আসুন নেশা করি; তবে সেটা হোক বই পড়ার নেশা-সুজন সরওয়ার

সহশিক্ষা কার্যক্রমের পুরস্কার হিসেবে শিক্ষার্থীদের বই উপহার দিতে সম্প্রতি এক আদেশ জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। তবে এই দাবি শুরু হয়েছিল আরও কয়েক বছর আগে। দাবিটি তুলেছিল রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দের ‘একজ’ নামের একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন । শুধু শির্ক্ষাথীদের বই প্রদানের দাবী নয়; তরুণ প্রজন্মের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি ও মানবিক জাতি গঠনে পাঠাভ্যাস তৈরি, বৃক্ষরোপন, পাখির অভয়ারণ্য সৃষ্টি, সাংস্কৃতিক চর্চা, জাতীয় দিবস পালন সহ রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক ইস্যুতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এই সংগঠনটি। আর এই সংগঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা সুজন সরওয়ার গোয়ালন্দের মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন কবিতার “আর্দশ ছেলে”। মনের খবর এর নিয়মিত আয়োজন তারকার মন বিভাগে কথা বলেছেন তরুণ প্রজন্মের এই অনুকরণীয় আর্দশ। পাঠকদের জন্য সেখান থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হল

মনের খবর: কেমন আছেন?
সুজন সরওয়ার: ভালো আছি।

মনের খবর: ভালো থাকার জন্য সবচেয় জরুরী কি বলে মনে করেন?
সুজন সরওয়ার: মনের উৎফুল্লতা, সজীবতা এবং ভালো কাজ করার ইচ্ছাশক্তিই ভালো থাকার জন্য সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে বলে আমার মনে হয়।

মনের খবর: একজ জাগরণে সম্পর্কে কিছু বলুন।
সুজন সরওয়ার: একজ মূলত জাগরণ মূলক কার্যক্রম করে থাকে। আমাদের সংগঠনের নাম একজ, আর জাগরণে হল আমাদের স্লোগান। আমরা আমাদের সচেতনতা মূলক কাজ দিয়ে সমাজকে একটু জাগরিত করতে চাই। ২০১০ সালে আবৃত্তি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা যাত্রা শুরু করি। সেটি এখন ঢাকার বাইরে অন্যতম বৃহৎ আবৃত্তির অনুষ্ঠান হিসেবে রুপ লাভ করছে। আমরা প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী জেলার সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আমাদের ইচ্ছা একসময় গোয়ালন্দে দেশের ৬৪ জেলা থেকে আবৃত্তির সংগঠন আসবে। ২০১১ সালে আমরা গোয়ালন্দ বাজার রেলস্টেশনে শতাধিক কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগিয়ে বৃক্ষরোপন কার্যক্রম শুরু করি। তারপর থেকে আমারা প্রতিবিছরই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সরকারি জমিতে বৃক্ষরোপন করে আসছি। সেখানে শুধু সৌর্ন্দয্যবর্ধনকারী গাছই না- ফলজ, বনজ, ঔষধি সব ধরনের গাছই আমরা লাগানোর চেষ্টা করি। ২০১৩ সাল থেকে আমার তালবীজ রোপন কর্মসূচি শুরু করেছি। এছাড়া প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষায় আমরা পাখির নিরপত্তায় বিভিন্ন কাজ করে থাকি। আমরা পাখির অভয়ারাণ্য তৈরির জন্য গাছে গাছে হাঁড়ি বেঁধে দিয়েছি। এছাড়া পাখি নিধন রোধে বড়দের মাঝে এবং শিশুদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন ধরণের প্রচারণা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা প্রতি সপ্তাহে পাঠচক্র করার পাশাপাশি জাতীয় দিবস পালন ও সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যুতে অংশগ্রহণ করি।  শিশুকিশোরদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার প্রচেষ্টা হিসেবে জাতীয় দিবসগুলিতে দোকান থেকে ফুলের ডালি না কিনে প্রতিবছরই নতুন নতুন কনসেপ্টে আমাদের সংগঠনের ছেলেমেয়েরা নিজে হাতে সেটি বানায়।

