ঘটনা-১ : আত্মহত্যা করেছেন জার্মানির হেসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী থমাস শেফার। গত ২৮ মার্চ চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়েই তিনি আত্মঘাতী হন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা গিয়েছে, করোনার প্রকোপ থেকে অর্থনীতিকে কী ভাবে বাঁচাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন ৫৪ বছরের শেফার। ইদানীং জনমক্ষেও সে ভাবে আসছিলেন না তিনি।
ঘটনা-২ : গত ২২ মার্চ করোনা ভাইরাস জনিত কারণে আইসোলেশনে যাবার ভয়ে আত্নহত্যার পথ বেছে নিলেন যুক্তরাজ্যের ১৯ বছর বয়সী মিষ্টি মেয়ে এমিলি ওয়েন, যিনি ভাল ভাবেই জীবন যাপন করছিলেন অটিজম নিয়ে । করোনা আতংকে সবাইকে কাঁদিয়ে হারিয়ে গেলেন হঠাৎ ই।
ঘটনা-৩ : ডেনিয়েলা ট্রেজ্জি ইতালীর মনজা শহরের স্যান জেরাডো হাসপাতালে আই সি ইউ তে কর্মরত ছিলেন। শত শত মৃত্যুর মিছিল তিনি আর সইতে পারছিলেন না। এর মাঝে তিনি করোনা পজিটিভ হয়ে ঘরবন্দী ছিলেন ১০ মার্চ থেকে। একসময় তার মনে হচ্ছিল তিনি করোনা জীবানু ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। এই অসহ্য যন্ত্রণা সইতে না পেরে তিনি ২৪ মার্চ বেছে নিলেন আত্নহননের পথ৷
ঘটনা-৪ : গত দেড় মাস ধরে জাহিদুল ইসলাম ঢাকায় রাজমিস্ত্রি হিসেবে শ্রমিকের কাজ করতেন। জ্বর ও সর্দিতে আক্রান্ত হয়ে দুই দিন আগে তিনি তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রামচন্দ্রপুরে আসেন। তাই গ্রামের লোকজন তাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করে নানান কটূক্তিসহ অপবাদ দিত। স্বাস্থ্যহানি হওয়ায় জাহিদুল নিজেও বিচলিত ছিলেন।
লোকজনের অপবাদ সইতে না পেরে মঙ্গলবার রাতে বাড়ির পাশে একটি গাছের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন জাহিদুল।
গত কয়েক মাস যাবৎ পুরো বিশ্ব করোনা নামের একটি মহামারীর মধ্যদিয়ে যাচ্ছে এবং সামনে আরও কতদিন এমন অবস্থার মধ্যদিয়ে যেতে হবে ঠিক নিশ্চিত নন কেউই৷ প্রিয়জনেরা সবাই সুরক্ষিত থাকবেন তো? আমি নিজের সুরক্ষা দিরে পারছি তো ঠিকমত? কতদিন ঘরবন্দী থাকবো? খাদ্যদ্রব্যের সংকট হলে বা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি হলে বাঁচব কিভাবে? আমরা নিশ্চিত করে জানিনা। এক্ষেত্রে আমাদের চেষ্টার যেন কোন ত্রুটি না হয় আমরা ক্রমাগত তা নিয়ে ভাবছি আর ভাবছি৷ এইসব অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দেয় শংকা,অস্থিরতা আর ভয়। যারা একা থাকেন তাদের মানসিক চাপ টা আরও বেশি, আত্নহত্যার ঝুঁকিও বেশি। তাহলে কি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার উর্ধ্বমুখী গ্রাফ নিম্নমুখী করার জন্য যত বেশি চেষ্টা করছে, মানুষ যত বেশি ঘরবন্দী হচ্ছে, আত্নহত্যার ঝুঁকির গ্রাফটাও কি ততবেশি উর্ধ্বমুখী হচ্ছে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে সারা বিশ্বে প্রতিবছর আট লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। সব ধরণের জনগোষ্ঠীর মধ্যেই আত্নহত্যার প্রবণতা আছে তবে তৃতীয় বিশ্বে এই হার বা ঝুঁকি আরও বেশি৷ উদ্ভুত করোনা পরিস্থিতিতে এই বিশ্ব বেশ কয়েকটি করুণ আত্নহত্যা দেখেছে৷ এই অবস্থায় আত্নহত্যার সম্ভাব্য কারণগুলো কি কি সেগুলো জানা প্রয়োজন এবং তা প্রতরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াও প্রয়োজন। নতুবা করোনায় মৃত্যুর মিছিলের সাথে আত্নহননের মিছিলটাও যে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে। আসুন জেনে নিই এই পরিস্থিতিতে কি কি কারণে একজন মানুষ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে যা তাকে ঠেলে দিতে পারে আত্নহত্যার মত করুণ পরিণতির দিকে।
এংজাইটি বা উদ্বেগ জনিত সমস্যা:-
লক্ষণসমূহ :
* সবসময় অস্থির অস্থির অনুভূত হওয়া।
* কিছু না কিছু নিয়ে সবসময় টেনশন করা
* অজানা আশংকা, যেমন -এই বুঝি কোন বিপদ হবে বা কোন খারাপ সংবাদ আসবে
* প্যানিক এটাকের মত লক্ষণ, যেমন – হঠাৎ বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট, গলা বুক চেপে আসা, মনে হয় এক্ষণ বুঝি মারাই যাচ্ছি।
* ঘাড়, মাথার পেছন টা চাপ ধরে থাকা
* বিরক্তি বেড়ে যাওয়া
* অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
*অনিদ্রা
* কোনকিছুতে মনোযোগ স্থাপনে সমস্যা।
বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার :-
* দিনের বেশিরভাগ সময় মন খারাপ লাগা এবং ভাল খবরেও ভাল না লাগা
* যে কাজগুলো আগে উপভোগ্য ছিল সেগুলো আর উপভোগ করা যাচ্ছেনা
* শরীরে ও মনে কোন ধরণের চাঞ্চল্য অনুভূত না হওয়া
*ঘুম কমে যাওয়া (ক্ষেত্রবিশেষে বাড়তেও পারে)
* সবসময় হতাশা অনুভূত হওয়া
* সবকিছুতেই নিরাশা
*একসময় মনে হতে থাকে জীবন অর্থহীন, মূল্যহীন। এই জীবনে বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।
অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি) বা শুচিবাই রোগ :-
*হাতে কোন ময়লা লেগে গেল বা জীবাণু লেগে গেল এই ধরণের অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা বার বার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনে আসা
*বার বার হাত, পরনের জামাকাপড়, বিছানার চাদর বালিশ পরিষ্কার করা, সারা ঘরবাড়ি মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে পরিষ্কার করতে থাকা
*কোন কাজ সম্পন্ন করার পর ও অহেতুক মাথায় চিন্তা আসে, হয়তো ঠিক ভাবে সম্পন্ন করিনি
অনেকেই আছেন এই রোগগুলোতে ভুগছেন বা চিকিৎসা নিচ্ছেন বা ভাল আছেন চিকিৎসা নিয়ে। এই করোনা পরিস্থিতে তাদের এই রোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে অথবা নতুন করে কেউ এই রোগসমূহে আক্রান্তও হতে পারেন৷ উভয়টিই আত্নহত্যার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া একাকীত্ব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, আবেগ-অনুভূতি কাছের মানুষকে প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রনা, বিনোদনের অভাব,একঘেয়ে জীবন-যাপন, অহেতুক ভীতি বা ফোবিয়া, অর্থনৈতিক মন্দা, দারিদ্র্য, এই করোনা পরিস্থিতিতে বেড়ে যাচ্ছে যা আত্নহনন কে তরান্বিত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে কোন প্যান্ডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারীতে সিজোফ্রেনিয়া বা ম্যানিয়ার মত রোগগুলোও মাথাচাড়া দিতে পারে যার পরিণতি হতে পারে আত্নহত্যা পর্যন্ত।
এই পরিস্থিততে আত্নহত্যা প্রতিরোধে করণীয় :-
* যারা আগে থেকে কোন মানসিক রোগে ভুগছেন তাদের দিকে নজর দেয়া বেশি জরুরি। তাদের রোগের কোন লক্ষণ বাড়ছে কিনা নজর রাখুন। চিকিৎসকএর কাছে এপয়েন্টমেন্ট থাকলে ফোনের মাধ্যমে হলেও পরামর্শ নিন। তাদেরকে একটু হলেও বেশি সময় দিন। যারা রোগ তগেকে সেরে উঠার পরে রিহ্যাবিলিটেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, অর্থাৎ টুকটাক কাজকর্ম শুরু করেছিলেন, তাদের কাজ বন্ধ থাকার ফলে এবং অতিরিক্ত আতংকের ফলে আবার পূর্বের লক্ষণ ফিরে আসতে পারে। নজর রাখুন প্রতিনিয়ত৷ বাস্তবতা বোঝান তাদেরকে। আশ্বস্ত করুন, এই দুর্যোগ সাময়িক। সব আবার ঠিক হয়ে যাবে।
* পরিবারের কোন সদস্যের মাঝে হঠাৎ উল্লিখিত কোন মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা খেয়াল রাখুন। এমন হলে চিকিৎসকএর পরামর্শ নিন দ্রুত।
আত্নহত্যার কিছু ওয়ার্নিং সাইন আছে সেগুলো জেনে নিন –
