কাউন্সেলিংয়ে অভিভাবকদের হস্তক্ষেপ একটি প্রয়োজনীয় কৌশল

কাউন্সেলিংয়ে অভিভাবকদের হস্তক্ষেপ একটি প্রয়োজনীয় কৌশল

আঠারো বছর বয়সের উপরে প্রত্যেকটি ছাত্র, যারা নিজের ইচ্ছায় কাউন্সেলিং করাতে চায় বা অন্যের সুপারিশ মতো কাউন্সেলরের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করার সংগত অধিকার রয়েছে। এর কারণ হল কাউন্সেলিং-এর সময়ে মানুষের জীবনের অনেক ব্যক্তিগত এবং সংবেদনশীল বিষয় কাউন্সেলরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়।

গোপনীয়তা রক্ষা কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ার অন্যতম শর্ত এবং সব কাউন্সেলরকেই এই শর্ত যথাযথভাবে মেনে চলতে হয়। অধিকাংশ কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রে যার কাউন্সেলিং হচ্ছে তার কাছ থেকে পাওয়া সব তথ্য গোপন রাখা হয়। কিন্তু, অনেক সময় এমন কিছু তথ্য থাকে, যেমন— নিজের পক্ষে ক্ষতিকারক এমন কিছু বিষয়, অন্যের ক্ষতি হয় তেমন বিষয়, আত্মহত্যার চিন্তা বা এমন কোনও ক্ষেত্র যেখানে আদালতের নির্দেশে কাউন্সেলিং-এর সাহায্যে দেওয়া তথ্য সর্বসমক্ষে ফাঁস করতে হয় ছাত্র এবং অন্যান্যদের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য, সেই সব তথ্য গোপন করা ঠিক নয়। তবে এই ধরনের ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। তাই বলা যায় যে, কলেজ ক্যাম্পাসে যে কাউন্সেলিং হয়, তাতে ছাত্রদের নানান সমস্যা সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা বজায় থাকে।

কাউন্সেলিং প্রক্রিয়া চলাকালীন একজন কাউন্সেলর যদি বোঝেন যে,  অভিভাবকদের সাহায্য একটি পড়ুয়াকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তুলতে পারবে, সেই ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের হস্তক্ষেপ একান্ত জরুরি। অথবা, যদি কোনও ছাত্র একজন কাউন্সেলরকে জানায় যে, তার পড়াশোনা ঠিকভাবে না হওয়ার পিছনে দায়ী তার  বাবা-মায়ের মধ্যে ক্রমাগত ঝগড়া, তাহলে সেই কাউন্সেলর ছাত্রটির লেখাপড়ার উন্নতির জন্য কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় তার বাবা-মায়ের মধ্যস্থতা চাইতে পারেন। সন্তানের বয়ঃসন্ধি কালে কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের সক্রিয় হস্তক্ষেপের গুরুত্ব ও প্রস্তুতির মাত্রা সব সময়েই একটি বিতর্কিত বিষয়। যেহেতু কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রে তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা একটি পূর্বশর্ত, তাই যার কাউন্সেলিং করা হচ্ছে, যেমন কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে যদি একজন ছাত্রের কাউন্সেলিং করা হয়, সেখানে কোনও হয়ত ছাত্র তাঁর কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রে অভিভাবকের মধ্যস্থতা না-ও চাইতে পারে। কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের কাছে কয়েকটি নির্বাচিত তথ্য প্রকাশ করা এবং ধীরে ধীরে তাঁদের এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে দেওয়া অথবা তথ্য গোপন রাখার জন্য সম্পূর্ণ নীতিগত কারণে ছাত্রদের কাউন্সেলিং-এর সময়ে তাদের বাড়ির লোকেদের হস্তক্ষেপ করতে না দেওয়া— এই দুই পদ্ধতির মধ্যে কোনটি একজন কাউন্সেলর অনুসরণ করবেন, এই নিয়ে তাঁদের মনে সংশয় দেখা দেয়।

