয়মিত ঘুম হলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। আবার নিয়মিত ঘুম হলে একজন মানুষ মানসিকভাবেও চাঙা থাকতে পারে। ফলে কাজে মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয়, এবং কাজ করতে সুবিধা হয়। এমনকি ঠিকমতো ঘুম হলে মানসিক স্থিরতা আসে, যা নিজেকে ভালো রাখতে সহায়তা করে।’
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে