কগ্নিটিভ বিহেভিওর থেরাপি

কগ্নিটিভ বিহেভিওর থেরাপি

কগ্নিটিভ বিহেভিওর থেরাপি (সিবিটি) কী?

এটি একটি প্রক্রিয়া যেখানে আপনি বোঝার চেষ্টা করেনঃ

  •   আপনার নিজের সম্বন্ধে, অন্যদের সম্বন্ধে এবং পৃথিবী সম্বন্ধে কীরকম ধারণা
  •   কীভাবে আপনার অনুভূতি ও চিন্তা আপনার কাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়

সিবিটি আপনার চিন্তাধারা (কগ্নিটিভ)এবং কর্মপদ্ধতি (বিহেভিওর) পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। এতে আপনার মন ভাল থাকবে। আরো চিকিৎসাপদ্ধতি আছে যেখানে কথার মাধ্যমে চিকিৎসা হয়। কিন্তু সিবিটি এখনকার (হিয়ার এন্ড নাও) অসুবিধার উপর জোর দেয়। অতীতের কোন ঘটনা কীভাবে আপনার এখনকার কষ্টের কারণ বা অতীতের ঘটনা কীভাবে আপনাকে প্রভাবিত করে, সেটা এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রাধান্য পায় না। আপনার এখনকার মানসিকতায় কিভাবে পরিবর্তন আনা যায় সেটাই এর প্রধান কাজ।

কগ্নিটিভ বিহেভিওর থেরাপি (সিবিটি) ব্যবহার হয়ঃ

  •   দুশ্চিন্তা
  •   বিষাদ
  •   প্যানিক
  •   নানাধরনের ফোবিয়া (ভয়)
  •   বুলিমিয়া
  •   শুচিবায়ু
  •   পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসর্ডার
  •   স্কিৎসোফ্রেনিয়া

কগ্নিটিভ বিহেভিওর থেরাপি (সিবিটি) কীভাবে কাজ করে?
যখন কোনো সমস্যা বিরাট আকার ধারণ করে তখন সিবিটি সাহায্য করে সেটাকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করতে। আপনি দেখতে পাবেন এই ছোট ছোট অংশ কীভাবে সম্পর্কিত এবং  এগুলি কীভাবে আপনার উপর প্রভাব ফেলছে। এই অংশগুলি হলঃ

  • পরিস্থিতি (সমস্যা, ঘটনা বা যে কোনো অসুবিধা) এর থেকে জন্ম নেয়
  • চিন্তা
  • মনের অবস্থা
  • শারীরিক অনুভূতি
  • ব্যবহার বা কাজ

এগুলি প্রত্যেকটি একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত। একটি সমস্যা নিয়ে আপনি কীভাবে চিন্তা করছেন তা আপনার শরীর ও  মনকে প্রভাবিত করে। এবং আপনি সে ব্যাপারে কী করবেন তাও এর সঙ্গে যুক্ত।

উদাহরণঃ
বেশির ভাগ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে আপনি দুরকম দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখতে পারেন। একটি দৃষ্টিভঙ্গী আপনাকে সাহায্য করবে অন্যটি আপনাকে অসুবিধায় ফেলবে।
পরিস্থিতিঃ
আপনার সারাদিনটা খারাপ গেছে, বিরক্ত লাগছে আপনি বাজার করতে বেরোলেন। আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন দেখলেন যে উল্টোদিকে আপনার পরিচিত একজন ভদ্রলোক রাস্তা দিয়ে আসছেন। তিনি আপনার সঙ্গে কথা না বলে অন্যদিকে চলে গেলেন।

অসুবিধাজনক সুবিধাজনক
চিন্তা আমায় উপেক্ষা করছে, আমায় পছন্দ করে না মনে হল উনি চিন্তামগ্ন, হয়তো কোনো দুশ্চিন্তা ওনার মাথায় ঘুরছে
মনের অবস্থা মন খারাপ, কান্না পাচ্ছে অন্য ব্যক্তিকে নিয়ে ভাবনা
শারীরিক অনুভূতি ক্লান্ত লাগছে, গা গুলোচ্ছে, পেটে অস্বস্তি লাগছে কিছু না
পরবর্তী কাজ বা ব্যবহার বাড়ী ফিরে যাওয়া এবং ভবিষ্যতে ওনাকে উপেক্ষা করা ফোন করে জানা ওনার কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা

একই পরিস্থিতির দুটি আলাদা পরিণতি হল। এর পিছনে রয়েছে আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে ব্যাপারটা দেখছেন। আপনার চিন্তাধারা এবং আপনার অনুভূতি আপনার পরবর্তী ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করছে
।উপরের উদাহরণে বাঁদিকের  লেখাগুলি দেখলে বোঝা যায় যে আপনি একটি সিদ্ধান্তে এসেছেন সে ব্যাপারে বিশেষ চিন্তা ভাবনা না করে।  আপনার ধারণা ঠিক না ভুল সে ব্যাপারে খতিয়ে দেখেননি। এর ফলে হয়েছেঃ

  •  আপনার অস্বস্তি
  •  পরবর্তী ব্যবহার (কাম্য নয়)

আপনি মন খারাপ নিয়ে বাড়ী ফিরলেন এবং  এই কথাটাই বারবার ভাবতে লাগলেন। আরো মন খারাপ লাগলো। অন্য  ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আপনার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হওয়া সম্ভব। যোগাযোগ না করলে ভুল বোঝাবুঝি হলে তা পাল্টানোর  উপায় নেই।
নীচের ছবিতে ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছেঃ
এর ফলে আপনার সবসময় মন খারাপ লাগবে। নিজের সম্পর্কে আপনার হীন ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। তার কারণ মন খারাপ থাকলে আমরা চট করে খারাপটা ভেবে নি। ফলে ঘটনাটি যত না খারাপ, তার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব পায় আমাদের মনে। এবং এটি  ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।
সিবিটি আপনার চিন্তা, অনুভূতি ও ব্যবহারে পরিবর্তন আনতে পারে। আপনি যখন এগুলির মধ্যে সম্বন্ধ নিজে দেখতে পারবেন, তখন আপনি তাদের পরিবর্তন করতে পারবেন। এতে আপনার মন প্রফুল্ল হবে। সিবিটি আপনাকে স্বাবলম্বনের পথ দেখায়, যাতে আপনি নিজে নিজের সমস্যার মোকাবিলা করতে পারেন।

পাঁচটি বিষয়ে আলোচনাঃ
উপরে উল্লিখিত পাঁচটি ক্ষেত্রে অসুবিধা হতে পারে। সেগুলি এইভাবেও দেখা যেতে পারে। (নীচের চিত্র দেখুন)। এখানে নিকটজনদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে কীভাবে আমরা প্রভাবিত হতে পারি তা দেখা যায়। অন্যান্য অসুবিধা যথা ধারদেনা, চাকরিক্ষেত্রে অসুবিধা বা সাংসারিক অসুবিধারও ভূমিকা আছে। জীবনের একটি ক্ষেত্রে ঊন্নতি হলে অন্যগুলিতেও উপকার হবার সম্ভাবনা আছে।

কগ্নিটিভ বিহেভিওর থেরাপি (সিবিটি) তে কি হয়?
সেসন
এককভাবে বা গ্রুপের মধ্যে সিবিটির মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়। কম্পিউটার বা সেলফ হেল্প বইএর সাহায্যেও সিবিটি ব্যবহার করা যায়। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে সরকারী (NHS) অনুমোদিত দুটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম আছে—

  • ফিয়ার ফাইটার (Fear Fighter) যা ভয় কাটাতে সাহায্য করে প্যানিক বা ফোবিয়াতে
  • বিটিং দ্য ব্লু (Beating the Blues) যা অল্প বা মাঝারি তীব্রতার বিষাদরোগে কাজ করে