১) প্রায় প্রায় ই বিভিন্ন কথা প্রসংগে মৃত্যুর চিন্তা করা বা মৃত্যুর কতগা বলা বা মৃত্যুর ইচ্ছা পোষণ করা।
২) জীবন নিয়ে বা ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিরিক্ত হতাশা
৩) নৈরাশ্যবাদী চিন্তাভাবনা বেড়ে যাওয়া
৪)নিজের জীবন কে মূল্যহীন,লক্ষ্যহীন মনে হওয়া
৫) অসহায় বোধ হওয়া,নিজেকে বোঝা মনে হওয়া।
৬) পূর্বে আত্নহত্যার প্রচেষ্টা
৭) আমি ফাঁদে পড়ে গেছি, বের হতে পারছিনা, আটকে গেছি- এমন মনে হতে থাকা
এই লক্ষণসমূহের কোনটি আপনার পাশের মানুষটির মধ্যে দেখা গেলে তাকে সাহায্য করুন, চিকিৎসক এর পরামর্শ নিন।
* অনবরত করোনার খবর এর জন্য বিভিন্ন ভার্চুয়াল গ্রুপে সংযোজিত হওয়া যাবেনা। অনেক রকম অতিরঞ্জিত খবর বা বিভ্রান্তিকর তথ্য মানুষকে বিচলিত করে ক্রমাগত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট ছাড়া অন্য কোন তথ্য গ্রহণ করবেন না। আর বাংলাদেশের খবরের জন্য দিনের নির্দিষ্ট একটি সময় সংবাদ দেখুন।
*সঠিক তথ্য নিন। covid -19রোগ সম্পর্কে অনেক গুজব আছে, অনেক ভীতিকর বিভ্রান্তিকর তথ্য আছে। চিকিৎসক এর কাছ থেকে সেগুলো যাচাই করুন। অস্থিরতা,ভয় কেটে যাবে নিশ্চয়ই।
* সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশি হলেই কিংবা একজন হাপানি বা COPD রুগীর শ্বাসকষ্ট হলেই যে তিনি করোনা আক্রান্ত এমন ভাববেন না বা কাউকে এমন অপবাদ দিবেন না। আর করোনা কোন গজব বা পাপের ফল নয়। এমন করে বলবেন না কখনও।আপনার কথায় তরান্বিত হতে পারে কার ও মৃত্যু! কি ভয়ংকর বিষয়, ভেবে দেখেছেন কখন ও?
* ঘরে থেকেও নিজেকে নানা ভাবে ব্যস্ত রাখা যায়, যেমন – গান শোনা, মুভি দেখা, ঘর গোছানো, পরিবারের সদস্যদের কাজে সহায়তা করা, গল্পের বই পড়া, অনেক দিনের জমানো কাজগুলো যেগুলো এতদিন ব্যস্ততার কারণে করতে পারছিলেন না, সেগুলো করা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ, উপাসনা করা, নিজের শখের কোন কাজ করা বা সেগুলোর পরিসর আরেকটু বড় করা, ঘরে কোন পোষা প্রাণী থাকলে তাদের সাতগে সময় কাটস্নো বা তাদের যত্ন নেয়া,সোশ্যাল মিডিয়া বা ফোন কলের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের প্রতিদিন খোঁজ নেয়া, পুরোনো বন্ধুদের সাথে নতুন করে যোগাযোগ স্থাপন, ফোনালাপ বা চ্যাটিং ইত্যাদি।
* নতুন রেসিপির রান্না করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাওয়া দাওয়াকরা যেতে পারে।
* সরকারী ও বেসরকারীভাবে টেলিমেডিসিন/ টেলিসাইকিয়াট্রি সুবিধা বাড়ানো যাতে ফোন কলের মাধ্যমে বা ভিডিও কলের মাধ্যমে ঘরে বসে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়।
*যারা দিন আনেন দিন খান তাদের জন্য হোম কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন খুবই কষ্টের। আর্থিক টানাপোড়েন ও মানসিক যন্ত্রণা, দুইয়ে মিলে তাদের ঝুঁকি টা যে আরও বেশি! ব্যক্তিগত উদ্যোগে, এবং বেসরকারী সরকারী উদ্যোগে তাদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে অথবা তাদের সাহায্য করতে না পারলে অনেক কিছুই বিফলে চলে যাবে। না তাদের ঘরে আটকে রাখা যাবে, না তাদের বাঁচানো যাবে!
* মানসিক রোগের লক্ষণ বা আত্নহত্যার লক্ষণ দেখা দিলে হাতের কাছ থেকে ধারালো বস্ত, দড়ি, যেকোন ঔষধ বা রাসায়নিক দূরে সরিয়ে রাখুন। তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখুন।
সর্বোপরি, মনোবল সমুন্নত রাখতে হবে। আশা হারালে চলবেনা। মনে রাখুন, ধৈর্যের অনেক পরীক্ষা দিয়েছেন আপনি এই জীবনে৷ এটি আরেকটি পরীক্ষা মাত্র৷ মনে রাখুন, অনেক কঠিন সময় পার করেছেন আপনি, এটি আরেকটি কঠিন সময় মাত্র৷ আপনি এবার ও পারবেন। আপনি পারলে আপনার পাশের মানুষটি পারবে। আর তাতেই বাঁচবো আমরা সবাই। বাঁচবে পুরো বাংলাদেশ।