এমনকী, যখন কাউন্সেলর সিদ্ধান্ত নেন যে, কোনও ছাত্রের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তার বাবা-মায়ের সাহায্য দরকার, তখন অভিভাবকদের ভূমিকা হয় অনেকটা আত্মরক্ষামূলক। অনেক সময়ে কাউন্সেলরদের বক্তব্য অভিভাবকরা মনোযোগ সহকারে শুনতেই চায় না। এমনকী, তাদের সন্তান যে কোনও সমস্যায় পড়েছে, সেকথা তারা মানতেই পারে না। এই প্রসঙ্গে প্রবন্ধের লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাউন্সেলর একজন মাকে তার ছেলের আচরণের উপর নজর রাখতে বলেছিলেন, কারণ কাউন্সেলরের মনে হয়েছিল যে ওই ছেলেটি কোনও নেশায় আসক্ত হয়েছে। কিন্তু ছেলেটির মা কাউন্সেলরের সেই অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন এবং তার ছেলে যে কোনও নেশা করে না এই দাবি করে ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলেন। অথচ এই ঘটনার মাস খানেক পর ছেলেটির মা আবার ওই কাউন্সেলরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়েছিল যে, সে তার ছেলের ঘরে সত্যি সত্যি নেশার বস্তু দেখতে পেয়েছে। কাউন্সেলর এই ঘটনাটিকে অত্যন্ত সংবেদনশীল হিসেবে বিবেচনা করে ছেলেটির মায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন এবং তাদের শুধু সতর্ক করেই ছেড়ে দেন না, বরং কাউন্সেলিং প্রক্রিয়াও আরম্ভ করেছিলেন।

অনেক সময় অভিভাবকরা তাদের সন্তানের কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চায় না। কারণ তাদের ভয় থাকে যে, এর ফলে পরিবারের গোপনীয়তা বাইরে প্রকাশ পেয়ে যাবে। কিন্তু কাউন্সেলরদের মতে, এহেন সমস্যার মোকাবিলার ক্ষেত্রে পরিবারগত সাহায্য চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি কার্যকরী অঙ্গ। এবং এই পদ্ধতির সাহায্যে ছেলে-মেয়েদের বয়ঃসন্ধি পর্যায়ের নানা সমস্যা, যেমন নেশা করা, অপরাধপ্রবণতা প্রভৃতির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তাই কাউন্সেলররা কাউন্সেলিং-এর জন্য নিজেদের বিবেচনা মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিভাবকদের হস্তক্ষেপের বিষয়টিকে বেছে নেন।

একজন কাউন্সেলর বা শিক্ষক, যাঁরা ছাত্রদের স্বাভাবিক প্রবণতাগুলিকে বুঝতে পারেন, তাঁরা অনেক সময়েই তাঁদের কাজে সফল হওয়ার জন্য অভিভাবকদের সাহায্য গ্রহণ করেন। একটি কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের যুক্ত করার আগে, একজন কাউন্সেলরের উচিত একটি ছাত্রের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা এবং কোন তথ্য, কতটা পরিমাণে অভিভাবকদের সামনে প্রকাশ করবেন সে ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটে। যেমন— কলেজ কর্তৃপক্ষ যদি কোনও একজন ছাত্রের বাবার কাছে থেকে জানতে পারে যে, ওই ছাত্রটি কলেজেরই একটি ছাত্রীকে নানাভাবে বিরক্ত করার চেষ্টা করছে এবং সেই কারণে ছাত্রীটি কলেজে যেতে ভয় পাচ্ছে, সেই তথ্য কলেজের পক্ষ থেকে অবিলম্বে ওই ছাত্রীর বাড়িতে জানানো হয়। এই পরিস্থতিতে কাউন্সেলিং এবং কলেজের শৃঙ্খলা রক্ষা করা— দুটিই প্রয়োজনীয় বিষয়। কলেজের কাউন্সেলদের পক্ষে অভিভাবকদের প্রতি যথাযথ বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তাদের সুস্থতার দিকে নজর দেওয়া একান্ত জরুরি। যখন কলেজের কাউন্সেলর বা শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ির লোকেদের দেখা হবে, যেমন—শিক্ষক-অভিভাবকদের মিটিং-এর সময়, তখন একজন শিক্ষক বা কাউন্সেলরের উচিত সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। তবে সমস্ত কলেজের ক্ষেত্রেই যে এহেন মিটিং-এর ব্যবস্থ থাকে তা নয়। শিক্ষক-অভিভাবকদের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে অভিভাবকদের সামনে একটি বিষয় নিশ্চিত করা যায় যে, তাদের সন্তানদের প্রতি কলেজ কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট যত্নশীল।

লেখক- ডাক্তার উমা ওয়ারিয়ার,মুখ্য কাউন্সেলর
জৈন বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাঙ্গালুর।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

 

 

Previous articleঘুম থেকে চিৎকার করে উঠি
Next articleযে ধরনের মানুষ থেকে দূরে থাকা উচিৎ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here