ডা. অনন্যা কর
ফেইজ-বি রেসিডেন্ট,সাইকিয়াট্রি, বিএসএমএমএউ
কর্মক্ষেত্রে মানসিক অস্থিরতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এটি কর্মীদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের উপর বিশাল প্রভাব ফেলে। মানসিক অস্থিরতা বেশ কিছু কারণ থেকে উদ্ভূত হতে পারে—যেমন কাজের চাপ, লক্ষ্যপূরণের জন্য মাত্রাতিরিক্ত চাপ, সময়ের অভাব, সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, এবং পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সমস্যা। এসব কারণগুলো কর্মক্ষেত্রে কর্মীর আচরণ, মনোভাব এবং উৎপাদনশীলতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক অস্থিরতার কারণ
কর্মক্ষেত্রে মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টির বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু প্রধান কারণ হলো:
১. কাজের অতিরিক্ত চাপ: নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেক কাজ শেষ করার চাপ কর্মীদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। যখন একজন কর্মী মনে করেন যে তার কাজের চাপ সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন তার মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা এবং কাজের প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হয়।
২. স্বচ্ছন্দ ও সহায়ক পরিবেশের অভাব: কর্মক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছন্দ ও সহায়ক পরিবেশ না থাকলে কর্মীরা মানসিকভাবে অস্থির বোধ করেন। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতনদের মাঝে আন্তঃসম্পর্কের অভাব, যোগাযোগে সমস্যা, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব কর্মীদের মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি করে।
৩. কাজের প্রতি আগ্রহের অভাব: যখন একজন কর্মী কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, তখন তার মধ্যে হতাশা ও বিরক্তি বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতি তখন সৃষ্টি হয়, যখন কোনো কর্মী কাজের মধ্যে মানসিক সন্তুষ্টি পান না বা তার কাজকে অর্থবহ বলে মনে করেন না।
৪. ব্যক্তিগত সমস্যা: পারিবারিক, আর্থিক বা ব্যক্তিগত সমস্যা কর্মীদের মানসিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা কাজের পরিবেশে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক অস্থিরতার প্রভাব
কর্মক্ষেত্রে মানসিক অস্থিরতা কর্মীদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এটি শুধু কর্মীর জন্যই নয়, প্রতিষ্ঠানটির জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। কিছু উল্লেখযোগ্য প্রভাবের মধ্যে রয়েছে:
১. কম উৎপাদনশীলতা: কর্মীদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা থাকলে তাদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। তারা কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজেও মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হন। এটি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যপূরণে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
২. সৃজনশীলতার অভাব: মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের মধ্যে থাকা কর্মীরা সৃজনশীল ধারণা বা সমাধান খুঁজতে অক্ষম হন। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন আইডিয়া, সৃজনশীল সমাধান বা উদ্ভাবনের সুযোগ কমে যায়।
৩. ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের অবনতি: মানসিক অস্থিরতা শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে। কর্মীরা সহজেই রেগে যান, সামাজিক মেলামেশায় আগ্রহ হারান এবং সম্পর্কগুলোতে অশান্তি সৃষ্টি হয়।
৪. বিভ্রান্তি ও ভুলের প্রবণতা: মানসিক অস্থিরতা কর্মীদের মনোযোগের অভাব তৈরি করে, যার ফলে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং ভুলের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এতে কাজের গুণমান হ্রাস পায় এবং পুনরায় কাজ করতে হয়।
৫. অবসাদগ্রস্ততা: মানসিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হলে কর্মীদের মধ্যে অবসাদগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে। এটি তাদের আত্মবিশ্বাসকে ক্ষুণ্ন করে এবং কাজে ফিরতে অনীহা তৈরি করে।
মানসিক অস্থিরতা দূর করার উপায়
কর্মক্ষেত্রে মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে এবং কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে:
১. বিরতি এবং বিশ্রামের সুযোগ: কর্মীদের নিয়মিত বিরতি ও বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে পুনরুজ্জীবিত হতে পারেন।
২. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম: মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্মক্ষেত্রে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। এতে কর্মীরা মানসিক অস্থিরতা ও চাপে কীভাবে সামলাতে হবে সে সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।
৩. উৎসাহ ও স্বীকৃতি প্রদান: কর্মীদের কাজের স্বীকৃতি ও উৎসাহ প্রদান তাদের মানসিক অবস্থাকে উন্নত করতে সাহায্য করে এবং তাদের মধ্যে কাজের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করে।
৪. যোগাযোগের উন্নয়ন: ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সহকর্মীদের মধ্যে সুস্থ যোগাযোগ স্থাপন করা মানসিক অস্থিরতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কর্মীরা যেন খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন এবং তাদের মতামত ও সমস্যাগুলি সহজেই প্রকাশ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
৫. মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ: কর্মীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, যেমন মানসিক পরামর্শক বা থেরাপিস্টের সাহায্য, তাদের মানসিক অস্থিরতা দূর করতে সহায়ক হতে পারে।
মানসিক অস্থিরতা দূর করার প্রচেষ্টাগুলি কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের মধ্যে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে সহায়ক হয় এবং এটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্ষমতা এবং লক্ষ্যপূরণের জন্য গুরুত্বপূর্
