ইন্টারনেট-আসক্তি: সচেতন হোন এখনই

সন্তানের ইন্টারনেট আসক্তি থেকেও হতে পারে ভালো কিছু

ভালবেসে বিয়ে করার পর ১০ বছর বেশ সুখেই ছিল আমেরিকান দম্পতি ব্রেন্ডা-এরিক।  একদিন ব্রেন্ডার পরিচয় হয় ইন্টারনেটের সাথে, তাঁর সামনে খুলে যায় এক নতুন দিগন্ত, ধীরে ধীরে ইন্টারনেটের মায়াবী জগৎ আর ‘চ্যাটিং’ হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান।
নাওয়া-খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া বাকী সময় তাঁর কাটে কম্পিউটারের সামনে।  এরিক ঘুমানোর অনেক পর ঘুমাতে যায় ব্রেন্ডা।  এর প্রভাব পরে তাদের দাম্পত্য জীবনেও।
ইন্টারনেট আসক্তি সচেতন হোন এখনই
ব্রাজিলের সাও পাওলোর ১৫ বছর বয়সী কিশোরের কাহিনীটি আরও উদ্বেগের। এ বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত এক গবেষণা-প্রতিবেদনে নাম উল্লেখ না করে তার বর্ণনা দেওয়া হয়।  ওই কিশোর দুই বছর ধরে প্রতিদিন গড়ে ১২-১৮ ঘণ্টা বাড়িতেই থাকত শুধুমাত্র ইন্টারনেট নিয়ে। এমনও হয়েছে, টানা ৩৮ ঘণ্টা ধরে সে রয়েছে ভার্চুয়াল জগতে।  ধীরে ধীরে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় বাড়তে থাকে তাঁর, একসময় নিজের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে।
সারক্ষণ ইন্টারনেটের চিন্তায় ডুবে থাকত সে, এমনকী দুবছর ধরে স্কুলে পর্যন্ত যাওয়া হয়নি তার। অতিমাত্রায় ইন্টারনেট আসক্তির কারণে তার মা কম্পিউটারের সংযোগ খুলে ফেললে সে খুবই রেগে যেত, এমনকী তিনবার এ কারণে মাকে মারধর পর্যন্ত করেছে ওই কিশোর।
কী এমন আছে এই অন্তর্জালে? কেন এর মায়াচক্রে মানুষ আটকে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ? আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ড. ডেভ গ্রিনফিল্ডের গবেষণা বলছে, অনেকগুলো বিষয় ইন্টারনেটকে এতটা আকর্ষণীয় করে তুলছে।  যার অন্যতম হচ্ছে- মাল্টিমিডিয়া।
মাল্টিমিডিয়া সংশ্লিষ্ট অসংখ্য বিষয় পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেটে, যা টেলিভিশন দেখার মতো অনুভূতি সৃষ্টি করছে মনে।
আরেকটি বিষয়, মানুষ চাহিদা অনুযায়ী ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে পারছে।  সপ্তাহে সাত দিন, দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই ইন্টারনেট তার দরজা খুলে রেখেছে।  বাস্তব জগতে ইচ্ছেমতো কিছু করতে গেলে যেসব বাধা আসে, ভার্চুয়াল জগতে সেই বাধা নেই বললেই চলে।  মানুষ ভার্চুয়াল মহাসড়কে উঠে যেখানে মন চায় যেতে পারছে, সেখানে সবকিছুই বিনা বাধায় করতে পারছে।  এছাড়া তথ্যের অবাধ আদান-প্রদান, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়, বিষয়-বৈচিত্র্য তো রয়েছেই।  ফলে, ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে।
শুধু কম্পিউটার থেকেই নয়, মোবাইল থেকে সহজেই ব্যবহার করা যাচ্ছে ইন্টারনেট।  কাজের পাশাপাশি অকাজে বা বিনা কাজেও ইন্টারনেটে থাকছে মানুষ।  একটা সময় ব্যবহারের মাত্রা বাড়তে বাড়তে তা চলে যাচ্ছে আসক্তির পর্যায়ে। আসক্তরা সাধারণত প্রথমে বুঝতে পারে না কিংবা স্বীকার করতেও চায় না যে সে আসক্ত।  আশপাশের মানুষরা টের পায় বিষয়টি।
কখন বুঝবেন এটা আসক্তি?
ইন্টারনেট আসক্তির উপসর্গগুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন  হতে পারে।  তবে, কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে যা থেকে একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যে আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে তা বোঝা যায়।  আসক্ত ব্যক্তি প্রতিদিনই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, ইন্টারনেটে বসার পর সময়জ্ঞান বলতে কিছু থাকে না তাঁর।  হয়তো বসার আগে ভাবলেন, এইতো পাঁচ মিনিটের জন্য বসছি, মেইলটা চেক করেই সাইন-আউট করবো।  বসার পর কখন ঘণ্টা পেরিয়ে যায়, খবরই থাকে না।
চীনের একদল বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সাধারণত আসক্তরা ইন্টারনেটে ৫ ধরনের কাজে বেশি ডুবে থাকে- ১. অনলাইন গেম খেলতে খেলতে কারো সময় কেটে যায়, ২. কেউ সুপ্ত অথবা বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটাতে বিরতিহীন ঘুরে বেড়ায় পর্নোগ্রাফির সাইটগুলোতে, ৩. বাস্তব জীবনে লাজুক কিংবা অন্তর্মুখী কেউ নতুন বন্ধুদের নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন আড্ডায় মেতে ওঠে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে, ৪. ইন্টারনেট শপিং হয়ে ওঠে কারো ধ্যান-জ্ঞান, ৫. কেউ বা এমনিতেই ঘুরে বেড়ায় সাইবার দুনিয়ার অলি-গলিতে।
ভার্চুয়াল জগতে থাকাকালীন বাস্তবের কেউ যদি সেই সময়ে ভাগ বসায়, ধরুন মা-বাবা কোনো কথা বলতে আসেন বা মোবাইল ফোনটাও বেজে ওঠে, তাহলে আসক্ত ব্যক্তির মেজাজ রুক্ষ হয়ে ওঠে।
বাস্তব জীবনে যে সমস্যাগুলো হয়
অনলাইনে সময় কাটানোর কারণে অনেক সময় পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাতে সময়মতো উপস্থিত হওয়া যায় না।  অন্যরা যখন অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ির পথ ধরে, তখনও আসক্ত ব্যক্তি ওই দিনের কাজ গুছিয়ে উঠতে পারেন না।  বাসার দৈনন্দিন কাজেও অবহেলা করতে শুরু করেন তিনি।  কাপড়টা হয়তো লন্ড্রিতে দেওয়া দরকার, দেওয়া হয় না।  প্রতিদিনের বাজার করতে বের হওয়া হয় না, ফলে যা আছে তা দিয়েই কোনোমতে রাতের খাবারটা হয়তো চালিয়ে নিতে হয় স্বামী কিংবা স্ত্রীর।  এভাবেই ব্যক্তি ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে বাস্তব সমাজ থেকে।  অন্যদিকে, ফেসবুক, টুইটার, মাইস্পেসের মতো সামাজিক ওয়েবসাইটগুলোতে তাঁর সরব পদচারণা।
সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে ব্যক্তির উপস্থিতি কমতে থাকে, পাশের বাড়ির বন্ধুর সঙ্গে বিকেলে আর ঘুরতে বের হওয়া হয় না, ‘অনলাইন’ বন্ধুরাই হয়ে ওঠে প্রিয় সঙ্গী।
অনেকেই এক সময় বুঝতে পারেন যে বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যাচ্ছে।  তারা ইন্টারনেটে কাটানো দৈনিক সময়ের পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু খুব একটা সফল হন না।
‘কতক্ষণ নেটে ছিলে ?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে সময় কমিয়ে বলেন কিংবা ‘কি করছিলে?’ -এর উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বা মিথ্যে বলতে শুরু করেন।  ইন্টারনেটে এই বাড়াবাড়ি রকমের সময়ক্ষেপণকে আমরা ‘আসক্তি’ বলব কেন?