আপনার একক থেরাপি হলে

  •  সাধারণতঃ থেরাপিষ্টের সঙ্গে আপনার পাঁচ থেকে কুড়িটা সেসন হয়। এগুলির সময় আধঘন্টা থেকে একঘন্টা এবং এই সেসন প্রতি সপ্তাহে বা দুসপ্তাহ অন্তর হয়।
  •  প্রথম দুচারটে সেসনে আপনার থেরাপিষ্ট বোঝবার চেষ্টা করবেন আপনি এতে উপকৃত হবেন কিনা এবং আপনি ভেবে দেখবেন যে আপনি এই থেরাপিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন কিনা।
  •  আপনার থেরাপিষ্ট আপনাকে অতীতের কথা জিজ্ঞাসা করতে পারেন। যদিও সিবিটি তে এখনকার অসুবিধার ওপর জোর দেওয়া হয়, একেক সময় অতীতের কথা জানলে বোঝা যায় যে পুরানো ঘটনা কিভাবে আপনাকে প্রভাবিত করছে।
  •  আপনি ঠিক করবেন আপনি কোন সমস্যার মোকাবিলা করতে চান এবং এই সমস্যা স্বল্পমেয়াদী না দীর্ঘমেয়াদী।
  •  সাধারণতঃ আপনি এবং আপনার থেরাপিষ্ট ঠিক করবেন সেদিন আপনারা কী বিষয়ে আলোচনা করবেন।

থেরাপিঃ

  • থেরাপিষ্টের সাহায্যে আপনার সমস্যাকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করুন। আপনাকে হয়ত আপনার থেরাপিষ্ট একটি ডায়ারি রাখতে বলবে। এতে আপনি আপনার চিন্তা, মানসিকতা, শারীরিক অনুভূতি এবং কাজকর্মের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকবেন।
  • আপনি এবং আপনার থেরাপিষ্ট দুজনে মিলে দেখবেন কীভাবে আপনার চিন্তা, মানসিকতা এবং ব্যবহার আপনাকে প্রভাবিত করছে এবং আপনার চিন্তাধারা বাস্তবধর্মী কিনা।
  • আপনার থেরাপিষ্ট আপনাকে সাহায্য করবে কেমন ভাবে আপনি আপনার চিন্তাপদ্ধতি এবং ব্যবহার পরিবর্তন করবেন।
  • তবে এসব বলা সহজ, করা কঠিন। কাজেই যখন আপনি মনে করবেন যে আপনি বুঝতে পারছেন যে কোন কোন ব্যপারে পরিবর্তন আনা সম্ভব, তখন আপনার থেরাপিষ্ট আপনাকে হোম ওয়ার্কের কথা বলবেন। এই পরিবর্তন গুলি আপনার দৈনন্দিন জীবনে  প্রয়োগ করুন। যেমন ধরুন আপনি হয়তঃ
    • আপনার যে চিন্তা পীড়াদায়ক, সেই চিন্তা পরিহার করে বাস্তবভিত্তিক পজিটিভ চিন্তা (সিবিটির মাধ্যমে শেখা) মনে আনবেন।
    • বুঝতে পারবেন আপনার কোন কাজ মনে কষ্ট দেয়, তার পরিবর্তে অন্য ধরনের ব্যবহার করবেন।
  • প্রতিটি সেসনে আলোচনা করবেন আগের সেসনের পর কেমন কেটেছে আপনার দিনগুলি। ব্যবহারিক জীবনে সিবিটি প্রযোগে কোনো অসুবিধা হলে সে ব্যাপারে থেরাপিষ্টের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
  • আপনার থেরাপিষ্ট কখনোই আপনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে বলবেন না। আপনি ঠিক করবেন আপনি কী করতে চান বা চান না। সিবিটির প্রধান উপকারিতা এই যে আপনি সেসন শেষ হয়ে গেলেও যা শিখেছেন তা ব্যবহার করতে পারবেন। তার ফলে আপনার উপসর্গ ফিরে আসবার সম্ভাবনা কমে।

সিবিটি কতটা কাজ দেয়?

  • যেখানে মূল অসুবিধা বিষাদ বা দুশ্চিন্তা সেখানে খুবই কাজ দেয় সিবিটি।
  • মাঝারি বা সামান্য তীব্রতার বিষাদরোগে সবচেয়ে  উপকারী সাইকোলজিকাল চিকিৎসা সিবিটি।
  • কিছু কিছু বিষাদরোগে সিবিটির উপকারীতা বিষাদপ্রতিরোধক বড়ির মত।

অন্যান্য চিকিৎসার সঙ্গে সিবিটির পার্থক্য কী?