মনের খবর: এই ধরনের কাজের সিদ্ধান্ত কেন  নিলেন?
সুজন সরওয়ার: মূলত প্রকৃতি এবং সংস্কৃতির প্রতি প্রেম থেকেই শুরু করা। এর বাইরে রাজবাড়ির প্রতি প্রেম থেকেও বলা যেতে পারে।  রাজবাড়ি গোয়ালন্দ সর্ম্পকে অনেক ঐতিহ্যবাহী। কিন্তু কালের বির্বতনে সেটি নেগেটিভ প্রচার বেশি পাচ্ছির। এই জায়গা থেকে বের করে নতুন প্রজন্মকে রাজবাড়ির গোয়ালন্দ সম্পর্কে জানাতেই এই উদ্যোগ।

মনের খবর: বর্তমান সময়ে সৃষ্টিশীল কাজের চেয়ে মাদক কিংবা ইন্টারনেট আসক্তিতে তরুণ প্রজন্ম বেশি যুক্ত, সেক্ষেত্রে আপনাদের কার্যক্রম কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে?
সুজন সরওয়ার: সমাজকে মাদকমুক্ত করাই আমাদের অন্যতম একটি লক্ষ্য।আমরা বিশ্বাস করি ভালো কাজ দিয়েই মাদককে মোকাবিলা করতে হবে।যখন কোন কিশোর বা তরুণের ভেতরে আমরা বইয়ের নেশা দিতে পারবো, সংস্কৃতি চর্চার নেশা দিতে পারবো, বৃক্ষ রোপণের নেশা দিতে পারবো, পাখি রক্ষার নেশা ঢুকিয়ে দিতে পারবো, খেলার নেশা ঢুকিয়ে দিতে পারবো তখন কিন্তু সে আর মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হবে না।  আমাদের একটা স্লোগানই ছিল আসুন নেশা করি: তবে সেটা হোক বই পড়ার নেশা। আর ইন্টারনেট আসক্তির কথা যদি বলি তবে- প্রযুক্তির ভালো খারাপ দুটোই আছে। আমাদের খারাপ দিক বর্জন করে ভালো দিক গ্রহণ করতে হবে। কোন কিছুরই অতিরিক্ত ভালো না। ফেসবুক বা অন্যান্য কোন সোশ্যাল মিডিয়ারই অতিরিক্ত ব্যবহারের পক্ষে আমি না। তবে এগুলি ব্যবহার করে আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি প্রচারের পক্ষে আমি।

মনের খবর: শিশুবান্ধব সমাজ গঠনের জন্য কি করা দরকার বলে মনে করেন?
সুজন সরওয়ার: শিশুবান্ধব সমাজ গঠনের জন্য সরকারকেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশু অধিকার যেগুলি রয়েছে, সেগুলি বাস্তবায়ন করলেই শিশুবান্ধব সমাজ গঠন হয়ে যাবে।

মনের খবর: পেশাগত জীবনে আপনি কি করছেন?
সুজন সরওয়ার: আমি মাস্টার্স শেষ করে চাকরি খোঁজার চেষ্টা করিনি। আমার ইচ্ছা আধুনিক কৃষক হওয়ার।

মনের খবর: কাজ করতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন কিনা, সেসময়ে সৃষ্ট মানসিক চাপ কিভাবে মোকাবিলা করেছেন?
সুজন সরওয়ার: সব ভালো কাজেই কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকে। বিশেষ করে আমাদের দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সংঘবদ্ধ হয়ে সামাজিক সংগঠন করতে গেলেও কিছু বাধা পেতে হয়। কিন্তু সমাজে খারাপ মানুষ যেমন আছে, ভালো মানুষও তো আছে। বরং ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। এইসব ভালো মানুষেরাই সেইসব চাপ মোকিবিলা করতে সাহায্য করেছেন। আর যেকোন প্রতিবন্ধকতাই তো মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। তবু সমজের উন্নয়নে কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে। তারুণ্যই পারে সকল প্রতিবন্ধতা মোকাবিলা করতে। আমিও তারুণ্য দিয়েই সেসব মানসিক চাপ মোকাবিলা করেছি।

