গল্প পড়া এবং আমার সন্তানের বেড়ে ওঠা

https://www.monerkhabor.com/featured/2020/05/18/26210/
https://www.monerkhabor.com/featured/2020/05/18/26210/

আমার নিজের গল্প শোনার শুরুটা আমার পরিবার থেকেই। জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরানো ঢাকার একটা একান্নবর্তি পরিবারে, যেখানে বাড়ির ছোটরা সবাই বড়দের কাছ থেকে গল্প শুনতাম রাজা-রানীর গল্প, পরীর গল্প, এরকম আরো অনেক গল্প। সেখান থেকেই গল্পের প্রতি আমার আগ্রহের শুরু। তারপর যখন স্কুলে গিয়ে পড়তে শিখলাম; গল্পের প্রতি আগ্রহ দেখে আমার মামা প্রথম দুইটা বই এনে দেন, বই দুটো ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “ক্ষীরের পুতুল” আর দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার সম্পাদিত “ঠাকুরমার ঝুলি”। বিশেষ করে যতদূর মনে পড়ে “ক্ষীরের পুতুল” বইটি পড়ে মনের জগতে একটা সাংঘাতিক পরিবর্তন হয়! বইটি আমার শিশু মনকে একটা কল্পনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল!

আরো কিছুদিন পরে আমার মামাই আমাকে “কচি কাঁচার মেলা” শিশু সংগঠনটিতে ভর্তি করিয়ে দেন। বই পড়ার অভ্যাস তখন থেকেই মূলত শুরু হয়ে গিয়েছিল। এরপরে স্কুলের লাইব্রেরীতে নিয়মিত পদচারণা ছিল এবং স্কুলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে যে কর্মসূচি ছিল সেখানে আমি রেগুলার পার্টিসিপেট করতাম। আমাদের সময়ে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এরপর বড় হতে হতে উপহার হিসেবে বই ছিল প্রথম পছন্দ। ঈদের সালামি বা জমানো টাকা দিয়ে বিভিন্ন লাইব্রেরী থেকে বই কেনা, প্রতিবছর বইমেলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। বন্ধুদের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে পড়া; এগুলো তো হরদম চলত। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন থেকেই নিজের সংগ্রহের বইগুলো যত্ন নেওয়া বা বইগুলোর প্রতি একটা টান, মায়া এই জিনিসগুলো ডেভেলপ করেছিল। তারপর থেকে দিনে দিনে পছন্দের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বই পড়া বা গল্প পড়া,গল্প শোনার বা শোনানোর অভ্যাস সেটা পরিবর্তন হয়নি।
আমাদের ছোটবেলাটার সময়ে বেশিরভাগ বড়রা পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়াকে সময় নষ্ট করা মনে করতেন। অনেক বাবা-মাই ছেলে মেয়েকে বই পড়তে নিরুৎসাহিত করতেন। তো নিজে যখন মা হলাম, আমার মনে একটা ভাবনা কাজ করতো, আমার মেয়ের গল্প শোনার আগ্রহ আর পাঠক মন যেন ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠে। আমার মেয়ের সাথে গল্প বলার শুরুটা বিভিন্ন রকমের কালারফুল পিকচার বুক দিয়ে, পিকচার গুলো দেখে দেখে গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলতাম আর ওকে বলতাম, ‘তুমিও আমাকে একটা গল্প শোনাও’। ওর বিভিন্ন কাজ- যেমন খাওয়া, ঘুম, গোসল প্রতিটা সময়ই ওকে আমি ও আমার পরিবারের অন্যান্যরা গল্প বলত।
আমাদের ছোটবেলার বিভিন্ন গল্প, রাজা রানীর গল্প, পরীর গল্প আরো অনেক অনেক গল্প, যেগুলো শুনতে শুনতে ওর মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। কিছু মিস করে গেলে ও আবার ধরিয়ে দিতো। বই মেলায় গিয়ে ওর জন্য পছন্দ করে ছবিসহ গল্পের বই কেনা, সেগুলো পড়ে শোনানো, আরেকটু বড় হয়ে ও নিজেই পড়ে শোনাতো। এভাবেই আমাদের গল্পের জগতে পথচলার শুরু। আমার মেয়ে এখন ক্লাস এইটে, তার টিনএজ সময়টা পার করছে। আমরা জানি যে টিনএজ সময়টা জীবনের সবচেয়ে সেনসিটিভ একটা সময়। আর এখনকার টিনএজ বাচ্চারা তো তাদের স্কুল, কোচিং আর আদার্স অ্যাক্টিভিটি নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে তাদের বইমুখী করাটা খুবই কঠিন একটা কাজ! তার ওপর বিভিন্ন রকমের টেকনোলজি, মোবাইল, কম্পিউটার, গ্যাজেট বা ডিভাইস এর প্রতি আসক্তি এখনকার শিশুদের মধ্যে খুবই কমন একটা ব্যাপার। সেজন্য আমার মতে বাবা-মাকে গল্প বলা শিশুর একদম ছোটবেলা থেকেই শুরু করা উচিত। মা হিসেবে সাধারণত আমি যে কাজগুলো মেয়ের সাথে করি-

