ইংরেজিতে একটি শব্দ রয়েছে ‘মিলেনিয়াল’। গত শতকের শেষাংশে অর্থাৎ ৮০ ও ৯০ এর দশকে যাদের জন্ম তাদেরকেই বলা হয় মিলেনিয়াল। ব্যাপক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও তার প্রসার, বৈশ্বিকীকরণ ইত্যাদি দ্রুত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে সবচাইতে বেশি যেতে হয়েছে এই মিলেনিয়ালদের।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুটা ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। এখানে এসে যেন প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে একটু একটু করে গিলে ফেলছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রজন্মের সৃষ্টি হচ্ছে আত্মিক সংকট। একবিংশ শতাব্দীর প্রজন্ম শুধু এক বয়সের নয়। এ প্রজন্ম হচ্ছে তারাই এই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই যাদের বোঝার বয়স হয়েছে। এ প্রজন্মের সদস্য সদ্য কৈশোর থেকে পূর্ণ যৌবন পর্যন্ত। আরও আশ্চর্যের বিষয়, আলাদা আলাদাভাবে হলেও অনেকের অনুভূতি অনেকটাই মিলে যাচ্ছে। ‘দা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা অবলম্বনে এই একবিংশীয় প্রজন্মের কয়েকজনের মনের কথা তুলে ধরছেন মাসাফি আহমেদ ফেরদৌস অনিক। এ যেন অল্প কয়েকজনের মনের কথাই প্রতিনিধিত্ব করছে একটা পুরো প্রজন্মের। দুই পর্বের এই প্রতিবেদনের আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম পর্ব।
রোজ ব্রিটেচার: আমাদের স্বপ্নগুলো বিক্রি হয়ে গেছে, কিন্তু ভয়ে ডুবে আছি ভবিষ্যতে দুঃস্বপ্নে
আমার কাছে অনিশ্চয়তাই দুশ্চিন্তা। ব্যাপারটা এমন যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে খারাপ কিছু হতে পারে। সমুদ্র দেখার অনুভূতিতে নতুনত্ব নেই এখন; কিন্তু আমার প্রজন্ম এক রাশ অদ্ভুত অজানার মাঝে পড়তে শুরু করেছে।
নিজেদের সহজলভ্য করে তুলতে, সোশ্যাল মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রতিকূলতার মাঝেও আত্মপ্রচার বাধ্যতামূলক বলে মনে হয়; তখন কর্মজীবন আর ব্যক্তিগত জীবনের সীমা ঝাপসা হতে শুরু করে। আজকাল অনলাইনে কিছু পোস্ট করলে ছটফট করি। পাবলিক টুইটে বা ফোরামে, আমাকে বিকৃতমস্তিস্ক, বিকারগ্রস্থ, বিকৃত রুচি- কত কি ডাকা হয়েছে। আমার কাছের বন্ধুরা আমাকে কমেন্ট পড়তে নিষেধ করেছে।
এ তো গেল একদিক। অন্যদিকে, দীর্ঘদিনের দুশ্চিন্তার ব্যাধি আমার। মানসিক চাপে আমার কণ্ঠস্বর বিশেষভাবে কাঁপে। রাস্তায় অপরিচিত কাউকে দেখলেই ‘উফ’ শব্দ করি। বুঝতে পারি, আমার থেরাপির প্রয়োজন। কিন্তু লন্ডনের স্থানীয়ভাবে কোথাও দেখাতে গেলে ৭-৮ মাস অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের প্রজন্মের বয়স বাড়ছে, আমরা কি ঠিক সংকটের মুহূর্তে ফ্রি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাব? যদি না পাই, আমরা কি বেসরকারিভাবে এই সেবা নেয়ার ব্যয় বহন করতে পারব? আমরা অনেকেই জানি না।
এদিকে বিজ্ঞাপনদাতারা আমাদের প্রজন্মের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করছে- সৃষ্টিশীল কাব্যিক স্বাধীনতার, অবিন্যস্ত দৈহিক সৌন্দর্যের, উঁচু ছাদের অট্টালিকার। কাজের অংশ হিসেবে আমাকে বিভিন্ন প্রোডাকশন কোম্পানি এবং বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্য বাণিজ্যিক বিষয়ে কাজ করতে হয়। গত দু বছরের স্বল্পসময়েই দেখেছি, শতকরা ৮০ ভাগ কোম্পানির লক্ষ্য একবিংশীয় প্রজন্ম।
পুরুষের আগের ফ্যাশন ব্রান্ডগুলো কার গাড়িতে আরও ব্যাপক-সমসাময়িক পুরুষালি ফ্যাশন যুক্ত করতে চাইছে। তাই তারা ঐতিহ্যগত জীবনধর্মী বিজ্ঞাপন থেকে সরে আসছে। কিছু বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইনিং আবার প্রগতিশীলতার নামে খুবই সূক্ষ্ণ । তারুণ্য শক্তির জয়গানের ছলে এদের অনেকেই অনেক উদ্ভট ব্যঙ্গাত্মক; এমনকি যৌনতাপূর্ণ স্লোগান বেছে নিচ্ছে: ‘আমরা জীবন প্রেমিক।’ ‘ আমরা আগে সৃষ্টি করি, পরে প্রশ্ন করি।’ ‘আমরা সৃষ্টি করি, অনুপ্রাণিত করি এবং করতেই থাকি।’ ‘আমরা মহাকাব্যের মত বানাতে চাই।’
