গত কয়েক বছরে দেশে আত্মহত্যার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন জনপ্রিয় অভিনেতা, অভিনেত্রী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সরকারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্কুল পড়ুয়া শিশুও। গবেষণা বলছে, প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনাকে প্রতিরোধ করা না গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটিকে অবশ্যই প্রতিরোধ করা যায় তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য।
কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? যাপিত জীবনটি কেন বোঝা হয়ে দাঁড়ায় এসব মানুষের কাছে?- এ প্রশ্ন নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী আর মনোচিকিৎসকদের গবেষণার শেষ নেই। তারপরও প্রতি বছর বিশ্ব জুড়ে আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে আত্মহত্যার হার। নিঃস্ব হওয়ার যাতনা আর আশাহত হওয়ার বেদনা থেকে রেহাই পেতে আত্মহননের পথ বেছে নেয় কেউ কেউ, কিন্তু তাতে কি রেহাই হয়? ভালোবেসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে মুক্তির স্বাদ যারা পেতে চায় তাঁরা তো আসলে পরাজিত হয় নিজের কাছেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বর্তমানে গায়ানা, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায় (যথাক্রমে বছরে এক লাখে ৪৪ জন, ৩৮ জন ও ২৯ জন) আত্মহত্যার হার সবচাইতে বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় আত্মহত্যার প্রবণতা (বছরে এক লাখে ২৯ জন ) সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে আত্মহত্যা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোন জরিপ না হলেও বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে প্রতি বছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন, প্রতিদিন ২৮ জন! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রতি লাখের মধ্যে ৭.৮ জন আত্মহত্যা করে। পৃথিবীতে সবচাইতে কম মানুষ আত্মহত্যা করে মিশর, জর্ডান ও হাইতিতে (প্রতি বছর লাখে ০.০ থেকে ০.১জন )।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা, ২০২০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে আত্মহত্যার হার দেড়গুণ বেড়ে যাবে। চীনের সভ্যতার ইতিহাসে বুদ্ধবাদ ও কনফুসিয়াসবাদের আলোকে আত্মহত্যাকে নিরুৎসাহিত করা হলেও রাজনৈতিক প্রতিবাদ স্বরূপ এক সময় বহু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। চীনের জনপ্রিয় সাহিত্যিক প্যান-ইউ-অ্যান ও সুই-কি রচিত ‘A Dream of Red Mansions’-এ আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করে দেখানোর পর চীনে আত্মহত্যা হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল। ষাটের দশকে চীনে সংস্কৃতি বিপ্লবকালীন সময়ে ‘রেডগার্ড’ বাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদে সে সময়ের নামকরা সাহিত্যিক লাও-সে ও সাংবাদিক ফ্যান-চ্যানজিয়াং সহ অনেকেই আত্মহত্যা করেন। বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে চীনে নারীদের বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে।
ভারত ও শ্রীলঙ্কায় আত্মহত্যার সাধারণ কারণগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ‘মানব-বোমা’ হিসেবে আত্মহত্যা করা। জাপানে কোন লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি যাতে হতে না হয় সেজন্য আত্মহত্যাকে বেছে নেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ অনেকেই। বছরে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ জাপানে আত্মহত্যা করে থাকেন। ইউমিউরি শিনবুন পত্রিকার ভাষ্যমতে ২০০৭ সালে ২৭৪ জন স্কুলগামী শিশু আত্মহত্যা করেছে কেবলমাত্র পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য তাদের বাবা-মায়ের অতিরিক্ত চাপের কারণে!
স্বাতন্ত্রবাদের উত্থান, পারিবারিক বন্ধন কমতে থাকা এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ইউরোপের বহুদেশে আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ। রাশিয়ান কনফেডারেশনগুলোতে বিশেষত লিথুনিয়া ও বেলারুশে অর্থনৈতিক মন্দা, জাতিগত সংঘাত ও রাজনৈতি অস্থিতিশীলতার কারণে আত্মহত্যা হার হঠাৎ করে ক্রমবর্ধমান। প্রচার মাধ্যমগুলোতে সংবাদ পরিবেশনের কারণেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে পারে।
পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশী হলেও বাংলাদেশ ও চীন সহ গুটিকয়েক দেশে নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। বিভিন্ন গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট আত্মহত্যার মধ্যে ৫৮ থেকে ৭৩ শতাংশই নারী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে আত্মহত্যার কারণও ভিন্ন।
ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম (Émile Durkheim) তাঁর এক বিখ্যাত গবেষণায় যারা আত্মহত্যা করে বা করতে চায় তাদের চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। ১. আত্মশ্লাঘায় পূর্ণ ব্যক্তি (egoistic), যারা সবসময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সামাজিকতা এড়িয়ে চলে, তারা নিজের সবকিছু নিয়ে অহংবোধে ভোগে। ২. পরার্থবাদী (altruistic), যাদের সামাজিক সম্পৃক্ততা খুব বেশি। ৩. আত্মপরিচয়হীন (anomic), যারা সামাজিক রীতি-নীতির ধার ধারে না, যাদের কোন স্বকীয় পরিচয় এবং কোন সামাজিক বন্ধন নেই। ৪. অদৃষ্টবাদী (fatalistic), যারা সবসময় অদৃষ্টের উপর নির্ভর করে এবং খুব কঠোরভাবে সামাজিক নিয়ম কানুন মেনে চলে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে ক্ষুব্ধ হয়।
সাধারণত তিন ধরনের আত্মহত্যা ঘটে থাকে- ক) আকস্মিক বা আবেগপ্রবণ আত্মহত্যা (impulsive)- হুট করে রেগে গিয়ে বা হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে মরে যেতে চাওয়া এবং কোন পরিকল্পনা ছাড়াই ঝোঁকের বশে মৃত্যুচেষ্টা করা। যেমন, ঝগড়া করতে করতে হঠাৎ ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়া বা কোন মানসিক রোগীর কারণ ছাড়াই আত্মহত্যার চেষ্টা করা। খ) নির্ধারিত (DEFINITIVE) আত্মহত্যা- ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যাদের মধ্যে আত্মহত্যার সম্ভাবনা রয়েছে তারা তাদের ব্যক্তিত্ব ও আচরণের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা ধারণ করেন। গ) সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিকল্পিত (decisive and planned) আত্মহত্যা- এক্ষেত্রে যিনি আত্মহত্যা করতে চান তিনি দীর্ঘ সময় ধরে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেন, উপকরণ সংগ্রহ করেন এবং আটঘাট বেঁধে, সুইসাইডাল নোট লিখে রেখে আত্মহত্যা করতে চান।
শেষ ধরণটিতে সাধারণত আত্মহত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয় না। কখনও কখনও দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে অথবা দারিদ্র্যের কারণে একই পরিবারের কয়েকজন বা একই সম্প্রদায়ের একাধিক ব্যক্তি একসাথে আত্মহত্যা করেন তখন এটাকে বলা যায় ‘সংঘবদ্ধ আত্মহত্যা’। আবার কোন রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বা যুদ্ধকালীন সময়েও কোন কোন সময় আত্মহত্যা ঘটতে পারে। নগরায়ণ, শিল্পায়নের প্রভাব, স্বাতন্ত্রবাদের উত্থান, পারিবারিক বন্ধন কমতে থাকা এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ইউরোপের বহুদেশে আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে গেলে আবারও বলতে হয় যে এদেশে নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ও হার বেশি। বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিভিন্ন গবেষণায় যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা হলো-
· যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন: যৌতুকের জন্য শ্বশুর বাড়িতে গঞ্জনা ও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রতি বছর বহু নারী এদেশে আত্মহত্যা করে থাকেন। নিতান্ত দরিদ্র গ্রামের নারী থেকে শুরু করে শহুরে উচ্চশিক্ষিত নারীরাও যৌতুকের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
· দাম্পত্য কলহ: যৌতুক ছাড়াও নানা কারণে দাম্পত্য কলহ এবং পরকীয়া প্রেমের কারণে বাংলাদেশে নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই আত্মহত্যার মত ঘটনা ঘটে থাকে।
· উত্যক্ত করা ও প্ররোচিত আত্মহত্যা: অল্পবয়সী স্কুল কলেজগামী ছাত্রী এবং তরুণীদের নানাভাবে উত্যক্ত করে, প্রতারণা করে এবং সামাজিক ভাবে হেয় করে তাদেরকে আত্মহত্যার জন্য অনেক সময় প্ররোচিত করা হয়।
· প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা: প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কিংবা পরীক্ষায় ফেল করে প্রতি বছর অনেক নারী-পুরুষ এদেশে আত্মহত্যা করে থাকে। এই প্রেমে ব্যর্থ হওয়া বা পরীক্ষায় ফেল করে যারা তীব্র বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন বা হীনমন্যতায় ভোগেন তারাই আত্মহত্যার পথ গ্রহন করেন। আবার প্রেমে প্রতারিত হয়ে বা অযাচিত গর্ভ ধারণের কারণেও আত্মহত্যা হয়ে থাকে।
· দারিদ্র ও বেকারত্ব: অর্থ কষ্ট আর বেকারত্বের কারণে এ দেশে আত্মহত্যার নজির অনেক রয়েছে।
· আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা: আত্মহত্যার যতগুলো উপকরণ রয়েছে তার প্রায় সবই আমাদের দেশে সহজপ্রাপ্য। কেবলমাত্র আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া বাকি সকল উপকরণ (কীটনাশক, স্লিপিং পিল ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণের তেমন কোন জোরালো ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই। বহুতল ভবনগুলোর ছাদ কিংবা জানালাগুলোতেও নেই পর্যাপ্ত নিরাপদ পদ্ধতি। ট্রেন লাইনগুলোও থাকে উন্মুক্ত।
· মানসিক অসুস্থতা: এদেশে ১৬.১% মানুষ কোনো না কোনো মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত। এই মানসিক অসুস্থদের এক বিরাট অংশ রয়েছেন আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে। বিশেষত বিষণ্ণতা, মাদক নির্ভরতা, সিজোফ্রেনিয়া, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, তীব্র মানসিক চাপ ইত্যাদি রোগে যারা ভুগছেন তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি।
· জটিল শারীরিক রোগযন্ত্রণা থেকে আত্মহত্যা: সংখ্যায় নগণ্য হলেও কোনো কোনো সময় জটিল শারীরিক রোগে ভুগতে ভুগতে কেউ কেউ আক্রান্ত হন তীব্র বিষণ্ণতায়। এবং এক পর্যায়ে রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করে ফেলেন।
· নগরায়ণ ও পরিবারতন্ত্রের বিলুপ্তি: অস্বাভাবিক দ্রুত হারে নগরায়ণ ঘটছে এদেশে। আর এই নগরায়ণের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না দ্রুত নগরায়ণের শিকার মানুষগুলো- তাই এক নিদারুণ অস্তিত্বের সংকটে থাকতে থাকতে কখনও আক্রান্ত হচ্ছে মানসিক রোগে আবার কখনও ঘটিয়ে ফেলছে আত্মহত্যার মত দুঃখজনক ঘটনা।
(চলবে…)
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।