মনের খবর: রাগ, ক্ষোভ, অভিমান এই ব্যাপারগুলি আপনার মধ্যে কিরকম আছে?
সুজন সরওয়ার: রাগ, ক্ষোভ, অভিমান সবার মধ্যেই কম বেশি থাকে। আমার মধ্যেও আছে। তবে আমার ভেতরে রাগ কিংবা ক্ষোভ তৈরি হয় সমাজ কিংবা দেশের অসংগতি, অন্যায় এবং অত্যাচার দেখলে। আমরা একটা সুস্থ সুন্দর সমাজে গঠনের জন্য কাজ করছি, সেটা হচ্ছে না দেখলে রাগ হয়।

মনের খবর: রাগ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন?
সুজন সরওয়ার: রাগ হলে আমি নিজেদের ভালো কাজগুলির দিকে তাকাই। নিজেদের লাগানো কৃষ্ণচূড়ার নিচে এসে দাঁড়িয়ে যখন দেখি ফুলগুলি আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিংবা কোন গাছে পাখি নিরাপদে বসে আছে, এসব দেখলে রাগ, ক্ষোভ এমনিতেই কমে আসে।

মনের খবর: মন খারাপ হয়? হলে ভালো করার জন্য কি করেন?
সুজন সরওয়ার: মন খারাপ তো হয়ই।আমি যেরকমভাবে সব কিছু দেখতে চাই, সেভাবে না হলে মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলে আবৃত্তি শুনি, গান শুনি, প্রকৃতির সাথে সময় কাটাতে চেষ্টা করি, নদীর পাড়ে বসি। প্রকৃতি মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে দিয়ে যায়।

মনের খবর: স্বপ্ন এবং ভালোবাসা  এই বিষয়গুলিকে কিভাবে দেখেন?
সুজন সরওয়ার: ভালোবাসা ছাড়া কোন কিছুই অর্জন করা সম্ভব না। যে স্বপ্ন দেখতে জানে না তার দ্বারাও কোন সাফল্য অর্জন করা সম্ভব না। ভালোবাসাটা অনুভব করি আর স্বপ্ন তো প্রতিদিনই দেখি। দিন বদলের স্বপ্ন দেখি। আমি বিশ্বাস করি। ভালো কিছু করতে হলে স্বপ্ন এবং ভালোবাসা দুটির সমন্বয় ঘটিয়েই করতে হবে।

মনের খবর: আপনি এখন কি কি স্বপ্ন দেখেন?
সুজন সরওয়ার: আমার এখন সেবচেয়ে বড় স্বপ্ন গোয়ালন্দে খুব বড় একটি লাইব্রেরি হবে। সেখানে লক্ষ, লক্ষ বই থাকবে। গোয়ালন্দ আবৃত্তির র্তীথভূমি হবে, এখানে সারাদেশের ৬৪ জেলা থেকে আবৃত্তিকাররা আসবেন। গোয়ালন্দের প্রতিটা ছেলেমেয়ে বইপ্রেমী হবে, প্রতিটা ছেলেমেয়ে পাখি প্রেমী হবে। সমাজে শিশুশ্রম বন্ধ হবে, সমাজ দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত হবে। এসব স্বপ্নই আমি এখন দেখি।

মনের খবর: মনের খবরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সুজন সরওয়ার: মনের খবরকেও ধন্যবাদ। দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টিতে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছি।

Previous articleবিএসএমএমইউ মনোরোগবিদ্যা বিভাগের জুলাই মাসের বৈকালিক সেবা সময়সূচি
Next articleমাঠ থেকে ডিভাইস: মানসিক বিস্তার নাকি বিকলাঙ্গতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here