আক্রমণাত্মক মানসিক রোগী নিয়ন্ত্রণে পরিবারের ভূমিকা

আক্রমণাত্মক মানসিক রোগী নিয়ন্ত্রণে পরিবারের ভূমিকা

মানসিক রোগসমূহকে আমরা প্রধানত লঘুতর মানসিক রোগ (Neurosis) ও গুরুতর মানসিক রোগ (Psychosis), এ ‍দুইভাগে বিভক্ত করতে পারি। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের মধ্যে প্রায় আঠারো শতাংশ, আর ১৮ বছরের ওপরে যাদের বয়স তাদের মধ্যে প্রায় সতেরো শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিনকোটিরও বেশি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে গুরুতর মানসিক রোগী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় সাত শতাংশ মানুষ। আর গুরুতর মানসিক রোগের একটি সাধারণ উপসর্গই হচ্ছে আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী বা হিংস্র আচরণ।

আক্রমণাত্মক রোগী যারা মূলত গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত, তাদের অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে অহেতুক সন্দেহপ্রবণতা, অবাস্তব চিন্তাভাবনা, ভ্রান্ত বিশ্বাস, অলীক অনভূতি, অসংলগ্ন কথাবার্তা, অসংলগ্ন আচরণ‚ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ সকল রোগীদের মধ্যে এমন ধরনের বিশ্বাস সষ্টি হয় যার কোনো ভিত্তি নেই। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, তিনি মহাপুরুষ বা অনেক ক্ষমতাধর এবং তিনি অসম্ভবকেও সম্ভব করতে সক্ষম।

রোগীর মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস সংক্রান্তও কিছ ভ্রান্ত ধারণার সষ্টি হয়। নিজেকে অনেক সময় তারা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন। আবার কোনো ভিত্তি ছাড়াই অনেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, তার নিজের বাবা-মা, স্বামী বা স্ত্রী, বন্ধু, পরিজন অথবা কোনো প্রতিষ্ঠান তার ক্ষতির চেষ্টা করছে, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা কিংবা পরিকল্পনা করছে, এমনকি তাকে মানসিক রোগী বানাতে চেষ্টা করছে। আর এসকল কারণেই রোগীদের আচরণ স্বাভাবিক থাকে না। বাস্তবতার সঙ্গেও অনেক সময় তাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। কাজেই এসব রোগীরা কখনো নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করার জন্য আবার কখনো নিজেকে অলীক শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আক্রমণাত্মক আচরণ করে থাকেন। মূলত সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia), বাইপোলার ডিজঅর্ডার (Bipolar disorder), ব্যক্তিত্বের সমস্যা (Personality disorder), মাদকাসক্তি (Substance related and addictive disorders), বুদ্ধি প্রতিবন্ধী (Intellectual disability), অটিজম (Autism spectrum disorder) ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত রোগীরা ভয়ংকর, আক্রমণাত্মক ও আগ্রাসী আচরণ করেন। এসব আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী বা হিংস্র আচরণকারী রোগীদের মূলত দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সকল আক্রমণাত্মক রোগীকে হাসপাতালে রেখে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করার মতো অবকাঠামো এখনো আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। অনেক সময় অভিভাবকরাও রোগীদেরকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে অনিচ্ছক থাকেন। তাই পরিবারের মধ্যে রেখেই বেশিরভাগ সময় এসব রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। তাই আক্রমণাত্মক রোগীদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক ক্ষেত্রে ‍কুসংস্কারের কারণে এসব মানসিক রোগীরা ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া, তেল পড়া, পানিতে চুবানো, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা ও বিভিন্ন কবিরাজি চিকিৎসার শিকার হন। আবার পরিবার পরিজন দ্বারাও কিছু উস্কানিমূলক আচরণের (ব্যঙ্গ করা, অবহেলা করা, শারীরিক অত্যাচার ইত্যাদি) শিকার হন তারা।

তাই ‍কুসংস্কার আর অপচিকিৎসার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে এসব আচরণকে রোগের উপসর্গ বিবেচনা করে পরিবারের সদস্যদের ধৈর্যের সঙ্গে নিম্নলিখিত উপায়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন :

  • আক্রমণাত্মক রোগীদের সঙ্গে নরমভাবে কথা বলতে হবে ও বোঝাতে হবে যে, তাদের কথাগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
  • উস্কানিমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • আক্রমণাত্মক অবস্থায় রোগীকে উত্তেজিত করা যাবে না।
  • অবাস্তব জেনেও রোগীর স্বার্থে রোগীর মনোভাবকে গুরুত্ব দিতে হবে।
  • রোগীদের কলঙ্কিত (Stigmatized) করা যাবে না।
  • যে মানুষগুলো মানসিকভাবে অসুস্থ তাদের কথা তাদের অবস্থান থেকেই বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
  • রোগী তার মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালেও পরিবারের সদস্যের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
  • আক্রমণাত্মক অবস্থায় রোগীকে যুক্তিতর্ক দিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করা যাবে না বরং রোগীকে নিজের মতো করে কথা বলতে দিতে হবে।
  • রোগীর পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম ও সুষম খাবার নিশ্চিত করতে হবে।
  • আক্রমণাত্মক অবস্থায় রোগী থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
  • রোগীকে সবসময় নজরে রাখতে হবে।
  • রোগীর জন্য নিরাপদ পরিবেশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
  • রোগীর নাগালের ভেতর ছুরি, কাঁচি জাতীয় ধারালো জিনিসপত্র, সহজেই ভঙ্গুর কোনোকিছু এবং ওষুধপত্র রাখা যাবে না।
  • ধারালো কিছু যদি রোগী কোনোভাবে নিজের কাছে নিয়ে নেন তাহলে রোগীর সামনাসামনি হওয়ার সময় অবশ্যই বালিশ বা কম্বল জাতীয় নরম কিছু রোগী ও নিজের মাঝখানে রাখতে হবে।
  • ধারালো জিনিস হাত থেকে সরানোর জন্য বিভিন্ন উপায়ে (যেমন রোগীর মুখের ওপর পানি ছিটিয়ে) রোগীর মনোযোগ বিচ্যুত করা যেতে পারে।
  • আক্রমণাত্মক রোগী যে শুধু অন্যের ওপর আক্রমণ করে তা নয়, নিজের ওপরও আঘাত করে থাকে। তাই রোগী যেন ভেতর থেকে নিজের ঘর ও বাথরুম বন্ধ করতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
  • রোগীকে ঘরের বাইরে, ছাদে, গ্রিলবিহীন উচুঁ বারান্দা বা জানালার পাশে একা যেতে দেওয়া যাবে না।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ খাওয়াতে হবে।

আক্রমণাত্মক রোগীর আচরণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষে সাধারণত শারীরিক ও রাসায়নিক দুই ধরনের প্রতিরোধ মূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। আক্রমণাত্মক রোগী যেন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের মাধ্যমে নিজের ও অন্যের কোনো ক্ষতি করতে না পারে, এজন্য কখনো কখনো শারীরিক প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপের (Physical restrain) প্রয়োজন হয়। তখন কিছু সময়ের জন্য রোগীর হাত-পা আটকে রাখা বা ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে প্রতি পনের মিনিট পর পর অবশ্যই রোগীকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে আক্রমণাত্মক রোগীকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষে রাসায়নিক প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপই (Chemical restrain) অধিক গুরুত্বপূর্ণ যা মূলত উত্তেজনা প্রশমনকারী ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে করা হয়। কাজেই সর্বোপরি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শমতো আক্রমণাত্মক রোগীর রোগ নির্ধারণ করে নিয়মিত দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। নিয়মিত ওষুধ এবং উপদেশ মেনে চললে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী বা হিংস্র আচরণ পরিবারের মধ্যে রেখেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমহামারিতে অস্থির মন: সুস্থতার জন্য যা করতে পারেন
Next articleঅলসতা নাকি বিষণ্ণতা?
অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, সিলেট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here