কর্মক্ষেত্রে মানসিক অস্থিরতা বর্তমানে একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটি শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয়, প্রতিষ্ঠানগত পর্যায়েও প্রভাব ফেলে। কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য এবং কর্মপ্রবণতার ওপর মানসিক অস্থিরতার এই প্রভাবগুলোকে নিয়ে আরও গভীরে আলোচনা করা যেতে পারে।
মানসিক অস্থিরতার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
মানসিক অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদে কর্মীদের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে, যা কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এ ধরণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলো হলো:
১. উচ্চ মাত্রার অবসাদ: মানসিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হলে এটি কর্মীদের মধ্যে তীব্র অবসাদের সৃষ্টি করতে পারে। অবসাদগ্রস্ত কর্মীরা তাদের কাজের দায়িত্ব পালনে অক্ষম হতে পারেন এবং প্রায়শই চাকরি ছাড়ার চিন্তা করতে পারেন।
২. আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি: কর্মীরা যখন বারবার কাজের ক্ষেত্রে হতাশা বা ব্যর্থতার সম্মুখীন হন, তখন তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়। এর ফলে তারা নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
৩. দেহের উপর নেতিবাচক প্রভাব: দীর্ঘমেয়াদী মানসিক অস্থিরতা শুধুমাত্র মানসিকভাবে নয়, শারীরিকভাবেও ক্ষতিকর হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে মানসিক অস্থিরতা হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এবং অনিদ্রার মতো রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
৪. কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির হার বৃদ্ধি: মানসিক অস্থিরতার কারণে কর্মীরা প্রায়ই অসুস্থতার জন্য ছুটি নেন। এটি কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির হার বাড়িয়ে দেয় এবং একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনশীলতা এবং কর্মক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৫. দীর্ঘমেয়াদী কর্মী ধরে রাখার সমস্যায় পড়া: মানসিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হলে কর্মীরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এটি প্রতিষ্ঠানটির জন্য উচ্চ কর্মী পরিবর্তনের হার এবং প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ ব্যয়ের কারণে আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মানসিক অস্থিরতা মোকাবেলায় করণীয়
মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাওয়া বা কর্মক্ষেত্রে এটি মোকাবেলা করার জন্য কর্মীদের এবং প্রতিষ্ঠান উভয়েরই কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
কর্মীদের জন্য করণীয়:
১. যোগব্যায়াম এবং ধ্যান: নিয়মিত যোগব্যায়াম এবং ধ্যান মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং কর্মীদের মধ্যে মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে। এর ফলে কর্মীরা মানসিক চাপকে ইতিবাচকভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হন।
২. সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষতা: সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা উন্নয়ন কর্মীদের কাজের চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। প্রয়োজনীয় কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য কর্মীরা তাদের সময় দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারলে মানসিক চাপের পরিমাণ কমে যায়।
৩. পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো: কর্মক্ষেত্রের মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো এবং তাদের সাথে মন খুলে কথা বলা মানসিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিষ্ঠানের জন্য করণীয়:
১. পর্যাপ্ত কাজের পরিবেশ তৈরি: কর্মীদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ তৈরি করা প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম দায়িত্ব। এটি কর্মীদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা কমাতে এবং তাদের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।
২. পরিচালনায় নমনীয়তা: কর্মীদের কাজের সময় এবং কাজের ধরনে কিছুটা নমনীয়তা রাখা দরকার, যাতে তারা কাজের চাপ কম অনুভব করেন। উদাহরণস্বরূপ, ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ বা নমনীয় সময়সূচি প্রদান কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করতে পারে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান: প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করা, যেমন কর্মস্থলে কাউন্সেলিং সেশন বা মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শকের ব্যবস্থা রাখা।
৪. সকল স্তরে উন্মুক্ত আলোচনা ও সমর্থন: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা উন্মুক্ত রাখা কর্মক্ষেত্রে একটি সমর্থনমূলক পরিবেশ গড়ে তোলে। যখন কর্মীরা তাদের উদ্বেগ এবং মানসিক সমস্যাগুলি সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন, তখন তারা মানসিক অস্থিরতা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে পারেন।
প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উচিত কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা। কর্মীদের জানাতে হবে কিভাবে মানসিক চাপকে সামলাতে হয় এবং মানসিক অস্থিরতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। কর্মক্ষেত্রে সহায়ক মনোভাব এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি হলে কর্মীরা মানসিকভাবে আরও সুরক্ষিত বোধ করেন।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক অস্থিরতা পরিচালনা এবং সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলি নিয়ে কাজ করলে, কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব হয় এবং কর্মক্ষেত্র আরও সুখময়, উৎপাদনশীল এবং স্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। মানসিক অস্থিরতা একটি সাময়িক সমস্যা হলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব, যা কর্মীদের উন্নতির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সফলতা অর্জনে সহায়ক হয়।
আরও পড়ুন-