আমাদের সংস্কৃতি একবিংশ শতাব্দীর আদর্শ সম্পর্কে তরুণ সমাজের সচেতনতার অগ্রগতি ঘটাচ্ছে। যখন এই মুহূর্তে আমাদের স্বপ্ন পূরণের রসদ একটু করে ক্ষয় করে ফেলা হচ্ছে, তখন তরুণদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে, আমাদের জীবন কেমন হওয়া উচিত- তা আমরা কীভাবে ভাবি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক: পছন্দের সবকিছু পেতে হবে – এটাই অনেক বেশি মানসিক চাপ
এমন কোনো সময়ের কথা আসলে মনে করতে পারিনা যখন দুশ্চিন্তা ছিল না। এমনকি ছোটবেলায় যখন স্কুল থেকে নিতে আসতে বাবা-মার কোনো কারণে দেরি হত; কাঁদতাম। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যেতাম, হয়তো তারা হারিয়ে গেছে অথবা কোনো ভয়ঙ্কর কার দুর্ঘটনা হয়েছে তাদের।
তবে আশ্চর্যের বিষয় গত বছর আমার দুশ্চিন্তার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমার আগেও অনেক মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। নির্দিষ্টভাবে বললে, কৈশোরের শেষে আমার খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধুর মৃত্যু আমাকে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমার গত ২৭ তম জন্মদিনের অভিজ্ঞতার মত কিছুই আমাকে মুষড়ে ফেলতে পারেনি।
আমি একটা চাকরি নিয়েছিলাম। অনেক পরিশ্রমও করেছি। কিন্তু সামাজিক জীবনের বোঝাপড়ার মানসিক চাপ নিতে গিয়ে ঘৃণা পেতে হয়েছে। আমার বয়ফ্রেন্ড পড়াশোনার জন্য গত দুই বছর যাবত দেশের বাইরে। এই মুহূর্তে তাকে পাশে না পাওয়ার অভাব ভীষণভাবে অনুভব করছিলাম। দুঃসহ লাগছিল। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছিল। কীভাবে আমি ক্যারিয়ারে উন্নতি করব? আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্ক কি শেষ হয়ে যাবে? এরপর এক রাতে হঠাৎ স্বাভাবিক ঘুম হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আমি যতই চেষ্টা করি, তবুও যেন এই চিন্তাগুলোই মাথার ভিতর বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল। ঘুম যত কমে গেল, মানসিক চাপ তত বাড়তে লাগল। এই দুশ্চিন্তা আর অবসাদের মাঝে এক সময় অনুভব করলাম, কেও যেন আমাকে পানিতে জবজবে করে ভিজিয়ে দিচ্ছে, আমার ব্যক্তিত্বকে নিঃশেষ করে ফেলছে যাতে আমি কখনও নিজেকে খুঁজে না পাই। আমি ঠিকভাবে খেতে পারছিলাম না। ঘুমাতে পারছিলাম না। সবকিছু নিয়েই আতঙ্ক কাজ করছিল।
মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার মোকাবেলা করা যে কারো জন্যই কঠিন। কিন্তু একজন তরুণ যে সোশ্যাল মিডিয়ায় আতিশয্যে থাকা সমাজে বাস করছে- সেখানে পছন্দের সব কিছু পেতে চায় সে। তার মানসিক চাপ অনেক বেশি।
নিজেকে অসুখী দেখে আমার প্রচণ্ড লজ্জা বোধ হয়, যখন পেপারে নিজের লেখা দেখি, ‘আমার জীবন অসাধারণ।’ অনেকের হিংসা করার মত একটা চাকরি করতাম। লন্ডনে বন্ধুদের সাথে অনেক বড় ফ্ল্যাটে থাকতাম। কাউকে বলতে চাইনি, বাইরে থেকে চমৎকার লাগলেও ভেতরে ভেতরে আমি অবিশ্বাস্য একা। হাস্যকর যে, একদিন আমি বন্ধুদের আমার মনের কথা বললাম। তারাও নাকি আমার মতই অনুভব করে। আমার একাকীত্ব যেন একটু কমল।
তবে আমার অবস্থাটা সম্ভবত একটু ভিন্ন। কাউন্সেলিং-এর সময় বুঝতে পারলাম, আমি অতীতে ঘটা কোনো মানসিক আঘাতের অবদমিত সমস্যায়ও ভুগছি। তবে যাই হোক, এই ব্যাপারটা মোটেই মূল সমস্যাকে সরাতে পারে না, যে আধুনিক জীবন আমাকে আত্মিক সংকটে ফেলে দিচ্ছে। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় আমাকে একটা ট্রেডমিলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ট্রেডমিলটি কোন দিকে যাচ্ছে, তা ঠিক করার কোনো অধিকার আমার নেই। এমনকি ভাবারও সুযোগ নেই। নেই মুক্তিরও উপায়।
এটা এমন একটা বিশ্ব যেখানে অনেক তরুণের মনে একই অনুভূতি কাজ করে। তাদের কথার কোনো মূল্য নেই। আমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানিদের প্রজন্মের মত নিজেদের বাড়ির সাথে, এখানে ওখানে ভ্রমণের সাথে, জীবন যাপনের সাথে আত্মাকে জুড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। এটা ভাবাই অনেক বেশি সহজ যে আমরা সবাই বাক্সবন্দি হয়ে আছি। তবে আমরা একা নই। একটু সময় নিয়ে ভাবলে আর ভাবনাগুলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে এই বাক্সটাকে ছুড়ে ফেলা সম্ভব বলে বিশ্বাস করি।
আগামী পর্বে সমাপ্ত…