অ্যাডিকশন (Addiction) বা আসক্তি তো একটি ব্যাধি।  ইন্টারনেটের কারণে ব্যক্তির এই পরিবর্তন কি ব্যাধি? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীর মতে, তা-ই।
‘আসক্তি’ আমরা কখন বলি? যখন মানুষ ভালো-মন্দ যাই হোক, কোনো কিছুর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।  তখন একধরনের ‘ডিপেনডেন্স’ (Dependence) বা নির্ভশীলতা তৈরি হয়।
সাথে সাথে তৈরি হয় টলারেন্স (Tolerance), এবং ‘টলারেন্স’ মানুষের জীবনের নানাক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে থাকে।  যেমন, আমরা বলে থাকি মাদকাসক্তির কথা। মাদক নেওয়ার পর ব্যক্তির মনে আনন্দের অনুভূতি হয়।  ধীরে ধীরে ব্যক্তি আনন্দের জন্য মাদকের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।  একই তীব্রতার আনন্দের অনুভূতির জন্য ধীরে ধীরে বাড়াতে হয় মাদকের পরিমাণ।  মাদক সংগ্রহ ও গ্রহণকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় ব্যক্তির চিন্তা ও দৈনন্দিন জীবন।  ধ্বংস হতে থাকে তাঁর শিক্ষাজীবন, ব্যর্থতা বাড়তে থাকে কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক জীবন বলতে কিছুই থাকে না আর।
একই ঘটনা আমরা দেখতে পাই ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও। ইন্টারনেট-আসক্তদেরও তৈরি হয় ‘টলারেন্স’।  প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়তে থাকে ইন্টারনেটে কাটানো সময়ের পরিমাণ।  মানসিকভাবে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তারা।  ‘সাইন-আউট’ করার পর থেকে মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরতে থাকে- কখন আবার ‘সাইন-ইন’ হবো, নেটে ঢোকার পর কী করবো? কীভাবে করবো ইত্যাদি।
বেশিক্ষণ অফ-লাইন থাকলে তাঁদের মধ্যে অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, খিটখিটেভাবসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়।
মাদকাসক্তদের যেমন কয়েক ঘণ্টা মাদক না নিলে দেখা দেয় শারীরিক-মানসিক নানা উপসর্গ বা ‘উইথড্রল সিম্পটম’- চলতি বাংলায় আসক্তরা যাকে বলে ‘ব্যাড়া ওঠা’। মাদক আবার গ্রহণ করলেই যেমন ‘উইথড্রল সিম্পটম’ চলে যায়, ইন্টারনেট-আসক্তরা তেমনি অনলাইন হলেই স্বস্তি বোধ করে।
অনেক মাদকাসক্ত যেমন বাস্তব জীবনের কষ্টকে ভুলে থাকতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মাদকের আশ্রয় নেয়, তেমনি এই ভার্চুয়াল জগতও বাস্তব থেকে পালিয়ে ফ্যান্টাসিতে বুদ হয়ে থাকার একটি মাধ্যম।
অন্য যে কোনো আসক্তির মতো ইন্টারনেট আসক্তিও মানুষের বাস্তব জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।  প্রথম যে সমস্যাটি দেখা দেয়, তা হলো স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, প্রিয়জন কিংবা বাস্তবের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি।  যেহেতু আসক্তরা দিনের বেশির ভাগ সময় একাকী ঘরে বসে কাটায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় ওয়েবে, তারা প্রিয়জনদের সময় দেয় কম।  এ নিয়ে ঝগড়া, বাক-বিতণ্ডা; আসক্ত ব্যক্তি তাঁর ইন্টারনেটে কাটানো সময় ও কাজের ব্যাপারে মিথ্যা বলা শুরু করে, এ নিয়ে দেখা দেয় পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট।
অনেক রাত জেগে নেটে-সার্ফিং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।  অনিদ্রা জন্ম দেয় আরও নানা শারীরিক-মানসিক উপসর্গের।  আগে যেসব কাজ করতে ভালো লাগতো, সেসব কাজে ব্যক্তি আর উৎসাহ পায় না।  ইন্টারনেট অনেকেই ব্যবহার করেন।  সবাই আসক্ত নন, সবাই আসক্ত হন না।  কারো কারো ক্ষেত্রে ইন্টারনেট তাঁদের কাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইন্টারনেট আসক্তি কেন হয়
ইন্টারনেট আসক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের ফ্রেমে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।  দৈনিক ‘কতো’ ঘণ্টার বেশি অনলাইনে থাকলে তা আসক্তি এরকম বলা যাবে না।  তবে, কেউ কেউ কাজের প্রয়োজন ছাড়াই বা কাজ ফেলে রেখে নেট সার্ফিং করতে থাকেন।
গবেষণায় দেখা গেছে- যারা বিষণ্নতা, উদ্বেগ, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার প্রভৃতি রোগে ভোগেন তাদের আসক্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
