আত্মহত্যা: গণমাধ্যমে প্রচার কেমন হওয়া উচিত

আমাদের সমাজে আত্মহত্যা একটি অন্যতম সমস্যা। কিছুদিন আগে ‘ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক উন্মাদনা বয়ে গেল। একদিকে ‘হিট কামানো মিডিয়া’ সে সময়ের সব আত্মহত্যাকে ব্লু হোয়েলের দিকে ঠেলে দিতে থাকে, অপরদিকে দায়িত্বশীল মিডিয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না, তাদের আসলে কী করা উচিত! এসব আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করা উচিত, নাকি উপেক্ষা করা উচিত! অথচ আত্মহত্যার খবর প্রচার করা নিয়ে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) নির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। সেই গাইডলাইন নিয়েই আজকের আলোচনা। পৃথিবীজুড়ে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে এবং প্রতিটি আত্মহত্যার সঙ্গে আরো কমপক্ষে ৬ জন ব্যক্তি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতি যেমন মানসিকভাবে ঘটে, তেমনি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবেও ঘটে! আত্মহত্যার পেছনে কিংবা আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য আসলে কী কী ফ্যাক্টর ভূমিকা রাখে, সেটা এখনো পরিষ্কারভাবে আমাদের কাছে ধরা দেয়নি। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধের চেষ্টায় মিডিয়া যেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, তেমনি মিডিয়ার কারণেই সেটা ক্ষতিগ্রস্তও হতে পারে।
কোনো একটি আত্মহত্যার খবর প্রচার করতে গিয়ে যদি রিপোর্টে সেই আত্মহত্যা প্রক্রিয়ার বিশদ, পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং উত্তেজনাপূর্ণ বর্ণনা প্রদান করা হয়; কিংবা আত্মহত্যা সম্পর্কিত মিথগুলোর প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিথিলতা দেখানো হয়, কিংবা যথেষ্ট শক্তভাবে সেসব মিথ প্রতিরোধ করা না হয়, তবে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিরা এমন রিপোর্ট দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারে। আত্মহত্যার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে, আত্মহত্যায় উৎসাহিত হতে পারে। এমনটা বেশি দেখা যায় আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি সমাজে সুপরিচিত বা জনপ্রিয় কেউ হয়ে থাকলে। মিডিয়া রিপোর্ট দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আত্মহত্যা করার এই প্রবণতাকে ‘ওয়ের্দার ইফেক্ট’ বলা হয়। অপরদিকে আত্মহত্যা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল রিপোর্টিং লোকজনকে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহায্য করতে পারে। যারা আত্মহত্যাপ্রবণ তাদেরকে অন্য কোনো উপায়ে তাদের সমস্যা মোকাবেলা করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আত্মহত্যা থেকে ফিরে আসার ঘটনাগুলো অন্যকেও অনুপ্রাণিত করতে পারে। অন্যকে দেখে যেমন কেউ আত্মহত্যা করতে পারে; আবার অন্যের সরে আসার ঘটনা দেখে সেও সরে আসতে পারে।
আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিরা কোথায় গেলে সাহায্য পেতে পারে, বিভিন্ন ‘সুইসাইড সাপোর্ট হটলাইন’ সম্পর্কিত তথ্যাদি অবশ্যই মিডিয়া রিপোর্টে থাকা উচিত। মিডিয়ার এমন দায়িত্বশীল আচরণে ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষ যে আত্মহত্যা থেকে সরে আসার জন্য অনুপ্রাণিত হয়, তাকে ‘পাপাগেনো ইফেক্ট’ বলা হয়। মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া আর ডিজিটাল মিডিয়ার পার্থক্যটা বিবেচনা করা উচিত। ডিজিটাল মিডিয়ায় তথ্যগুলো প্রচন্ড দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে যায়, সেখানকার খবরগুলো নিয়ন্ত্রণ করা ভীষণ কঠিন; তাই এক্ষেত্রে অধিক সতর্ক থাকা উচিত। আত্মহত্যা সম্পর্কে দায়িত্বশীল রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে কী কী করণীয় আর কী কী বর্জন করা উচিত, ডব্লিউএইচও-এর গাইডলাইনের আলোকে আলোচনা করা হলো।
করণীয়