১. পারিবারিক আবহে রিডিং কালচারকে প্র্যাকটিস করা; অর্থাৎ ফ্যামিলি টাইমে বাসার সবার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, আমরা কি পড়ছি তা নিজেদের মাঝে শেয়ার করা, কি ভাবছি তা লিখে ফেলা, সবাই মিলে গল্পের আসর জমানো। ওরা কিন্তু আমাদের দেখেই শিখে, সেজন্য আমার মনে হয় বাবা-মা হিসেবে এ অভ্যাসটিকে আমাদের গুরুত্বের সাথে নেয়া দরকার।

২. আমি আমার মেয়েকে তার পছন্দনুযায়ী বই পড়তে দেই এবং কিনতে দেই। তবে তার আগে অবশ্যই দেখে নেই বইটির কনটেন্ট তার বয়স অনুযায়ী ঠিক আছে কিনা! একটা বই কেন তার এখনি পড়া উচিত নয় তা অবশ্যই তাকে বুঝিয়ে বলি।

৩. আমি চেষ্টা করি আমার মেয়ে যে ধরনের কাজগুলো পছন্দ করে সেই বিষয়ের উপরে বা ধরনের বইগুলো পড়তে বলি, যেমন তার ট্রাভেলিং অনেক পছন্দ সেজন্য ভ্রমণ বিষয়ক বই তাকে পড়তে দেওয়া, সাইন্স এক্টিভিটিস পছন্দ যে কারণে সাইন্স ফিকশনের বই পড়তে দেই। আবার ইদানিং ক্লাসিক ছোটগল্পের প্রতি তার আগ্রহ বাড়ার কারণে, যেসব ক্লাসিক ছোটগল্প উপন্যাস নিয়ে সিনেমা, নাটক বানানো হয়েছে সেগুলো দেখতে উৎসাহিত করি। আমার মনে হয় এতে ওর ভাবনার সাথে ভিজুয়ালাইজেশন এর একটা যোগসূত্র তৈরি হয়।

৪. বিভিন্ন লাইব্রেরীর মেম্বারশিপ নিয়ে দেয়া, ও যেন বই আনে এবং পড়ে সেটা মনিটর করা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা, সমবয়সী রিডার গ্রুপের সাথে এড করে দেওয়া। এই কাজগুলো করতে গিয়ে ও যেন ওর ভাবনাগুলো শেয়ার করে আমাদের সাথে সেটা আমি খেয়াল রাখি। ওর কালেকশনের বই গুলো যেন নিজে যত্ন করে সেটা বলি।

৫. আরো একটা জিনিস আমি করি, এখনকার ছেলেমেয়েরা তো আসলে অনেক টেকনোলজি নির্ভর এবং অনেক ব্যস্ত থাকে। অনেক সময় বই হাতে নিয়ে পড়ার ইচ্ছে তো ওদের নাও হতে পারে, সে জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করে কিভাবে তার পছন্দের বই সে খুঁজে পাবে, ই-বুক কিভাবে ডাউনলোড করতে হবে, সময়-সুযোগমতো কিভাবে সে বইটি পড়বে সে ব্যাপারগুলো নিয়েও তাকে বলি।

টিন এজ বয়সটা বাচ্চাদের জীবনের ভিত্তি গড়ার সময়, তাদের কল্পনার জগতটাকে অনেক বড় করে দেওয়ার জন্য বই পড়ার আসলে কোন বিকল্প নেই। বিভিন্ন লেখকের এর বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার মাধ্যমে শিশুরা মানুষ, সমাজ এবং পৃথিবী সম্পর্কে জানতে পারে, যা তাদের পরবর্তী জীবনের পাথেয় হিসেবে রয়ে যায়। বাবা মায়েরা তাদের মত করে তাদের সন্তানকে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে উৎসাহিত করবেন। বাবা মা হিসেবে নিজের সন্তানের জন্য এতোটুকু তো আমরা করতেই পারি।

লেখক: ইসমত আরা ইমু, Psychologist, Bangladesh Early Adversity Neuro imaging Study, icddr, b, MS in Education and Counseling Psychology, University of Dhaka, Masters in Public Health, State university of Bangladesh,ismat.ara@icddrb.org

Previous articleসংক্রমণের আতঙ্ক মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে দোকান কর্মচারীদের
Next articleবয়ঃসন্ধিকাল এবং হোম কোয়ারেন্টাইন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here