একাকীত্ব, অসুখী দাম্পত্য, পেশাগত চাপ, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, কর্মহীনতা, শারীরিক আকৃতি নিয়ে হীনমন্যতা, আত্মবিশ্বাসের অভাবও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে আসক্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
অধিকাংশ গবেষকই একমত যে, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা থেকে পলায়নমুখী মানসিকতাই আসক্তির জন্ম দেয়।  সেই সমস্যা হতে পারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাগত বা শিক্ষাগত।
আসক্তি অবশ্য ওই সমস্যার কোনো সমাধান নয়, তারপরও মানুষ সেখানে আশ্রয় খোঁজে।  অনেকে অন্য আসক্তি থেকে মুক্ত হতে গিয়ে (যেমন মাদকাসক্তি) ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়েন।  বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরী এমনকি শিশুদেরও এই আসক্তির ঝুঁকি রয়েছে।  যারা বাবা-মার তত্ত্বাবধান ছাড়া অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ পায়, তাঁদের আসক্তির ঝুঁকি বেশি।
বর্তমান যুগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মার চেয়ে ছেলে-মেয়েরা কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সম্পর্কে অনেক বেশি জ্ঞান রাখে।  এ কারণে বাবা-মা বুঝতে পারেন না তাদের ছেলে-মেয়েরা নেটে কখন কী করছে।  কিশোর-কিশোরী ও শিশুদের আসক্তির কারণ অনেকটা বড়দের মতোই। তবে, তারা মূলত অনলাইন গেমস ও সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতেই বেশি আসক্ত।
বয়ঃসন্ধির সমস্যা, স্কুলের চাপ, বিশৃঙ্খল বা কঠোর পারিবারিক পরিবেশ- প্রভৃতি ভুলে থাকতেই অনেকে নেটের আশ্রয় নেন।  বাবা-মা অনেক সময় এই আসক্তির ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না, যতক্ষণ না বাচ্চার আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে।  এর ফলে স্কুলে খারাপ ফলাফল হতে থাকে, বাচ্চারা সহজেই ক্লান্ত হয়ে যায়, তাদের শখের ব্যাপারগুলোতেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
যেভাবে আসক্তি থেকে মুক্ত হতে পারেন
আসক্তির প্রকৃতি যদি গুরুতর না হয়, তাহলে নিজে নিজেই এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।  অনেক ক্ষেত্রে আপনা-আপনি এ আসক্তি চলে যায়।  কিছু ক্ষেত্রে সক্রিয় প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে, আপনি যে আসক্ত এ ব্যাপারটি আপনাকে অনুধাবন করতে হবে।  যদি কেউ বুঝতে পারেন যে, তিনি আসক্ত, তবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাটি পার করে ফেললেন।
এরপর দেখুন, এই আসক্তির ফলে আপনি জীবনে কী হারাচ্ছেন বা মিস করছেন? ‘মিস করা’ বিষয়গুলোর একটি তালিকা তৈরি করুন। অনেক সময় না লেখা পর্যন্ত বোঝা যায় না, আপনি কতটুকু এবং কী হারাচ্ছেন।  আপনার ওয়েব সার্ফিংয়ের সময় নির্দিষ্ট করুন। প্রতিদিনই না হয় বসুন, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।  অ্যালার্ম ব্যবহার করুন।  অ্যালার্ম বেজে উঠলেই অফ লাইন হয়ে যান।  প্রতি রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কম্পিউটার বন্ধ করে ঘুমাতে যান এবং অবশ্যই তা মাঝরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর নয়।
ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বেরিয়ে আসুন, বন্ধু খুঁজুন বাস্তবে। পরিবার ও বাস্তব জীবনের বন্ধুদের সহায়তা এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। বাস্তবে আপনার বন্ধুর সংখ্যা যত বাড়বে, ভার্চুয়াল জগতে বন্ধুত্বের প্রয়োজন তত কম হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা
তবে, অনেকের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নিজের প্রচেষ্টায় এ আসক্তি থেকে মুক্তি লাভ কঠিন।  তাদের জন্য বিশেষজ্ঞ সহায়তার প্রয়োজন। কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপি, সাপোর্ট গ্রুপ, এমনকী নির্দিষ্ট আসক্তি চিকিৎসার বিশেষ প্রোগ্রাম দরকার হতে পারে।
সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমেরিকার ওয়াশিংটনে সিয়াটলের কাছে ‘হেভেনসফিল্ড রিট্রিট সেন্টার’ ইন্টারনেট-আসক্তদের চিকিৎসার জন্য এ বছরের অগাস্ট মাস থেকে বিশেষ আবাসিক চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু করেছে।  এটি সম্ভবত ইন্টারনেট-আসক্তদের জন্য প্রথম কোনো বিশেষায়িত আবাসিক চিকিৎসা ব্যবস্থা।
যদিও কোনো প্রমাণ নেই, তবুও ধারণা করা হয়, যখন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু তখন থেকেই ইন্টারনেট আসক্তিজনিত সমস্যার সূচনা। তবে এ বিষয়টি আলোচনায় আসে ১৯৯৫ সালে, ‘নিউইয়র্ক টাইমসে’ এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর।  ওই প্রতিবেদনে অন্যান্য আসক্তি যেমন, মাদক, জুয়া প্রভৃতির সাথে ইন্টারনেট-আসক্তির তুলনা করা হয়।  সেখানে কিছু স্বঘোষিত ইন্টারনেট আসক্তের বক্তব্যও ছাপা হয়।  নিক নামের এক ব্যক্তির উক্তি – ‘আমি বাকি দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, কিন্তু আমার কম্পিউটার, আমার ভার্চুয়াল জগত আমার হাতের মুঠোয়। ’
পরবর্তী বছরগুলোতে বিষয়টি নিয়ে আরো কিছু লেখা প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।  তবে, এ ব্যাপারে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা করেন ডা. ইয়াং, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনে তাঁর গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়। এরপর বিশ্বের নানা স্থানে গবেষকরা এই আসক্তির আশঙ্কাজনক চিত্র তুলে ধরেন।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার অ্যাডিকশন স্টাডি সেন্টারের পরিচালক মারিসা ওরজাকের মতে, ৫-১০ শতাংশ ওয়েব সার্ফারের মধ্যে ওয়েবের প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরি হয়।
monon-600
সিউলের হ্যানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আন ডং হিউনের মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রায় ৩০ শতাংশই ইন্টারনেট-আসক্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।  এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাইওয়ানে কলেজ ছাত্রদের মাঝে ৫.৯ শতাংশ ইন্টারনেট-আসক্ত।  অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, চীনের কলেজ ছাত্রদের মাঝে এ হার ১০.৬ শতাংশ।
২০০৮ সালে ‘আমেরিকান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জেরাল্ড জে ব্লক যুক্তি উপস্থাপনসহ ইন্টারনেট-আসক্তিকে ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়ালের (ডিএসএম) পঞ্চম সংস্করণে ‘ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডার’ নামে গুরুত্ব সহকারে আলাদা ‘ডিসঅর্ডার’ বা ‘ব্যাধি’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানান।
ভিন্ন মত
তবে, এর বিরুদ্ধ মতও রয়েছে।  ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত সময় ক্ষেপণকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ আলাদা ব্যাধি বলতে অনিচ্ছুক।  অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতে, ইন্টারনেট আসক্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ‘রোগ-নির্ণয়’ সংক্রান্তু সার্বজনীন অভিধানে স্থান পাওয়ার মতো স্বতন্ত্র কোনো ব্যাধি নয়, বরং অন্য কোনো রোগের একটি উপসর্গ।  যেমন, বিষণ্নতা, উদ্বেগজনিত রোগ, ইমপালস কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার প্রভৃতি রোগের একটি উপসর্গ হতে পারে এই ইন্টারনেট-আসক্তি।
স্বতন্ত্র কোনো ব্যাধি হিসেবে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ‘বাইবেলে’ ইন্টারনেট আসক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত হোক বা না হোক, ইন্টারনেটের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার যে গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা মানতে আপত্তি নেই কারো।  এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বাড়াচ্ছে আসক্তির ঝুঁকি।  সাবধান হতে হবে এখনই।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleডিপ্রেশনঃ রোগতো মানুষের হতেই পারে।
Next articleমানসিক রোগ নিয়ে ধারণা, ভুল ধারণা এবং বিবিধ-পর্ব ৬
ডা. মুনতাসির মারুফ
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here