  • কোথায় সাহায্য পাওয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কিত সঠিক তথ্যগুলো রিপোর্টে উল্লেখ করতে হবে। প্রতিটা রিপোর্টের শেষে আত্মহত্যা প্রতিরোধ প্রতিষ্ঠানগুলো, হেল্পলাইনের টেলিফোন নম্বর, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও প্রফেশনালদের ঠিকানা এবং সহায়তাকারী বিভিন্ন গ্রুপের সঠিক তথ্য প্রদান করতে হবে।
  • রিপোর্টে মিথ না ছড়িয়ে আত্মহত্যা সম্পর্কিত সঠিক তথ্য ও আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায়গুলো উল্লেখ করে জনগণকে সতর্ক করতে হবে। আত্মহত্যা নিয়ে জনমনে নানারকম মিথ চালু আছে। এসব মিথ মিডিয়ায় এলে সেগুলো আরো প্রচার পাবে। অপরদিকে সঠিক তথ্যগুলো যত বেশি বেশি প্রচার পাবে, সাধারণ মানুষ একটু একটু করে হলেও সেগুলো জানতে পারবে এবং সতর্ক হবে।
  • জীবনের বিভিন্ন চাপ বা সমস্যাদি কিংবা আত্মহত্যার চিন্তা-ভাবনাগুলোকে কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে, সে সম্পর্কে রিপোর্ট করতে হবে। যেসব মানুষ আত্মহত্যার চরম মুহূর্ত থেকে ফিরে এসেছে, তাদের ব্যক্তিগত গল্পগুলো অন্যদেরকেও ফিরে আসতে সাহায্য করবে। মানুষেরা তাদের সমস্যাগুলো যেভাবে সমাধান করেছে, সেই ঘটনাগুলো একই রকম সমস্যায় পড়লে অন্য কোনো মানুষকে সাহায্য করতে পারে।
  • জনপ্রিয় ব্যক্তিদের আত্মহত্যার খবর প্রচার করার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেহেতু এই খবরগুলো অন্যান্য আত্মহত্যাপ্রবণ সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। জনপ্রিয় ব্যক্তিদের আত্মহত্যার খবরগুলো সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে। এই ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে যদি যথেষ্ট কথা বলা না হয় এবং এদের প্রতি যদি শিথিলতাপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ পায়, তবে জনসাধারণ আত্মহত্যার প্রতি আকৃষ্ট হবে।
  • আত্মহত্যাজনিত কারণে স্বজন হারানো মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় ভীষণ সতর্ক থাকতে হবে। যাতে তারা সাক্ষাৎকারের দরুন কোনোরূপ কষ্ট না পায়। আবার তাদের ওই মুহূর্তের অনুভূতি বাকিদেরকে সচেতন করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে কাজে লাগতে পারে।
  • মিডিয়ার ব্যক্তিরা নিজেরাও যে আত্মহত্যার রিপোর্ট করতে গিয়ে আক্রান্ত হতে পারেন, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। কোনো একটি রিপোর্ট করতে গিয়ে তাদের নিজেদের কোনো অনুভূতি অনুরণিত হতে পারে, যেটা তাদেরকে আত্মহত্যার পথে নিয়ে গেলেও যেতে পারে। সুতরাং এই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

বর্জনীয়

  • আত্মহত্যা বিষয়ক খবরগুলো বিস্তারিতভাবে বা স্পষ্টরূপে প্রকাশ করা কিংবা অসঙ্গতভাবে সেসব খবর পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না। আকর্ষণীয় স্থানে বা প্রথম পৃষ্ঠায় আত্মহত্যার খবরগুলো উপস্থাপন করলে কিংবা অযথা সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করলে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিরা তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারে।
  • এমন কোনো শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করা যাবে না, যেটা আত্মহত্যার মতো গর্হিত কাজকে রোমাঞ্চকর করে তোলে কিংবা জীবনের সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে আত্মহত্যাকে একটি স্বাভাবিক উপায় হিসেবে প্রকাশ করে।
  • কী উপায়ে আত্মহত্যা করা হয়েছে, সেটা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা যাবে না।
  • যে স্থান বা ঠিকানায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেটার বিস্তারিত উল্লেখ করা যাবে না।
  • রোমাঞ্চকর শিরোনাম ব্যবহার করা যাবে না। ছবি, ভিডিও বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো লিংক সরবরাহ করা যাবে না।

