“লাবিবা শাওয়ার নিয়ে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছে। তার চুল অনেক লম্বা হয়ে গেছে! মা তাকে একদম চুল বড় করতে দেয়না। খালি বলে যত্ন করতে পারবেনা আর ভেজা চুলে ঠান্ডা লেগে যাবে। পিঠের নিচে চুল এলেই মা কেটে ফেলার জন্য হৈচৈ শুরু করে দেয়! সে এখন কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্রী। ১৫ মার্চ থেকে কলেজ বন্ধ হয়ে গেলেও অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস করে যাচ্ছে। কত পিছিয়ে যাচ্ছে সব কিছু থেকে! আর বন্ধুদের সাথে ক্লাস, আড্ডা, হৈচৈ, রেস্টুরেন্টে খাওয়া কত যে মিস করছে লাবিবা!
এমনিতেই কলেজ সময়টা খুবই কম, তারমধ্যে কতগুলো মাস চলে গেলো। কেমন যে সব এলোমেলো হয়ে গেল। হঠাৎ মুঠোফোনে হুমায়রার নাম দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল তার। লাবিবা হল হুমায়রার বেস্ট ফ্রেন্ড। এ বছর জানুয়ারীতে ওরা বাসা বদলে বেশ দূরে চলে গেলেও ফোনে নিয়মিত কথা হচ্ছে। তাই ফোন রিসিভ করতে লাবিবা একটুও দেরি করল না। কিন্তু হুমায়রার কান্নায় লাবিবার বুকটা কেঁপে উঠে! প্রথমেই মনে হল কি হয়েছে হুমায়রার, ওর কি করোনা পজিটিভ।
হুমায়রার বাবার কিডনি ডায়ালিসিস চলছিল। কিন্তু উনি এভাবে এত তাড়াতাড়ি সবাইকে ছেড়ে চলে যাবেন কেউ ভাবতেই পারেনি। কিন্তু বন্ধুর এত বড় বিপদে তাকেতো তার পাশে থাকতেই হবে। লাইন কেটে দৌড়ে মায়ের কাছে যায় লাবিবা। সে এখনই হুমায়রার বাসায় যেতে চায়, তার পাশে থাকার যে কেউ নেই! লাবিবা জানে সে ছাড়া হুমায়রার আর কোন বন্ধুই নেই যে ওকে এসময় শান্তনা দিবে। কিন্তু লাবিবা নিস্তব্ধ হয়ে গেল জেনে যে এই করোনাভাইরাস আপদকালীন সময়ে মা তাকে বাসা থেকে বের হতে দিবেন না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। তার সবচেয়ে প্রিয়বন্ধুর সবচেয়ে বড় বিপদে সে পাশে থাকতে পারল না! নিজেকে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবেনা সে। পৃথিবীর সবাইকে বড্ড স্বার্থপর মনে হচ্ছে! নিজের রুমে একা কান্না করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই এই স্বার্থপর পৃথিবীতে!”
আমাদের চারপাশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে কিশোর-কিশোরীদেরকে যদি প্রাথমিক ধারণা না দেয়া হয় তখন প্রায়শই তারা নিজস্ব ধারায় চিন্তা করে যা অনেক সময়ই তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাচ্চারা কী ভাববে এবং কী অনুভব করবে তা নিয়ে পরিবারগুলোর মধ্যে কিছু অব্যক্ত নিয়ম রয়েছে যেমন, “আমরা সাধারণত আবেগ, অনুভূতি নিয়ে কথা বলি না”, “ছেলেদের কান্না করা উচিত নয়” বা “সবকিছু ঠিক আছে বলে ভান করা” ইত্যাদি। তবে এসব থেকে নিজেদের অজান্তেই দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা এবং ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে।
এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে কিশোর-কিশোরীরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে একটি অস্থির সময়কাল পার করে। প্রায়শই অভিভাবকরা “সক্রিয় শ্রবণ” বলতে কি বুঝায় তা বুঝতে পারেন না। সক্রিয় শ্রোতা হওয়ার অনুশীলনকে অবহেলা করা কিশোর-কিশোরীদের সাথে কেবল দুর্বল যোগাযোগের কারণ নয়, এটি পিতামাতার দায়িত্বকেও ক্ষুন্ন করে। আপনার সন্তানের প্রয়োজনগুলো আপনার নিজের থেকে কিছুটা আলাদা। তার এমন ব্যক্তির দরকার যিনি মনে করেন না যে তিনি “সবচেয়ে ভাল জানেন”। একজন সক্রিয় শ্রোতা মনোযোগী, যত্নশীল এবং আপোস করতে ইচ্ছুক। তিনি জানেন ব্যক্তির আচরণের সাথে একমত না হলেও কীভাবে কথা বলে সমবেদনা জানাতে হয়। তিনি উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া জানান মৌখিকভাবে এবং মনোযোগী দেহের ভাষার মাধ্যমে।