কগ্নিটিভ বিহেভিওর থেরাপি (সিবিটি) অনেক সময় ব্যবহৃত হয়।  সেসবের বিশদ বিবরণ দেওয়া এখানে সম্ভব না। সচরাচর যে দুটি ক্ষেত্রে সিবিটি প্রযোগ হয় (বিষাদ এবং দুশ্চিন্তা) সেই প্রসঙ্গেই আলোচনায় আসছি।
  • সিবিটি সবার জন্য না। আপনার হয়ত অন্য সাইকোলজিকাল থেরাপির প্রয়োজন।
  • কিছু কিছু বিষাদরোগে সিবিটি বিষাদপ্রতিরোধক ঔষধের মতোই উপকারী। দুশ্চিন্তার ক্ষেত্রে হয়তো ঔষধের চেয়ে সামান্য বেশি উপকারী।
  • তীব্র বিষাদরোগে আপনাকে সিবিটির সঙ্গে ঔষধ সেবন করতে হবে। তীব্র বিষন্নতায় আপনি আপনার চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপনি ঔষধ খেয়ে খানিকটা সুস্থ বোধ করছেন।
  • দুশ্চিন্তারোগে দীর্ঘদিন ঘুমের ঔষধ খাওয়া উচিৎ নয়। সিবিটি অনেক ভালো।

সিবিটির অসুবিধা

  • আপনার যদি গভীর বিষন্নতা থাকে তবে আপনার মনঃসংযোগ করতে অসুবিধা হবে। সেক্ষেত্রে সিবিটি বা অন্য যে কোনো সাইকোলজিকাল থেরাপি করতে আপনার অসুবিধা হওয়া উচিৎ।
  • এতে আপনার মন ভেঙ্গে যেতে পারে। ভালো থেরাপিষ্ট এমনভাবে আপনার সঙ্গে কাজ করবে যাতে আপনি সিবিটি করতে সক্ষম হন।
  • নিজের অনুভূতির কথা বলতে অসুবিধা হতে পারে। দুঃখ, রাগ, লজ্জা, অভিমান বা চিন্তার কথা বলতে অনেক সময়েই সংকোচ হয়।

কতদিন চলবে সিবিটি?
সাধারণত; ছয় সপ্তাহ থেকে ছয় মাস চলে। সেটা নির্ভর করে আপনার কি অসুবিধা তার উপর। সিবিটি করাতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে ওয়েটিং লিস্ট থাকে।
উপসর্গ ফিরে এলে কী হবে?
সবসময় দুশ্চিন্তা বা বিষন্নতা ফিরে আসবার সম্ভাবনা থাকে। তখন কগ্নিটিভ বিহেভিওর থেরাপি সিবিটিতে আপনি যা শিখেছেন সেগুলি ব্যবহার করলে আরাম পাবেন। সেইজন্য ভালো হয়ে গেলেও সিবিটি নিজে নিজেই চালিয়ে যাওয়া উচিৎ।
কিছু কিছু রিসার্চ আছে যেখানে প্রমানিত যে বিষাদরোগ প্রতিরোধ করতে সিবিটি ঔষধের চেয়ে বেশি উপকারী। প্রয়োজনে আপনি দ্বিতীয়বার সিবিটি করাবেন।

সিবিটি আমার জীবনে কী প্রভাব ফেলবে?
বিষন্নতা এবং দুশ্চিন্তা খুবই কষ্টকর। এতে আপনার কর্মক্ষমতা এবং জীবনকে উপভোগ করার ক্ষমতা কমে যায়। সিবিটি এই উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে আনে। এটি সময়সাপেক্ষ, কিন্তু এতে কোনো খারাপ প্রভাব পড়বে না আপনার জীবনে।

সিবিটি না করলে কী হবে?
আপনি এ ব্যপারে আপনার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। আপনি আরো যা করতে পারেন তা হলোঃ

  • সিবিটি এবং অন্যান্য চিকিৎসা সম্বন্ধে আরো পড়াশুনো করুন।
  • যদি আরো বিশদ জানতে চান এ ব্যপারে তবে সেলফ হেল্প বই বা সিডি ব্যবহার করে দেখুন।
  • অপেক্ষা করে দেখতে পারেন, এমনিতেই আপনার কষ্টের উপশম হয় কিনা। নাহলে আপনি পরে সিবিটির কথা ভাবতে পারেন।

সূত্রঃ রয়েল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টস

Previous articleঘুম নিয়ে যেসব প্রচলিত ধারণা আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে
Next articleমানসিক স্বাস্থ্যসেবার পরিধি ও বাজেট বৃদ্ধির তাগিদ দিলেন বিশেষজ্ঞরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here