আত্মহত্যার রিপোর্টের প্রভাব, সায়েন্টিফিক প্রমাণ আত্মহত্যার খবর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আত্মহত্যা করা বা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠা নিয়ে শতাধিক সায়েন্টিফিক অনুসন্ধান হয়েছে। এগুলো থেকে জানা যায়, অন্যের আত্মহত্যা দ্বারা তথা মিডিয়া প্রচারিত আত্মহত্যার খবর দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ার ঘটনা প্রচুর ঘটে। আত্মহত্যা করা মানুষটির অবস্থা বা জীবনের সমস্যা, যেটার কারণে সে আত্মহত্যা করেছে; সেটা যদি ওই খবরের পাঠকের সঙ্গে মিলে যায়, তবে খবর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। সে কারণেই আত্মহত্যার খবরে বিস্তারিত বর্ণনা দিতে না করা হয়। বরং খবরে যদি সেই সমস্যাটি মোকাবেলার উপায় সম্পর্কে লেখা হয় এবং আত্মহত্যার বিরুদ্ধে বলা হয়, তবে পাঠক নিজেকে নিয়ন্ত্রণের দিকে তাড়িত হবে। মিডিয়ার প্রভাবে আত্মহত্যার প্রতি ধাবিত হওয়া নিয়ে যেমন প্রচুর গবেষণা হয়েছে, তেমনি সৃজনশীল রিপোর্ট কি আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে- সেটা নিয়েও বেশ গবেষণা হয়েছে। যদিও এ সংক্রান্ত গবেষণার হার সাম্প্রতিক সময়েই বেশি। অতীতে এ নিয়ে খুব একটা কাজ হয়নি। সাম্প্রতিক এসব গবেষণা এটাই দাবি করে যে, আত্মহত্যার বিষয়ে মিডিয়ার রিপোর্টের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাবই রয়েছে।
ডিজিটাল মিডিয়ার করণীয়
ডিজিটাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন। শুধু নিউজ পোর্টালই না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও তথ্য বা খবর প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব প্ল্যাটফর্মে তথ্য শেয়ারের ক্ষেত্রে তাই অধিক সচেতন থাকা উচিত। কোনোভাবেই ঘটনার ছবি বা ভিডিও শেয়ার করা কিংবা এসব সংবলিত লিংক সরবরাহ করা যাবে না। সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশনের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক শব্দগুলো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। নিউজ পোর্টাল বা মিডিয়ার অধিক সচেতনতা ও তৎপরতা দেখাতে হবে কমেন্ট সেকশন মনিটর করা ও ক্ষতিকর কমেন্টগুলো মুছে ফেলার ক্ষেত্রেও। গণহত্যা ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম রিপোর্টের ক্ষেত্রে করণীয় এসব ঘটনা সবসময়ই মিডিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে এবং মিডিয়ায় যদি এগুলো বেশ রোমাঞ্চকরভাবে উপস্থাপিত হয়, তবে তা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য একই ধরনের ঘটনাকে উদ্বুদ্ধ করবে। শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ‘আত্মঘাতী বোমা হামলা’ যেহেতু নিজেকে হনন করার জন্য না বরং সাধারণ মানুষকে হত্যা করার জন্য করা হয়, সুতরাং একে আত্মঘাতী না বলে গণহত্যা করার উদ্দেশ্যে বোমা হামলা বলাই বাঞ্ছনীয়। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যুগে, যেখানে ইন্টারনেটের বদৌলতে তথ্যের অবাধ সরবরাহ, সেখানে দায়িত্বশীল রিপোর্টিংয়ের প্রচলন শুরু হয়েছে বেশি দিন হয়নি। অল্প করে এর ফল পাওয়া শুরু হলেও আরো বহুদূর যেতে হবে। শুধু পেশাগত দায়িত্বের জন্যই নয়, ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কে জনগণের জানার অধিকার সংরক্ষণ করার জন্যও দায়িত্বশীল রিপোর্টিংয়ের বিকল্প নেই।
লেখক: ফিরোজ শরিফ 
মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, বর্ষ-১, সংখ্যা-২।

Previous articleবিএসএমএমইউ মনোরোগবিদ্যা বিভাগের মার্চ মাসের বৈকালিক সেবা সময়সূচি
Next articleঅফিসে প্রবল কাজের চাপ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here