কিশোর কিশোরীদের মন খারাপের সময় কীভাবে পাশে থাকবেন
যখন কোন সমস্যা হয় আমাদের মস্তিষ্ক প্যানিক মোডে পরিবর্তিত হয়। “অ্যাড্রেনালাইন” দেহকে এই হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করে বা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য শিরাগুলিতে পাম্প করে। তবে প্যানিক মোডে প্যারেন্টিং সাধারণত ভাল হয় না। “অক্সিটোসিন” একটি প্রাকৃতিক স্ট্রেস রিলিভার। যখন আমাদের এই হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তখন তা উদ্বেগ হ্রাস করতে এবং শিথিল করতে আমাদের মস্তিষ্কে কাজ করে। একটি উচ্চতর “অক্সিটোসিন” স্তর নিম্ন রক্তচাপ এবং হার্টের হারের সাথে সম্পর্কিত। একে “লাভ হরমোনও” বলা হয়। তাই শিশুর আবেগীয় মুহূর্তে তাকে স্পর্শ করুন, জড়িয়ে ধরুন যাতে সে বুঝতে পারে আপনি তাকে ভালোবাসেন, যত বড় বিপদই হোক আপনি তার পাশে আছেন।
১। মনোযোগ দিয়ে শোনাঃ সুস্পষ্ট ভাবে আপনার বাচ্চাকে সত্যিই আপনার শুনতে হবে। এর অর্থ আপনার মুখ বন্ধ করে কান খোলা রাখা। মন্তব্য না করে শুধু মনোযোগ দিয়ে শুনে যেতে হবে। সে যেন বুঝতে পারে যে আপনি তাকে শুনছেন।
২। মাল্টিটাস্কিং নয়ঃ ফোনকে সরিয়ে রাখা বা টিভি বন্ধ করার মতো সাধারণ কাজগুলো করতে ভুলে গেলে চলবে না। এ সময়টা মজাদার অন্য পরিকল্পনা করার বিষয়গুলো কিম্বা রাতের খাবারের জন্য কী পরিবেশন করবেন বা আপনার অফিসের কাজ ইত্যাদি ভেবে, এই কথোপকথনটি কতটা সময় নেবে এ সম্পর্কে না ভাবাই ভাল।
৩। সুস্পষ্ট প্রশ্ন জিজ্ঞাসাঃ যদি আপনার সন্তানের কথা বিভ্রান্তিকর বা অস্পষ্ট হয় তবে বলতে পারেন, “এ বিষয়ে তুমি আরও কিছু বলতে পার” বা “আর কি কি হয়েছিল”।প্রশ্নগুলি কঠোর জিজ্ঞাসাবাদে পরিণত না হয়ে আবেগপূর্ণ ও কৌতূহলী হতে হবে। আপনি যে তাকে দোষারোপ করবেন না এমন আচরণ বজায় রাখতে হবে। নেতিবাচক বা হাইপারফোকাস হওয়ার পরিবর্তে আপনার সন্তানের কথাতে ইতিবাচক, সত্য বা সহায়ক কিছু খুঁজে পাওয়ার জন্য কাজ করতে হবে।
৪।পুনরাবৃত্তি না করাঃ প্রায়শই শোনার পরিবর্তে আমরা কিছু শেখানোর চেষ্টা করি। নিজের মতামত বা নিজের জীবনের উদাহরণ দেই। যখন আমাদের বাচ্চারা শোনে না, আমরা পুনরায় সংশোধন করি। আপাতত শুধুই শুনুন।
৫। সমস্ত আবেগকে গ্রহণ করাঃ কিশোর-কিশোরীদের আবেগে শিশুদের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় পার্থক্য রয়েছে। কথা শোনার আগেই “শান্ত হও” বা “কান্না থামাও” বলার তাগিদ প্রতিরোধ করতে হবে। বিশৃঙ্খলা বন্ধ করার চেষ্টা না করে, আপনার সন্তানের বিশৃঙ্খলায় নিজেকে শান্ত রাখার কাজ করতে হবে। তাকে বলতে পারেন, “আমি বুঝতে পারছি যে তোমার খুব খারাপ লাগছে” বা “বুঝতে পারছি এ বিষয়টি তোমাকে উদ্বিগ্ন করছে”।
৬।শান্ত থাকাঃ আপনার সন্তানের কথায় অতিরিক্ত বিচলিত বোধ করলে আপনি ডীপ ব্রেথ নিতে পারেন যাতে আপনি আবার ফোকাস করতে পারেন। এখনই শান্ত হতে না পারলে সময় নিন। বলতে পারেন, “আমি সত্যিই তোমার কথা শুনতে চাই, তবে আমার মন খারাপ হচ্ছে। যদি ৫ মিনিটের বিরতি নিতে পারি তবে আমি আরও ভালভাবে ফোকাস করতে সক্ষম হবো”।
যদিও “সক্রিয় শ্রোতার” শিল্পকে নিখুঁত করতে অনুশীলন প্রয়োজন। অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন যে সক্রিয় শ্রবণে সন্তানের সাথে ভুল বোঝাবুঝি হ্রাস হয়, পিতা-মাতার প্রতি তাদের আস্থার উন্নতি ঘটে এবং চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিগুলো শেয়ার করতে উত্সাহিত করে। আরও আত্মবিশ্বাসী এবং স্ব-সচেতন হয়ে উঠে এবং তাই পিয়ারগ্রুপ বা সমবয়সীদের চাপকেও ভাল ভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হতে পারে। সে জানবে যে যাই ঘটুক না কেন, তার বাবা-মায়ের মত শ্রোতা তার জীবনের রয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন